জুলাই ৩০, ২০২৪, ০৯:২৬ এএম
প্রতীকী ছবি
যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীকে অবশেষে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। উচ্চআদালতের রায়ে ২০১৩ সালে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। তবে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল না হলেও জামায়াত ও দলটির ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির কর্মকাণ্ড পরিচালিত করে আসছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের জোটসঙ্গী হয়ে। বিভিন্ন সময় জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি সরকারি দল আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে উঠলেও এই এক দশকে সেটা করা হয়নি।
অবশেষে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সারাদেশে নাশকতার অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এখন নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে ধর্মভিত্তিক এই রাজনৈতিক দলটিকে। কিন্তু বাংলাদেশে বিদ্যমান আইনে কোনও একক রাজনৈতিক দলকে নিষেধাজ্ঞার সুযোগ নেই।
আরও পড়ুন: জামায়াত- শিবির আগামীকালের মধ্যেই নিষিদ্ধ হচ্ছে : আইনমন্ত্রী
নতুন আইন করে জামায়াতের রাজনীতিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে দলটি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে। তারা কী করবে সেটা নিয়েও চলছে ধোঁয়াশা। যদিও জামায়াতের পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্তকে ‘বেআইনি’ ও ‘অসংবিধানিক’ বলা হয়েছে।
মঙ্গলবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত বাতিল হবে নির্বাহী বিভাগের আদেশে। খুব শিগিগিরই সরকার এই প্রক্রিয়া স্পষ্ট করবে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলেই যাত্রা শুরু করে জামায়াতে ইসলামী। তবে পাকিস্তান শাসনামল থেকে শুরু করে বাংলাদেশে বেশ কয়েকবার নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে রাজনৈতিক দল। ‘৪১’র ২৬ আগস্ট জামায়াতে ইসলামী হিন্দ প্রতিষ্ঠা হয়। দলটি পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধীতা এমনিকে ‘৪৬ নির্বাচনে মুসলিম লীগকেও সমর্থন করেনি।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উস্কানীর অভিযোগে প্রথমবার পাকিস্তানে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয় ১৯৫৯ সালে। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান প্রণিত মুসলিম পরিবার আইন অধ্যাদেশের বিরোধিতা করার কারণে ১৯৬৪ সালের ৪ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞারোপ করা হয়। যদিও তারা ১৯৬৫ সালে গণতান্ত্রিক আন্দোলেন হিসেবে সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক জোটে যুক্ত হয়।
‘৭০’র নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী পশ্চিম পাকিস্তানে চারটি আসন লাভ করে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলে জামায়াতও এর আওতায় পড়ে।
১৯৭৬ সালের আগস্টে জিয়াউর রহমান সরকার সকল ধরনের রাজনৈতিক দলের রাজনীতি উন্মুক্ত করে রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ ঘোষণা করেন। এ সময় ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি নামক একটি দলের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী যুক্ত ছিল।পরে গোলাম আযম বাংলাদেশে ফিরে এলে ১৯৭৯ সালের মে মাসে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ গঠিত হয়। এ সময় এর ভারপ্রাপ্ত আমীরের পদ লাভ করেন আব্বাস আলী খান।
২০১৩ সালের ১ আগস্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ বলে হাইকোর্ট রায় দেয়। রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল ২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর খারিজ করে দিয়েছে আপিল বিভাগ।কিন্তু সেখানেও রাজনৈতিক দল হিসেবে বাতিল করার কথা আসেনি।
১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে।জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে রাজাকার, আলবদর, আল শামস প্রভৃতি বাহিনী গড়ে তোলে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত হয়েছে ও এসব অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর অনেক নেতাকর্মীকে মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে।
ব্যক্তির অপরাধের বিচার হলেও দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের দাবি ২০১৩ সালেই গণজাগরণ মঞ্চ থেকে তোলা হয়েছিল। গোলাম আযমের মামলার রায়ে আদালত জামায়াতকে ‘ক্রিমিনাল দল’ আখ্যায়িত করার পর দাবিটি আরও জোরালো হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ নেতারাও বিভিন্ন সময়ে এর পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যে আইনে গঠিত, সেখানে দলের বিচারের সুযোগ না থাকায় বিষয়টি আটকে যায়।
গত সোমবার জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত হয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ১৪ দলের বৈঠকে। মঙ্গলবার আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, জামায়াত নিষিদ্ধের জন্য আইনি বিষয়টি ভালোভাবে দেখে সরকার পরবর্তী পদক্ষেপ শীঘ্রই নেবে; যাতে কোনও ফাঁকফোকর দিয়ে এই অপশক্তি স্বাধীন বাংলাদেশে আর কোনও সুযোগ না পায়।
আগামী বুধবারের মধ্যেই সরকারের নির্বাহী আদেশে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হবে। কোন প্রক্রিয়ায় এটি করা হবে তা ঠিক করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসবেন বলেও জানান তিনি।
এদিকে জামায়াত ইসলামীর বিচারে আইন সংশোধনের একটি খসড়া করা হয়েছিল। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ’৭১’র যুদ্ধাপরাধের জন্য দল হিসেবে জামায়াতের বিচারে আইন সংশোধনের প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদের পাঠানো হয়েছে। কিন্তু পরে সে বিষয়টি আর সংসদ পর্যন্ত যায়নি। তবে দল হিসেবে নিষেধাজ্ঞার জন্য আইনি প্রক্রিয়া খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
নতুন আইন করে কিংবা ধর্মীয় রাজনীতি নিষেধের মাধ্যমে জামায়াতকে নিষেধ করলে জটিলতা সৃষ্টি হবে বলে জানায় সুশাসনের জন্য নাগরিকের সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে আইন করতে হবে। এর আর বিকল্প দেখিনা। কেননা ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সরকারের জন্য দুষ্কর। কেননা সরকারের ১৪ দলের মধ্যেই ধর্মীয় রাজনীতি করে ‘তরিকত ফেডারেশন’। তবে তাদের ওপরও খড়্গ আসবে। এ ছাড়া হেফাজত ইসলামী ও খেলাফত মজলিসের সঙ্গেও সরকারের ভালো সম্পর্ক এখন। তাদের অখুশি করার কোনও কারণ দেখি না।
জামায়াত নিষিদ্ধ করলে রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটবে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কোন দল নিষিদ্ধ করলে তারা গোপনে কাজ করতে বাধ্য হয়ে যায়। অনেক দেশে নিষিদ্ধদলগুলো উগ্রবাদ কিংবা জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এদিকে আইন করে কোন দল নিষেধ করলে আগামীতে অন্য দলগুলো যদি নিষেধ করা হয় তাহলে কি আলাদা আইন করা লাগবে নাকি এই আইনের আওতায় থাকবে এমন প্রশ্ন থেকে যায়।
আইনের চেয়ে জাতীয় ঐক্যমতের দিকে জোর দিতে উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দল যদি নিষিদ্ধই করতে হয় তবে সব দলের ঐক্যমতের ভিত্তিতে সেটি করা উচিত। সেখানে বিএনপিসহ যারা নিবন্ধিত সকল রাজনৈতিক দলগুলোর সায় প্রয়োজন।
১৪ দলের সিদ্ধান্তের পরপরই জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে নিন্দা প্রকাশ করে। বিবৃতিতে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম। একটি রাজনৈতিক দল বা জোট অন্য একটি রাজনৈতিক দলের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। বাংলাদেশের আইন ও সংবিধান কাউকে এ এখতিয়ার দেয়নি। কোনো দল বা জোট অন্য কোনো দলকে নিষিদ্ধ করার ধারা চালু হলে এক দল অন্য দলকে নিষিদ্ধ করতে থাকবে। তখন রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা বলে কিছু থাকবে না।
এদিকে জামায়াতে ইসলামীর সংস্কারপন্থীদের নতুন দল হিসেবে ২০২০ সালেই আত্মপ্রকাশ করেছিল `এবি পার্টি`। এবি পার্টির আহ্বায়ক এ এফ এম সোলায়মান চৌধুরী ও সদস্যসচিব মুজিবুর রহমান মঞ্জু । দুই নেতাই জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণী পর্ষদ মজলিসে শুরার সদস্য ছিলেন।
জামায়াত থেকে ইস্তফা দেন দলের জ্যেষ্ঠ সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও বিশিষ্ট আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক। তিনিও উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন এই রাজনৈতিক দলে।
এবি পার্টি কি জামায়াতের বিকল্প দল কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে যুগ্ম সদস্যসচিব ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, আমরা কোন বিকল্প দল নই। তবে আমাদের আদর্শের সঙ্গে একমত হয়ে যারা রাজনীতি করতে আসবেন সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি।
যদিও এবি পার্টিতে ২০২১ সালে প্রকাশ্যে ২৫ জন যোগ দিয়েছিল। যাদের বেশির ভাগই জামায়াত-শিবিরের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্বে ছিল।