তারুণ্য বান্ধব চমক নিয়ে আসছে আওয়ামী লীগের ইশতেহার

মাহাবুব আলম শ্রাবণ

ডিসেম্বর ২৭, ২০২৩, ০১:০৬ এএম

তারুণ্য বান্ধব চমক নিয়ে আসছে আওয়ামী লীগের ইশতেহার

২০৪১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনায় থাকছে ইশতেহারে। ছবি: দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ

* দ্রব্যমূল্য ও দুর্নীতি রোধের বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে

* বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা অনুসারে ইশতেহার পরিকল্পনা করছে আওয়ামী লীগ

বইছে ভোটের হাওয়া, হরদম চলছে প্রচারণা। নির্বাচনকে ঘিরে এর মধ্যেই জমে উঠছে নির্বাচনী আসনগুলো। নির্বাচনের বাকি দু সপ্তাহেরও কম। এরপর ব্যালটের ছাপে নির্ধারিত হবে কে বসছেন বাংলাদেশের মসনদে।

চলতি বছরের নভেম্বরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)। নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট। টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করার প্রত্যাশা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের।

ডিজিটাল বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরিত করতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার প্রস্তুত করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। অন্যান্য ইশতেহার থেকে অনেকটাই ভিন্নতা দেখা গেছে এবারের ইশতেহারে তৈরির ক্ষেত্রে। এটি তৈরি করার পূর্বে জনসাধারণের মতামত চেয়ে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল দলটি। তাই দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলটির এবারের ইশতেহার তৈরিতে শুধু নেতৃবৃন্দ নয় বরং সাধারণ জনগণ সরাসরি অংশ নিয়েছে বলা যায়।

‘স্মার্ট বাংলাদেশ‍‍’ স্লোগান নিয়ে আসছে ইশতেহার

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহার হচ্ছে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। ডিজিটাল বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের রূপরেখা থাকছে এবারের ইশতেহারে, এমনটি জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার তৈরিতে সম্পৃক্ত নেতারা। তারা আরও বলেন, বড় ধরনের কিছু মৌলিক পরিবর্তনও আসবে এবারের ইশতেহারে।

গত ২৮ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন উপ-কমিটির প্রথম সভার মধ্যে দিয়ে ‘স্মার্ট বাংলাদেশের’ নতুন ইশতেহারে কী কী থাকছে সেই বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় অতীতের ইশতেহারগুলো সার্বিকভাবে পর্যালোচনা করে বিভিন্ন বিষয়ে খসড়া তৈরি করা হলে, পরবর্তীতে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা তা চূড়ান্ত করবেন।

*যে বিষয়গুলো স্থান পাবে এবারের ইশতেহারে–

ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে এবার কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক মুক্তিকে কেন্দ্র করে থাকছে ব্যাপক পরিকল্পনা। পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দুর্নীতি প্রতিরোধ, মাদক ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, আর্থিক খাতে সুশাসন এবং কৃষির ওপর জোর দিয়ে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইশতেহার প্রস্তুত করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। 

এবার দ্বাদশ নির্বাচনী ইশতেহারে একটি বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। এই ধরনের বড় পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে।

* কেমন ছিল আওয়ামী লীগের পূর্বের ইশতেহার-

২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগের স্লোগান ছিল ‘দিনবদলের সনদ’। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে সেই ইশতেহার দেওয়া হয়েছিল, যা ছিল অতীতের ইশতেহারগুলো থেকে একেবারেই ভিন্ন। তাতে খাতভিত্তিক ডিজিটালাইজেশনের রূপরেখা ছিল। এ ছাড়াও এই ইশতেহারে সবচাইতে বেশি গুরুত্বারোপ করা হয় যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি প্রদানের বিষয়কে। যার ভিত্তিতে ‍‍‘যুদ্ধাপরাধীদের ভোট দেব না‍‍’ স্লোগান বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তরুণ ভোটারদের কাছে।

২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের ইশতেহারের স্লোগান ছিল ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’। এদিকে ২০১৮ নির্বাচনী ইশতেহারে ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’। এই দুটিতে মূলত ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে উন্নয়ন ও অগ্রগতি তুলে ধরার পাশাপাশি খাতভিত্তিক আরও কী কী করা হবে, সেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ছিল ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’। সেসময় ২০৪১ সালে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ এবং ২১০০ সালে নিরাপদ ব-দ্বীপ পরিকল্পনার রূপরেখা প্রদান করা হয়েছিল।

২০২২ সালের ২৪ ডিসেম্বর টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার স্লোগানকে সামনে আনা হয়। এরপর থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশকে সর্বক্ষেত্রে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের কথা বলতে থাকেন সংসদ সদস্য-মন্ত্রীরা।

সময়ের চাহিদা অনুযায়ী, এবার ডিজিটাল বাংলাদেশের চূড়ান্ত পর্যায় হিসেবে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করা হবে। এতে সবক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশনের অগ্রগতি ও সুফল তুলে ধরার সঙ্গে স্মার্ট সেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে।

প্রতিবারের মতো এবারও দলের সভাপতি শেখ হাসিনা ঘোষণা করবেন ইশতেহার। দেশের প্রায় বারো কোটি ভোটারকে সামনে রেখে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে প্রণয়ন করা ইশতেহার প্রকাশ করতে যাচ্ছে দলটি।

আওয়ামী লীগ সূত্র বলছে, চলমান মেগা প্রকল্প, একাধিক নতুন প্রকল্পের পরিকল্পনা সহ ও এই সরকারের আমলে দেশব্যাপী উন্নয়নের দৃশ্যপটকে সামনে রেখে বেশ কয়েকটি খাতসহ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি তুলে ধরা হয়েছে বলে জানা যায়।

যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে

এবারের ইশতেহারে থাকছে চমক, বিগত নির্বাচনে দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের হিসাব-নিকাশের পাশাপাশি থাকবে নতুনত্ব - 

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, 

কৃষি খাতে উন্নয়ন,  

বিনিয়োগ বৃদ্ধি,

যুবকদের কর্মসংস্থান, 

স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন,

শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন, 

আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা,

আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর, 

দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স,

এছাড়াও ক্ষুদ্র, কুটির, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প গড়ে তোলা, কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন, কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে উৎপাদন পরিচালনা ও বৃদ্ধি এবং ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ নিশ্চিত করে কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ সড়ক, নৌ, রেল ও বিমান পথে অবশিষ্ট প্রকল্প শেষ করা অন্তর্ভুক্ত থাকবে এবারের ইশতেহারে।

ইশতেহার প্রণয়ন কমিটির আহ্বায়ক ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, দেশের ১৭ কোটি মানুষের প্রায় ৩০ ভাগ ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সের মধ্যে। প্রায় ২ কোটির বেশি শিক্ষিত যুবক-তরুণ এরা একটা দেশের শক্তি ও সম্পদ। এই সম্পদকে আমরা কাজে লাগাতে চাই। তাদের বিভিন্ন উদ্যোগে সম্পৃক্ত করতে চাই।

তিনি আরও বলেন, প্রথমাংশে থাকবে গত নির্বাচনের অঙ্গীকারের বাস্তবায়নের চিত্র এবং অগ্রাধিকার থাকবে- যেমন কৃষি, তরুণ প্রজন্ম, মাদক নির্মূলসহ বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের সুস্পষ্ট কর্মসূচি ও প্রতিশ্রুতি। সুশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারের পাশাপাশি দুর্নীতি প্রতিরোধের বিষয়টা উঠে আসবে, ইশতেহারে সামষ্টিক অর্থনীতি- অর্থাৎ দারিদ্র্য কমিয়ে নিয়ে আসা, ব্যাংক ব্যবস্থায় দুর্নীতি রোধও থাকবে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, টেকসই উন্নয়ন ও স্মার্ট জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার লক্ষ্যে নির্বাচনী নানা প্রতিশ্রুতি থাকবে। আওয়ামী লীগ সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দুর্নীতি রোধে অঙ্গীকার থাকছে ইশতেহারে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের পাশাপাশি থাকবে তরুণ প্রজন্মকে স্বনির্ভর করার পরিকল্পনাও।

তিনি আরও বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন যাত্রার পর উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় এবার স্মার্ট বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার।

২০৪১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনায় থাকছে ইশতেহারে। সেই সঙ্গে থাকছে বিদেশি নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্য। জিডিপির অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা থাকছে ৮ ভাগের উপরে। যোগাযোগ খাতের উন্নয়নে বুলেট ট্রেনের পাশাপাশি মেট্রোরেল নেটওয়ার্ক বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতিও থাকবে ইশতেহারে।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম বলেন, আমাদের যেই অনেকগুলো মেগা প্রজেক্ট বাকি আছে সেগুলো করবো এবং যে কাজগুলোর মধ্য দিয়ে দেশের জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হবে সেগুলোও থাকবে।

ইশতেহার প্রণয়ন কমিটির সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরি হবে, যা তরুণ ও যুবকদের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করবে। কাগজ যত ব্যবহার হবে পরিবেশ ক্ষতি হবে। যত ক্যাশলেস সোসাইটি হবে এর অর্থ হচ্ছে আপনি ততটাই স্মার্ট সোসাইটির দিকে যাচ্ছেন এবং সেটি অনেক বেশি ট্রান্সপারেন্ট হবে এবং অর্থনৈতিক দুর্নীতি কমবে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করে সেটি গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগের ইশতেহার হবে সর্বসাধারণের জন্য, কোন একটা শ্রেণিপেশার মানুষকে কেন্দ্র করে নয়। এর সুফল ভোগ করবে দেশবাসী।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইশতেহার হলো ক্ষমতায় গেলে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য দেশ পরিচালনার সিলেবাস স্বরূপ, যার ভিত্তিতে দলটি নির্বাচনে জয়লাভ করার পর কী করবে তার একটি পরিকল্পনা যা অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও স্বচ্ছ হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এবার আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার কমিটিতে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাককে আহ্বায়ক এবং তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদকে সদস্য সচিব করে ইশতেহার কমিটি করা হয়। যার সদস্যদের মধ্যে ছিলেন- ড. মসিউর রহমান, ড. অনুপম সেন, ড. সাত্তার মণ্ডল, ড. বজলুল হক খন্দকার, অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, ড. শামসুল আলম, ডা. দীপু মনি, ড. হাছান মাহমুদ, অ্যাডভোকেট শম রেজাউল করিম, শেখর দত্ত, ড. মাকসুদ কামাল, ড. মাহফুজুর রহমান, অধ্যাপক খায়রুল হোসেন, অধ্যাপক সাদেকা হালিম, সাজ্জাদুল হাসান, অ্যাডভোকেট তারানা হালিম, ওয়াসিকা আয়েশা খান, ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, জুনায়েদ আহমেদ পলক, ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, অধ্যাপক মোহাম্মদ এ আরাফাত, অ্যাডভোকেট সায়েম খান, সাদিকুর রহমান চৌধুরী, সাব্বির আহমেদ।

Link copied!