দ্য ওয়ালের সাক্ষাৎকার

বাথরুমে ৫ ঘণ্টা লুকিয়ে থাকা আর সেলফির গল্প শোনালেন ওবায়দুল কাদের

বিশেষ প্রতিবেদক

মে ২৬, ২০২৫, ০৫:৪৯ পিএম

বাথরুমে ৫ ঘণ্টা লুকিয়ে থাকা আর সেলফির গল্প শোনালেন ওবায়দুল কাদের

ছবি: সংগৃহীত

নয় মাস, অর্থাৎ ঠিক ২৭০ দিন! আবারো আলোচনায় ওবায়দুল কাদের!

এক সময় যিনি ছিলেন দেশের রাজনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রে, সম্প্রতি কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া সেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আবার হঠাৎ করে আলোচনায়।

ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য ওয়াল-এর সাক্ষাৎকারে ওবায়দুল কাদের খোলাসা করলেন এমন কিছু তথ্য, যা রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে।

কেন এ সাক্ষাৎকারে উত্তেজনা?

কেননা এতে রয়েছে, ৫ ঘণ্টার বাথরুম-ড্রামা, অচেনা ছাত্রদের আচমকা আচরণ বদল, অভিযোগ ও আত্মপক্ষসমর্থন, কাদেরের “ক্লিন ইমেজ” দাবি, শেখ হাসিনার প্রতি অনুগত অবস্থান, দলের অভ্যন্তরে উত্তপ্ত প্রতিযোগিতা এবং আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ও ক্ষমা প্রার্থনার প্রসঙ্গ প্রভৃতি।   

৫ ঘণ্টার বাথরুম-ড্রামা

“সেদিন আমার বেঁচে থাকার কথা ছিল না”শুরুটা এমনই এক বাক্য দিয়ে, যেন ৯ মাস পর ফিরে আসা এক রাজনৈতিক থ্রিলারের প্রথম দৃশ্য!

ওবায়দুল কাদেরের ভাষায়, ওই দিন ছাত্র-জনতার ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ ও ‘লুটপাটের অভ্যুত্থানে’ আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। কাদের জানান, চারদিক থেকে মিছিল আসছিল, আগুন ছড়াচ্ছিল সবদিকে। নিজের সংসদ এলাকার বাসা ফেলে তিনি সরে যান পাশের একটি বাড়িতে। কিন্তু বিপদ সেখানেও পিছু নেয়।

সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি ও আমার স্ত্রী পাঁচ ঘণ্টা বাথরুমে লুকিয়ে ছিলাম। বাইরের লোকজন ঘরে ঢুকে পড়ছিল, এমনকি বাথরুমের ভেতরের কমোড-বেসিন পর্যন্ত ভাঙচুর করছিল।’ 

অচেনা ছাত্রদের আচমকা আচরণ বদল

সবচেয়ে নাটকীয় অংশ ছিল যখন ‘‘ছাত্ররা” বাথরুমে হানা দেয়। কাদেরের ভাষায়, মুখে মুখোশ, হাতে আগ্রাসী ভঙ্গিতাদের দেখে মনে হচ্ছিল এবার শেষ! কিন্তু হঠাৎ তারা আচরণ পাল্টে ফেলে।

তিনি বলেন, “তারা বললো, ছবি তুলবো... সেলফি নিলো। কেউ কেউ আবার বললো সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেবে, কেউ চাইল জনতার হাতে...।”

তারপর তিনি বলেন, “এরপর একটা শার্ট, এদের ব্যাচ, লাল পতাকাশোভিত ব্যাচ লাগিয়ে কালো একটা, একটা মাস্ক মুখে দিয়ে আমাকে হাঁটতে হাঁটতে সংসদ এলাকা থেকে বড় রাস্তা, গণভবন অভিমুখী রাস্তায় নিয়ে যায়। ওখানে নিয়ে হঠাৎ করে কোথা থেকে একটা ট্যাক্সি আসে, একটা ইজি বাইক। সেটা খালিই ছিল। ওখানে গাড়ি-ঘোড়া কিছুই ছিল না। হঠাৎ করে কেন যেন এসে পড়লো। হয়তো আমার ভাগ্য। এরা দুইজনে আমাকে ও আমার ওয়াইফকে নিয়ে অটোতে উঠলো। আর বলতে লাগলো। পথে তো অসংখ্য মানুষ। চেকআপ চেকআপ সবজায়গায়। বলতে লাগলো আমাদের চাচা-চাচি অসুস্থ হাসপাতালে নিচ্ছি। ডিস্টার্ব করবেন না। এই করে করে নিয়ে গেল। অনেক দূরে একটা জায়গায়। এটা ভাবতেও পারিনি যে, ওরা বাথরুমে ঢুকলো, সে বেঁচে থাকাটা সেদিন পরম সৌভাগ্যের বিষয়। আনস্পেকটেডলি বেঁচে গেছি। দিস ইজ দ্য ইম্পর্ট্যান্ট।”  

অভিযোগ ও আত্মপক্ষসমর্থন

এক প্রশ্নে ওবায়দুল কাদের দাবি করেন তিনি কখনো ছাত্রলীগকে আন্দোলন দমনে নামাতে বলেননি। এই বিষয়ে ইউটিউবে যে ভিডিও ছড়িয়েছে, তা ছিল লন্ডন প্রবাসী ব্যারিস্টার নিঝুম মজুমদারের প্রচারিত একটি পুরনো ভিডিওর ওপর ভিত্তি করে। সেখানে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

কাদের বলেন, ‘আমি ছাত্রলীগকে নামাতে বলেছিএই কথাটা যে বলেছে, সে ভিডিওটা এডিট করে বলেছে। ছাত্রলীগের নামই ছিল না। নিঝুম নিজে ইউটিউবে এটা ছড়িয়েছে।’ 

কাদেরের “ক্লিন ইমেজ” দাবি

কাদের জানান, ঘটনার পর তিনি প্রায় তিন মাস দেশেই ছিলেন। তখন তিনি বিভিন্ন শ্রমিক আন্দোলন ও অসন্তোষ পর্যবেক্ষণ করছিলেন। পরে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে গেলে এবং একাধিক মামলায় আসামি হয়ে পড়লে, স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে দেশত্যাগ করেন।

‘আমি বাইপাস সার্জারির রোগী। ধরা পড়লে ওষুধ খাওয়াবে কে? তাই সিদ্ধান্ত নিই বেরিয়ে যাওয়ার’, বলেন তিনি।

তিনি স্মরণ করেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পরও তিনি কলকাতায় ছিলেন ৯ মাস। এরপর একাধিকবার ভারতে গেছেন, তবে মূলত রাজনৈতিক দায়িত্বের সূত্রে।

দীর্ঘ নীরবতার পর এই সাক্ষাৎকারে কাদের একদিকে নিজের “ভুল-ত্রুটি” স্বীকার করলেও সাফ জানিয়ে দেনতিনি কমিশন খাননি, চাঁদাবাজি করেননি। 

শেখ হাসিনার প্রতি অনুগত অবস্থান

অনেকের প্রশ্নএই ৯ মাস কোথায় ছিলেন কাদের? তিনি জানান, প্রথম তিন মাস ছিলেন বাংলাদেশেই। তারপর পরিস্থিতির চাপে বিদেশে আসেন। শেখ হাসিনার নির্দেশেই চুপ ছিলেন বলে দাবি তার। ‘‘নেত্রী বলেছিলেন, তুমি লেখালেখি করো, বিশ্রাম নাও।”

আপনার নীরবতার তাহলে কারণটা কী ছিল? এমন প্রশ্নের জবাবে কাদের বলেন, ‘আমাকে প্রধানমন্ত্রী (সাবেক) নিজেই খুঁজেছেন এবং উনি সবচেয়ে বেশি ওরিড ছিলেন আমার অসুস্থতার জন্য।’ 

দলের অভ্যন্তরে উত্তপ্ত প্রতিযোগিতা

সাক্ষাৎকারে আরেকটি চমকপ্রদ তথ্যআওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে এখন চলছে পরবর্তী সাধারণ সম্পাদক হওয়ার দৌড়ঝাঁপ। কাদের বলেন, ‘‘এই ‘কামড়াকামড়ি’, এটা অসুস্থ রাজনীতি। এখনো আমরা দেশের বাইরে। যে ক্ষমতা আমরা হারিয়েছি, সেটা কখন পাবো তা নিয়ে আমাদের ভাবা দরকার। দলে কে কী হবে, দেশে গিয়ে সেটা ঠিক করা দরকার। এখানে বসে আমরা কামড়াকামড়ি করলে তাতে আমাদেরই ক্ষতি। এখন আমাদের সবার লক্ষ্য, আমাদের দেশকে আবারও বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযুদ্ধের ধারায় নিয়ে যাওয়া।” 

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ও ক্ষমা প্রার্থনার প্রসঙ্গ

ভারত সরকার ছাড়া অন্য কোনো দেশ আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দিলো না, আবার আপনারা ক্ষমা প্রার্থনা বা দুঃখ প্রকাশ করছেন না-এ জায়গায় কোনো জেদাজেদির তৈরি হয়েছে বা আওয়ামী লীগ একঘরে হয়ে যাচ্ছে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘না আমরা কারও সঙ্গে জেদাজেদি করবো না, ভারত আমাদের দুঃসময়ের বন্ধু। সংকটে আমরা বারবার ভারতের কাছে ছুটে এসেছি। অন্য দেশের সঙ্গে আমাদের কোনো বৈরিতা নেই। আমরা কারও বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য দিচ্ছি না। কারও সমালোচনা করছি না। আমরা এখন আমাদের দেশ,  আমরা যেখান থেকে আমরা স্থানচ্যুত হয়েছি, যেখান থেকে অর্থাৎ দেশের শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছি, সেই শিকড়ে আমাদের ফিরে যেতে হবে। আমরা কারও বিরুদ্ধে নেই, কারও সমালোচনাও করিনি।’

দেশবাসীর কাছে ন্যূনতম ভুল স্বীকারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ভারতে বসে আমি কেন ক্ষমা প্রার্থনা করবো। আমি দেশে গিয়ে করবো। আমার ভুল-ত্রুটি হলে সেটার জন্য আমাদের নেত্রী আছেন। তিনিই দেশবাসীকে বলবেন, এখান থেকে কি বলা ঠিক?’ 

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর এই প্রথম গণমাধ্যমে কথা বলেছেন আওয়ামী লীগের তিনবারের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। 

Link copied!