রোহিঙ্গা সঙ্কটে জাতিসংঘ ব্যর্থ কেন?

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

অক্টোবর ২৫, ২০২১, ০৩:২৭ এএম

রোহিঙ্গা সঙ্কটে জাতিসংঘ ব্যর্থ কেন?

জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর পেরিয়েছে ৭৬ বছর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে শান্তি রক্ষা, যুদ্ধ বন্ধ এবং অন্যান্য যেসব লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার কতোটা পূরণ করতে পেরেছে?

জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর যুদ্ধ-সহিংসতা থামার পরিবর্তে প্রতিবছর সহিংসতা-যুদ্ধ বেড়েই চলেছে। ২০১৯ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৪৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতিটি দশকে ৫০ টিরও এর অধিক সহিংসতা-যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। অথচ, ১৯৪৫ সালের জাতিসংঘ সনদ অনুসারে, ভবিষ্যত প্রজন্মকে যুদ্ধের অভিশাপ থেকে মুক্ত রাখাই ছিল এর অন্যতম উদ্দেশ্য। জাতিসংঘ এই ভূমিকা পালনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে একথা বলা যাবে না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপীয় উপনিবেশগুলো একের পর এক স্বাধীন হতে থাকে। একইসঙ্গে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে তৃতীয় বিশ্বের এসব সদ্য স্বাধীন দেশই হয়ে উঠতে থাকে নতুন যুদ্ধক্ষেত্র। এর কারণ হিসেবে গবেষকরা চিহ্নিত করেছেন, বৈশ্বিক শক্তিগুলোর পারমাণবিক ও উন্নত অস্ত্রের অধিকারী হওয়াকে।

ফলে এসব দেশ এখন নিজেরা যুদ্ধে না জড়িয়ে অন্য দেশে টেনে নিয়ে যায়। তৃতীয় বিশ্বের দিকে তাকালেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যকার স্নায়ুদ্ধের বলি হয়েছে কিউবা, আফগানিস্তান, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশ।

বিশ শতকের শেষ দশকে রাশিয়া ভেঙে গেলে স্নায়ুযুদ্ধের প্রভাব অনেকটা স্তিমিত হলেও ইদানীং মাথাচাড়া দিয়েছে। সিরিয়া, তুরস্ক, আফগানিস্তানে চলমান ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করলে প্রমাণিত হবে যে, রাশিয়া-চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এখনো স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। তারই জের ধরে বিশ্বের অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে একাধিক সহিংসতা ও যুদ্ধ চলমান।

এর মধ্যে, ১৯৪৮ সাল থেকে চলমান কাশ্মির সঙ্কট, একই বছর থেকে চলমান ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সঙ্কট, সোমালিয়ার গৃহযুদ্ধ, ইরাক যুদ্ধ, সিরিয়া গৃহযুদ্ধ এবং রোহিঙ্গা সঙ্কট। তালিকা আরো দীর্ঘ করা যায়। এসব সঙ্কট সমাধানের সুযোগ পেয়েও কিন্ত সেগুলো কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তেমনি ব্যর্থ হয়েছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে।

রোহিঙ্গা সঙ্কটের সূত্রপাত জাতিসংঘের জন্মের বেশ পরে। যথেষ্ট সময় পেয়েও কেন বৈশ্বিক এই সংস্থাটি রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে ব্যর্থ হলো?

বিবিসির এক প্রতিবেদনে (২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭) বলা হয়, যখন রোহিঙ্গারা প্রাণ বাচাতে পালিয়ে বাংলাদেশে যাওয়ার সময় জাতিসংঘ তাদের থামানোর কোন উদ্যোগ নেয়নি। প্রতিষ্ঠানটি রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে রাখার পরিবর্তে বাংলাদেশে প্রবেশ করেতে দিয়ে মানবিক সহায়তার দিকে নজর দিয়েছে।

দুঃখের ব্যাপার হলো, জাতিসংঘ ২০১৭ সালে যে দৃষ্টিতে রোহিঙ্গা সঙ্কট দেখেছে এখনো সেই দৃষ্টিভঙ্গিই আছে। জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে এখনো কোন পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টো রোহিঙ্গাদের নোয়াখালীর ভাসানচরে স্থানান্তরে অনীহা প্রদর্শন করেছে। শেষ পর্যন্ত তারা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তিতে এসেছে। চুক্তি অনুসারে তারা ভাসানচরের রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও মানবিক সহায়তা কার্যক্রম চালিয়ে যাবে।

কিন্তু মানবিক সহায়তা কার্যক্রম কেন? জাতিসংঘ কেন শরণার্থীদের নিজে দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা না করে প্রায় দশ লাখ শরণার্থীকে বাংলাদেশে রেখে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করছে?

জাতিসংঘের এই ব্যর্থতা কেন? এর পেছনে কারণ কী?  

বিবিসির পূর্বোক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢল নামার ৪ বছর আগেই এই ঢল থামানোর সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু জাতিসংঘ তখনও রাখাইনে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম চালিয়েছে। সেসময়ই মিয়ানমারে জাতিসংঘের দূত রেনাটা লক ডেসালিয়ন রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নির্মূলীকরণ অভিযানের ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন।

পরে, মিয়ানমারের সরকার রাখাইনের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সকল প্রকার কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা দেয়। সময় পেলেও জাতিসংঘ সেসময় জোরালো ভূমিকা নেয়নি। একইসঙ্গে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সান সু চির ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। মিয়ানমারে সামরিক সরকার সু চির প্রতি অনেকটা নমনীয় থাকলেও সু চি সেসময় রোহিঙ্গা ইস্যুতে সেনাবাহিনীকে নীরব সমর্থন দিয়েছেন।

রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদের সময় এবং উচ্ছেদের আগে জাতিসংঘের ভূমিকা ছিল নীরব। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে জাতিসংঘের ভূমিকা খুঁজতে গিয়ে গুয়েতেমালার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী গার্ট রোজেনথাল ২০১৯ সালে ৩৬ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা সঙ্কটকে ‘সিস্টেমেটিক অ্যান্ড স্ট্রাকচারাল ফেইলিয়র’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

রোজেনথালের প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনার পরপরই পরিস্থিতি ‍উন্নয়নে জাতিসেংঘ কোন তড়িৎ পদক্ষেপ নেয়নি। প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, ২০১০ সাল থেকে জাতিসংঘ মিয়ানমারে জড়িত। ২০১০ সালের পর থেকে দেশটির সামরিক সরকার একদিকে রাখাইনে সামরিক শক্তি বাড়াতে থাকে অন্যদিকে দেশকে গণতন্ত্রের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। রাজনৈতিক দলগুলোকে কাজ করার সুযোগ দেয়, মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণ করে। কিন্তু সেটা আইওয়াশ ছিল মাত্র।

কেননা, মিয়ানমারে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নির্মূলের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি চলতি অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে তারা দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে সেনা সমাবেশ করছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স। ফলে পরিস্থিতি যা ছিল তাই থাকছে।

রোজেনথাল তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, জাতিসংঘের সিস্টেমই এর স্বাধীনভাবে কাজ করার এবং শক্তিশালী হয়ে উঠার অন্তরায়। ফলে জাতিসংঘ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা ইস্যুতে শক্তিশালী ভূমিকা নিতে পারেনি। এখানে রোজেনথাল এবং ইংল্যান্ডের ম্যাকালিস্টার কলেজের গবেষক নিল গার্ডিনারের গবেষণা আমলে নিতে পারি। দুজনই বলেছেন, জাতিসংঘের ব্যর্থতার পেছনে সংস্থাটিরর কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত অনীহা এবং এর নেতৃস্থানীয় সদস্য দেশগুলোর রাজনৈতিক স্বার্থকে দায়ী করেছেন। আবার, কর্মকর্তাদের অনীহার কারণ হিসেবে দুজনেই জাতিসংঘের ‘সিস্টেম’কে দায়ী করেছেন।

তবে জাতিসংঘের ব্যর্থতার সবচেয়ে বড় কারণ নিরাপত্তা পরিষদ। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলো তাদের স্বার্থ বিজড়িত এলাকায় কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজি ছিল ভারত মহাসাগরে চীনকে বাঁধা দিতে মিয়ানমারকে তাদের পক্ষপুটে টানা। সে চেষ্টা তারা করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে পাশ কাটিয়ে অং সান সু চিকে দিয়ে। তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে বলাই বাহুল্য।

যুক্তরাষ্ট্রকে এই জায়গায় হারিয়ে দিয়ে চীন মিয়ানমারে নিজের অবস্থান দৃঢ় করেছে। নিরাপত্তা পরিষদের অন্যান্য সদস্য দেশগুলোর মধ্যে রাশিয়া বাদে বাকীরা কোন না কোনভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। তারা তাদের কৌশলগত মিত্রেরে সঙ্গে দ্বিমত কবে এমন নয়। আবার রাশিয়া মিয়ানমারে অন্যতম অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। ফলে কোন না কোন কারনে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা তাদের স্বার্থ দেখেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে চুপ থেকেছে। অপরদিকে, সাধারণ পরিষদে ভোটাভুটিতেও এই বিষয়ে কোন রেজুলেশন পাস হয়নি। সামগ্রিক বিচেনায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘ অভ্যন্তরীণভাবে ও বাহ্যিকভাবে নেতৃত্বস্থানীয় দেশগুলোর স্বার্থের কাছে হার মেনে গেছে।

যাইহোক, জাতিসংঘের এই ধরণের ধারাবাহিক ব্যর্থতা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে প্রতিষ্ঠানটির বিশ্বাসযোগ্যতা এবং গ্রহণযোগ্যতা কমাবে। যা একে ভবিষ্যতে অকার্যকর ও নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পারে। একেও এর পূর্বসূরী লীগ অব নেশনস বা জাতিপুঞ্জের ভবিষ্যত বরণ করতে পারে।

Link copied!