একটা সময় ছিল যখন পৃথিবীর শতকরা ৮০ ভাগ সম্পদ ছিল চৈনিক-মোঘল-পারস্য সাম্রাজ্যে। তারপর পনের শতকে ইউরোপে রাষ্ট্র ধারণা বিকশিত হলে তারা বিশ্বব্যাপী কলোনি গড়ে তোলা আরম্ভ করে। তখন থেকেই পুঁজিবাদের বিকাশ শুরু। পরবর্তী পাঁচশো বছর ধরে কোন না কোনভাবে পুঁজি বা সম্পদের প্রবাহ ছিল পূর্ব থেকে পশ্চিমের দিকে অর্থ্যাৎ এশিয়া থেকে ইউরোপ এবং পরে আমেরিকার দিকে। এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের হাত ধরে পুজিবাদ বিকশিত হয়ে এর চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। একই সময়ে, যুক্তরাষ্ট্র প্রবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থা বা ওয়ার্ল্ড অর্ডার চালু হয়। যা এখনো চলমান। ধারণা করা হয়, এই বিশ্ব-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা খুব শীঘ্রই প্রতিস্থাপনযোগ্য নয়। ফলে বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্র প্রবর্তিত এই বিশ্ব ব্যবস্থাই বহাল থাকার সম্ভাবনা বেশি।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র প্রবর্তিত এই বিশ্ব ব্যবস্থার কেন্দ্র থেকে যুক্তরাষ্ট্র ক্রমশ নিজেই ছিটকে পড়ছে। তার জায়গা ক্রমশ দখল করেছে চীন। যদিও এখনো চীন সামরিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ নয় কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে শিঘ্রই। নিজ প্রবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের এমন হীন অবস্থা যুক্তরাষ্ট্র মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু মেনে না নিয়েও উপায় নেই।
কেন উপায় নেই? উপায় নেই কারণ পুঁজির স্বাভাবিক ধর্ম হলো নিজের বিকাশ সাধন। পুঁজি পশ্চিমে এমন ভাবে বিকশিত হয়েছে যে, সেখানে আর বিকশিত হওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। ফলে পুঁজি স্বাভাবিক ভাবেই তার বিকাশের উপযুক্ত স্থান সন্ধানে বেড়িয়ে এশিয়াকে তার বিকাশ কেন্দ্র হিসেবে বাছাই করেছে। আর এই বাছাইকৃত এলাকার কেন্দ্রে অবস্থান করছে চীন।
ঠিক এ কারণেই চীন যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার কারণ। কেননা, পশ্চিম থেকে যে পুজি পূর্বে আসছে সেটার আবার বৃহৎ অংশই পশ্চিমে ফেরত যাচ্ছে কোন না কোন উপায়ে। এখন এই প্রবাহ যদি যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে পশ্চিমা পুঁজি একসময় রুগ্ন হয়ে তাদের অর্থনীতিক গ্রাস করবে। যেমনটা করেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতিকে। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা চাইবে না তাদের পুঁজি রুগ্ন হয়ে যাক। ঠিক এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র চীনকে যেমন সহ্য করতে পারছে, চীনের উত্থানও মেনে নিতে পারছে না আবার ফেলেও দিতে পারছে না। চীন একাধারে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির বেঁচে থাকার অন্যতম শর্ত এবং একই সঙ্গে তার প্রতিদ্বন্দ্বীও।
তাই যুক্তরাষ্ট্রের চীনের সঙ্গে চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের হিসাবে এনে যুক্তরাষ্ট্র নিজে না খেলে খেলাচ্ছে অন্যকে দিয়ে। এবং এই খেলায় যুক্তরাষ্ট্রের খেলোয়াড়রা হচ্ছে ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং তাইওয়ান। খেলার ময়দান হলো ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর। আর যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত মিত্র এসব দেশ কোন না কোনভাবে Quadrilateral Security Dialogue বা কোয়াড এবং অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের নামের অদ্যাক্ষর নিয়ে গঠিত জোট অকাস (AUKUS) এর সদস্য।
আর এই খেলায় যখন ভারতের হিস্যা বা অংশগ্রহন থাকে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তখনই বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতির হিসাবটা স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে।
কোয়াডের সদস্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত মিত্র হিসেবে ভারত যখন চীন বিরোধীতা করে তখন তা অধিকাংশ সময়ই বাংলাদেশের স্বার্থকে মাড়িয়ে যায়। এটা ওপেন সিক্রেট যে, ১/১১ এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে যতো রাজনৈতিক পট পরিবর্তন তার পেছনে ভারতে প্রভাব আছে। তারই সর্বশেষ নজির হিসেবে ভারত যখন বাংলাদেশকে তিস্তার ন্যায্য হিস্যা দিতে গড়িমসি করছিল তখন বাংলাদেশ সরকার চীনকে সঙ্গে নিয়ে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সেখানেও ভারত তার শিলিগুড়ি চিকেন নেকের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে এই অজুহাত তুলে তিস্তা মহাপরিকল্পনার বিরোধীতা করছে। এছাড়াও, বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে রোড এবং নৌপথে ট্রানজিট নেওয়াসহ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনেক বেশি সুবিধা আদায় করার চেষ্টা ভারত করেছে। বিনিময়ে বাংলাদেশের কি লাভ হয়েছে সেটার হিসাব মেলানো খুব সহজ। ২০২০-২১ বছরে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার বাণিজ্য ঘাটতি ছিল প্রায় ৫/৬ শ কোটি ডলারের ঘরে। ফলে বাংলাদেশ যে এই দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের ফায়দা তুলতে পারেনি সেটা এখানে স্পষ্ট।
আবার, চীন-ভারতের মধ্যকার সম্পর্কও অনেক বেশি শীতল এবং একইসাথে উষ্ণ। দুই দেশের সম্পর্ক সামরিক ক্ষেত্রে অস্থিতিশীল হলেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বেশ ঊষ্ণ। একইসঙ্গে, এই দুই দেশ আবার বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থেনৈতিক জোট ব্রিকস (BRICS) এর সদস্য। এখানে থেকে একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারা যায় যে, এই দুই দেশ যুগপৎ একে অপরের শত্রু এবং বন্ধু।
আবার, বাংলাদেশ যেহেতু চীনের নিউ সিল্করুটের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। সেটাকে আবার ভারত ভালো চোখে দেখছে না। ফলে এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশ ভারতের পারস্পরিক সম্পর্ক প্রায়ই বিভিন্ন স্বার্থের ক্ষেত্রে পরস্পরকে মাড়িয়ে যাচ্ছে। এবং এখানে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আসলে বাংলাদেশ।
কোয়াড এবং অকাসের সদস্য দেশগুলোর বেশিরা ভাগই এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের। জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারত। যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে এখানে মূল খেলোয়াড়। বাংলাদেশের উপর প্রচ্ছন্ন চাপে আছে মার্কিন বলয়ে প্রবেশ করা নিয়ে। এই চাপের ব্যাপারে অবগত আছে চীনও। তাই তো তারা সকল প্রকার কূটনৈতিক সৌজন্য বিসর্জন দিয়ে তাদের রাষ্ট্রদূতের মুখ দিয়ে এ কথা পর্যন্ত বলিয়েছে যে, কোয়াডে যোগ দিলে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক 'যথেষ্ট খারাপ হবে'। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যদিও এ প্রসঙ্গ বলেছিলেন যে, বাংলাদেশ এখনো এই ব্যাপারে অ্যাপ্রোচ করেনি। কিন্তু এটা নিয়ে যথেষ্ট জল ঘোলা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত খুবই সতর্কতার সঙ্গে খেলেছে। তবুও অকাস-কোয়াডের মাধ্যমে চলমান প্রক্সি ওয়ারের কারণে বাংলাদেশ আসলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এদিকে জাপান বাংলাদেশের পুরনো এবং পরীক্ষিত মিত্র। জাপানের তরফ থেকে বাংলাদেশকে যথেষ্ট সাহায্য দেওয়া হয়। যদিও কোয়াড জোটের সদস্য হিসেবে জাপান তার অন্যান্য কৌশলগত মিত্রের পক্ষে কথা বলে বাংলাদেশের সঙ্গে গাঁটছাড়া ছিন্ন করে তাহলে সেটা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় আঘাত হয়ে ধরা দেবে। তবে আশার কথা জাপানের পক্ষ থেকে এখনো এমন কোন মন্তব্য বা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
এবং এশিয়া প্যাসিফিকে কোয়াড-অকাসের অন্যতম সদস্য অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক বা রাজনৈতিক সম্পর্ক সেভাবে আলোচিত নয়। তবে দেশটিতে প্রচুর বাংলাদেশী বিশেষ করে শিক্ষার্থী বসবাস করেন এবং বিশাল অঙ্কের রেমিটেন্স ও মেধাসম্পদ সেখান থেকে বাংলাদেশে আসে।
অকাস-কোয়াড জোটের কারণে ধারণা করা হয়, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য থেকে ভারত, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ায় বিপুল সামরিক এবং বেসামরিক প্রযুক্তি হস্তান্তর হবে। এবং এসব কারণে ভারত মহাসাগরে বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরে ভারতের সামরিক উপস্থিতি বাড়বে। তার জবাব হিসেবে এই এলাকায় মিয়ানমারের এবং চীনের সামরিক উপস্থিতি বাড়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে। যা এই এলাকার ভারসাম্য নষ্ট করবে। ভারসাম্য বজায় রাখতে বাংলাদেশকেও বাধ্য হয়ে তার সামরিক সজ্জা বাড়াতে হবে। আবার, ভারত এগিয়ে গেলে পাকিস্তানও বসে থাকবে না। ইতোমধ্যে, পাকিস্তানে চীনের বিনিয়োগ বিপুল পরিমাণে বেড়েছে। বেড়েছে বাংলাদেশেও।
এদিকে, বাংলাদেশে চীনকে বাইপাস করার মতো মূলধন ভারতের নেই। ফলে, এখানেই প্রতিযোগিতায় ভারত হেরে যাচ্ছে। কিন্তু ভারত আবার তার পিছিয়ে পড়া স্থান পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করতে পারে। তার কথা আগেও বলা হয়েছে। ফলে বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ভারত যখন কোয়াড জোটের সদস্য হয়ে এই এলাকায় চীন বিরোধী অস্থান নিচ্ছে তখন সেটা অবধারিতভাবেই বাংলাদেশের স্বার্থকে আঘাত করছে। স্বাধীনভাবে বাংলাদেশকে তার পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে বাঁধা দিচ্ছে। বাঁধাগ্রস্ত করছে বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগও।
ফলে দেখা যাচ্ছে, অকাস-কোয়াড জোট যখন চীনকে ঠেকাবার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে তখন তা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ককে শঙ্কার মুখে ফেলছে। এখানে একটা বিষয় মনে রাখা দরকার যে, চীন বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী দেশে। চীনা বিনিয়োগ বাংলাদেশের সক্ষমতা তৈরি করছে। ফলে, বাংলাদেশ থেকে চীন সরে যাওয়া মানে বাংলাদেশে চলমান অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং সক্ষমতা নির্মাণ বন্ধ হয়ে যাওয়া।
সুতরাং, কোয়াড-অকাস জোট যখন চীনকে বাঁধা দেওয়ার জন্য গঠন করা হচ্ছে তখন তা প্রায়ই এই অঞ্চলে ভারত চীন দ্বন্দ্ব হয়ে প্রকটভাবে বাংলাদেশের জন্য বিপদ হিসেবে হাজির হচ্ছে। অকাস যদিও ততোটা এশিয়া কেন্দ্রিক নয় তবে সেটা অবশ্য প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের প্রভাব খর্ব করার জন্য। আর উঠতি বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্র হিসেবে চীন রাষ্ট্র এবং তার পুঁজি চাইবে যেকোন মূল্যে যেকোন বাঁধা কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে। এবং এখানেই আবারো ভারত-চীন দ্বন্দ্ব সামনে আসবে। সামনে আসবে চীনের আত্ম প্রকাশের তাকিদ। ফলে, এই এলাকার সামরিক ভারসাম্য যে নষ্ট হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। একইসঙ্গে, বাংলাদেশ মিয়ানমারের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তা প্রভাব বিস্তার করবে। এবং তা বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সুতরাং, সামগ্রিক বিবেচনায় অকাস-কোয়াড জোট যতো বেশি চীনের প্রভাবকে খর্ব করার চেষ্টা করবে, ভারত যতো বেশি যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের হয়ে এই অঞ্চলে চীনের বিপক্ষে প্রক্সি ওয়ারে জড়িয়ে থাকবে ততোদিন বাংলাদেশ স্বাধীনভাবে তার পররাষ্ট্রনীতি প্রয়োগে হোঁচট খাবে।
লেখক: সাংবাদিক