‘সিসি ক্যামেরার অধীনে নয়, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিন’

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

অক্টোবর ১৭, ২০২২, ০৬:২৯ এএম

‘সিসি ক্যামেরার অধীনে নয়, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিন’

সিসি ক্যামেরার ফুটেজের ওপর নির্ভর করে ঢাকায় বসে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একটি আসনের উপ-নির্বাচন বাতিল করেছে জাতীয় নির্বাচন কমিশন। এ নিয়ে রাজনৈতিক মহল থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞরা সমালোচনা করছেন। একটি আসনে উপনির্বাচন যেখানে ইসির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, সেখানে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একই দিনে সব আসনের ভোট কার্যক্রম সিসি ক্যামেরায় নিয়ন্ত্রণ কীভাবে সম্ভব? এমন প্রশ্নে ইসি সূত্র বলছে, ৩০০ আসনে এভাবে সিসি ক্যামেরায় মনিটরিং করা সম্ভব নয়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু সিসি ক্যামেরায় চোখ রাখার ব্যর্থতা নয়, লোডশেডিং কিংবা ত্রুটিজনিত কারণেও দেশের বহু এলাকায় ডিজিটাল মনিটরিংয়ে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। কাজেই সিসি ক্যামেরার অধীনে নয়, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেওয়াই হবে সরকারের জন্য যথার্থ এবং অর্থবহ পদক্ষেপ।

গাইবান্ধা-৫ আসনের আলোচিত উপনির্বাচন বাতিল করায় ইসিকে অনেকে বাহবা দিলেও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতাদের দিক থেকে সমালোচনার তীর ছুটছে ইসির দিকে। কারণ সাংবিধানিকভাবে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের দায়িত্ব ইসিরই। কিন্তু গাইবান্ধা উপনির্বাচনে সেটি নিশ্চিত করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। বিপুল অর্থ ব্যয় করে ওই নির্বাচন আয়োজন করা হলেও অনিয়মের অভিযোগ তুলে মাঝপথে নির্বাচন বন্ধ করতে হয়েছে। এতে নতুন করে নির্বাচনে মানুষের করের টাকাই খরচ হবে।

সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চলতি বছরের গত ৮ অক্টোবর জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারদের (এসপি) সাথে বৈঠক করেছিল ইসি। কিন্তু সেই বৈঠকের সফলতা খুব একটা কাজে লাগেনি। যা গাইবান্ধায় নির্বাচন বাতিলে সিইসির বক্তব্যে অসহায়ত্বই ফুটে ওঠেছে। ডিসি ও এসপির কাঙিক্ষত সহযোগিতা পায়নি ইসি। ভোটের দিনের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, রিটার্নিং অফিসার, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সাথে টেলিফোনে তিনি ও নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা কথা বলেছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।

নির্বাচন বাতিলের পর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সোমবার গাইবান্ধা-৫ আসনে মাঠপর্যায়ে গিয়ে তদন্ত শেষে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন ইসিতে জমা দেবে তদন্ত কমিটি।

  • জাতীয় নির্বাচন কমিশনের জনসংযোগ পরিচালক ও যুগ্ম সচিব এসএম আসাদুজ্জামান দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ‘সিসি ক্যামেরার ফুটেজে বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের কাজ চলছে। গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন চলাকালীন ঢাকায় সিসি ক্যামেরার মনিটরের সামনে ইসি ছাড়াও সাংবাদিকরা ছিলেন। সাংবাদিকরাও সেই অনিয়ম দেখেছেন। নির্বাচনে কত শতাংশ ভোট পড়ল, সেটির ওপর প্রার্থীর জয়-পরাজয় নির্ভর করে না।

আসাদুজ্জামান আরও বলেন, একটি আসনে সিসি ক্যামেরা দেওয়ায় অনিয়ম প্রকাশ পেয়েছে। সেখানে এক দিনে সারা দেশে ৩০০ আসনে নির্বাচন হলে সেখানে সিসি ক্যামেরা দিয়ে মনিটরিং করা অসম্ভব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী দ্য রিপোট ডট লাইভকে বলেন, গাইবান্ধা উপনির্বাচনে ভোটের অনিয়মের ভিডিও সোসাল মিডিয়ায় স্পষ্ট দেখা গেছে। ডিজিটাল বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগ অনেক বেশি সোচ্চার। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট দিতে এসে যারা লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁদেরকে ইভিএম নিয়ে সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করছিলেন, তখন ভোটাররা বলেছেন, তারা এ রকম মেশিন কখনো দেখেননি। তাঁরা ভোটদান প্রক্রিয়া দেখিয়ে দিতেও অনুরোধ করছিলেন। এই যখন অবস্থা, সেখানে  নির্বাচন কমিশন কেন ইভিএমে ভোট নিচ্ছে?

ড. দিলারা বলেন, গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে ডিসি, এসপি সরাসরি সরকারের পক্ষ নিয়ে কাজ করেছে। সেখানে সিইসি নির্লজ্জ হতে পারেন নাই, চক্ষু লজ্জার কারণে নির্বাচন বন্ধ করে দিয়েছেন। একটি আসনের উপনির্বাচনে ভোট কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা বসিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারেনি, সেখানে এক দিনে ৩০০ আসনে সিসি ক্যামেরা বসিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন করা অসম্ভব।

  • ড. দিলারা বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন বাংলাদেশে সম্ভব নয়। বাংলাদেশকে বাঁচাতে চাইলে যে কোনো নির্দলীয় সরকারের অধীনে ক্ষমতা দিয়ে আওয়ামী লীগকে পদত্যাগ করা উচিত। আমাদের দেশ প্রচণ্ড সহিংসতার দিকে চলে যাচ্ছে।

অধ্যাপক দিলারা বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কিছুটা মানসিক বিভ্রান্ত দেখা দিয়েছে। এই বিভ্রান্তির জন্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক কথা বলছেন, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ আরেক কথা বলছেন। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন বাংলাদেশে সম্ভব নয়। বাংলাদেশকে বাঁচাতে চাইলে যে কোনো নির্দলীয় সরকারের অধীনে ক্ষমতা দিয়ে আওয়ামী লীগকে পদত্যাগ করা উচিত। আমাদের দেশ প্রচণ্ড সহিংসতার দিকে চলে যাচ্ছে। এখানে বর্হিশক্তির হস্তক্ষেপ হবে। বাংলাদেশের অস্তিত্ব নিয়ে টান পড়বে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, সরকারের সহযোগিতা ছাড়া নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে না। এরপরও ইসির সর্বোচ্চ ক্ষমতা (নিউক্লিয়ার অপশন) প্রয়োগ করলে খারাপ নির্বাচন, বিতর্কিত নির্বাচন ঠেকাতে পারে। নিউক্লিয়ার অপশন প্রয়োগ করে নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করতে পারে, নির্বাচন স্থগিত করতে পারে এবং নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে ইসি।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা উঠে দেওয়ায় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যাপক দলীয়করণ হয়েছে এমন মন্তব্য করে বদিউল আলম মজুমদার আরও বলেন, সারা দেশে এক দিনে ৩০০ সংসদীয় আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সব কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা বসানো সম্ভব নয়। সিসি ক্যামেরা বসালেও ওই দিন সারা দেশে লোডশেডিং থাকবে, সেটি নিশ্চিত করা যাবে কীভাবে? এছাড়াও বিভিন্ন কেন্দ্রে তাৎক্ষণিক সিসি ক্যামেরা বন্ধ কিংবা ত্রুটি দেখা দিতে পারে। কাজেই সিসি ক্যামেরার অধীনে নয়, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে।

প্রসঙ্গত, গত বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে গাইবান্ধা-৫ আসনের ভোট পর্যবেক্ষণের মনিটরিং সেলে বসে নির্বাচন বন্ধের ঘোষণা দেয় ইসি। তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। এছাড়া বাকি আসনে ব্যালটে ভোট হবে। এছাড়াও বেশকিছু কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো সংসদীয় এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ, নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও সরবরাহ, বিধিবিধান অনুযায়ী ভোটকেন্দ্র স্থাপন, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও নিবন্ধিত দলের নিরীক্ষা, সংশ্লিষ্টদের সক্ষমতা বৃদ্ধি, নির্বাচনে অধিকতর প্রযুক্তির ব্যবহার এবং পর্যবেক্ষক সংস্থা নিবন্ধন ও নবায়ন কার্যক্রম।

Link copied!