তৎপর কিশোর গ্যাং, জড়াচ্ছে খুনসহ নানা অপরাধে

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

মার্চ ২৭, ২০২৩, ০৯:১৪ পিএম

তৎপর কিশোর গ্যাং, জড়াচ্ছে খুনসহ নানা অপরাধে

২০২১ সালের ২৯ মার্চ দিবাগত রাতে অনন্ত নামে চৌদ্দ বছরের এক কিশোর নৃশংসভাবে খুন হয়। ওই হত্যাকান্ড ঘটে শবেবরাতের রাতের সাড়ে ১১টার দিকে পুরনো ঢাকার সুত্রাপুরের লালকুঠি এলাকায়। ওই ঘটনায় আহত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সাজু সেই সময় জানায়, স্থানীয় মিল ব্যারাক এলাকার সন্ত্রাসী মুন্না, আকাশের আশ্রয়ে জুনিয়র ফেরদৌস, আলামিনের সাথে অনন্ত, সাজু সোহেলের ঝগড়া হয়। এ ঘটনার জেরে শবেবরাতের রাতের সাড়ে ১০টার দিকে মিল ব্যারাক লালকুঠি ঘাটে কিশোর গ্যাংয়ের দুপক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটে। এ সময় অনন্তর পেটে একাধিক ছুরিকাঘাত করা হয়। এতেই সে মারা যায়। 

জানা যায়, ওই কিশোররা প্রায়শঃ এমন সংঘর্ষ বাঁধায়, খুনোখুনি করে। তাঁরা এখনো বেপরোয়া।

গত বছর আলোচিত এক ঘটনা ছিল রাজধানীর আসাদগেটে পিকনিকফেরত বাসে মাদক সেবনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত দুই গ্রপের মারামারি। সেই ঘটনায় ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয় এক কিশোরকে। ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে কয়েকজন কিশোরকে এরইমধ্যে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

আরও পড়তে পারেন

রোজা এলেই তৎপর হয়ে ওঠে কিশোর গ্যাং

গত শুক্রবার ২৪ শে র্মাচ ভোর রাতে সাহরি শেষে নামাজ পড়তে গিয়ে ফিরে আসার সময় রাজধানী যাত্রাবাড়ী কুতুবখালিতে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন আব্দুর রহিম মিয়া (৫২)। তাঁর কাছ থেকে ফোনসহ কিছু খুচরা টাকা চাকু দেখিয়েই নিয়ে যায় তাঁরা।

রাজধানীতে এরকম কিশোরদের অসংখ্য গ্যাং গড়ে উঠেছে। চলতি রোজার মাসকে ঘিরে আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে ১৪ থেকে ২০ বছরের শিশু-কিশোরদের কথিত এই গ্যাংগুলো। এরা ছিনতাই, খুনসহ নানা রকম অপরাধে জড়াচ্ছে।

শুধু রাজধানীই নয়, দেশজুড়ে নগরকেন্দ্রিক কিশোর গ্যাং কালচার দিন দিন ভয়ংকর হয়ে উঠছে। মাদক নেশায় জড়িয়ে পড়া থেকে শুরু করে চুরি, ছিনতাই, ইভটিজিং, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা।

এমনকি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব কিংবা অন্য গ্যাংয়ের সাথে তুচ্ছ বিরোধকে কেন্দ্র করে খুন-খারাবি থেকেও পিছপা হচ্ছে না কিশোর অপরাধীরা। উদ্বেগের বিষয় হলো, মাদক নেশার টাকা জোগাতে ছোটখাটো অপরাধে জড়ানো কিশোর অপরাধীরা বয়স বাড়ার সাথে সাথে হয়ে উঠছে ভয়ংকর অপরাধী, এলাকার ত্রাস।

আরও উদ্বেগের বিষয়, ভাড়াটে হিসেবে তাঁরা এখন মানুষ হত্যার মতো অপরাধে যুক্ত হচ্ছে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ‘প্রলয় গ্যাং’ নামের এক গ্যাংয়ের কথা শোনা যাচ্ছে। ওই গ্যাং অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জুবায়ের ইবনে হুমায়ুনকে রড-লাঠি দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে।

বাংলাদেশে ২০১৩ সালে প্রণীত শিশু আইন অনুযায়ী, এখন ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগ পর্যন্ত যে কেউ শিশু হিসেবে বিবেচিত হবে। শুধু তাই নয়, নয় বছরের কম বয়সি শিশুকে কোনো অপরাধের অভিযোগে আটক বা শাস্তি দেওয়া যাবে না। ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত কাউকে আটক করা হলে তাদের হ্যান্ডকাপ পড়ানো যাবে না। আর শিশু-কিশোরদের বিচার হতে হবে শিশু-কিশোর আদালতে।

আদালত তাদের বিচার শেষে ‘অপরাধের' প্রমাণ পেলে শিশু কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠাবে। আদালত যতদিন নির্দেশ দেবে, ততদিন তারা সেখানে থাকবে। এসব কেন্দ্রে শিশুদের মানসিক, চারিত্রিক, শিক্ষা এবং আত্মিক উন্নয়ন ঘটানোর কথা।

ডিএমপির অপরাধ পর্যালোচনার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ৪০টির মতো কিশোর গ্যাং রয়েছে। প্রতিটি গ্যাং-এর সদস্য সংখ্যা ১৫-২০ জন।

পুলিশ সূত্র জানায়, গত এক বছরে ঢাকায় অন্তত পাঁচটি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে এই গ্যাংগুলো। এর মধ্যে উত্তরার কিশোর গ্যাং সবচেয়ে আলোচিত। সেখানে একাধিক গ্যাং রয়েছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে উত্তরায় ডিসকো এবং নাইন স্টার গ্রুপের দ্বন্দ্বে নিহত হয় কিশোর আদনান কবির। তার পরের মাসে তেজকুনি পাড়ায় দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে খুন হয় কিশোর আজিজুল হক। ঢাকার বাইরে থেকেও প্রায়ই কিশোর গ্যাং-এর দ্বন্দ্বে খুনখারাবির খবর পাওয়া যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন,  নিম্নবিত্ত পরিবারে যেমন বাবা -মা দুইজনই কাজে বেরিয়ে যান, তেমনি মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত পরিবারেও বাবা-মা সন্তানকে সময় দেন না। তারা নানা ধরনের গেম, সিনেমা দেখে, একাকিত্বের কারণে অপরাধী হয়ে ওঠে। আর সমাজ ও রাষ্ট্রে অপরাধ, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারও তাদের অপরাধে প্রলুব্ধ করে৷রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার শিশুদের জন্য শিশুবান্ধব পরিবেশ দিকে ব্যর্থ হচ্ছে। তাদের মধ্যে মূল্যবোধ তৈরি করতে পারছে না। যার পরিণতি আমরা এখন দেখছি।

তবে পরিবারের নজরদারি ও শিশুকিশোরদের ভেতরে মূল্যবোধ জাগ্রত করার মাধ্যমে এই কিশোর অপরাধ অনেকটাই কমিয়ে আনা যেতে পারে বলেও মনে করেন তিনি।

সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বলেছেন, কিশোররা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করলেও বয়সের কারণে তাদের শাস্তির আওতায় আনা যায় না। তাদের পাঠানো হয় কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে। সেখানে গিয়ে সংশোধিত হওয়া দূরের কথা, তাঁরা আরও ভয়ংকর হয়ে বেরিয়ে আসে।

Link copied!