জানুয়ারি ১৭, ২০২৫, ১২:০৮ পিএম
জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বৃহস্পতিবার বিকেলে সর্বদলীয় বৈঠক করেছেন। রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অংশীজনরা উপস্থিত ছিলেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে আয়োজিত এ বৈঠকের পর আলোচনার বিষয় নিয়ে নিজ নিজ দলের পক্ষ থেকে নানা মতের কথা তুলে ধরেছেন এতে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলের নেতারা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং আইন উপদেষ্টাও সরকারের পক্ষ থেকে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিরা সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন নিচে সংক্ষিপ্তভাবে তা তুলে ধরা হলো-
বিএনপি: প্রশ্ন তুলেছে সাড়ে পাঁচ মাস পর ঘোষণাপত্রের প্রয়োজন ছিল কিনা
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ জাতীয় ঐক্যকে গণঐক্যে রূপ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ফ্যাসিবাদবিরোধী চেতনা ধরে রাখতে হবে জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমরা বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছি। ঘোষণাপত্রকে কেন্দ্র করে যাতে জাতীয় ঐক্যে কোনো ফাটল তৈরি না হয়, সে বিষয়ে নজর রাখতে বলেছি। বিএনপি দলগতভাবে প্রস্তাবনা দিয়েছে।’ সাড়ে পাঁচ মাস পরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের কোনো প্রয়োজন ছিল কিনা, সে প্রশ্নও রাখেন বিএনপির এই নেতা।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, যদি কোনো রাজনৈতিক দলিল ঐতিহাসিক দলিলে পরিণত হয়, সেই দলিলটাকে বিএনপি অবশ্যই সম্মান করে। কিন্তু সেটা প্রণয়ন করতে গিয়ে যাতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাদের পরামর্শ নেওয়া হয়, সেই পরামর্শ দিয়েছে বিএনপি। তিনি বলেন, ‘জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী যে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে, সেই ঐক্যকে গণঐক্যে রূপান্তরিত করে সেটাকে আমরা যাতে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে চর্চা করতে পারি, সেই ঐক্যকে ধরে রেখে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি, সেটাই আমাদের এখনকার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক বক্তব্য আমরা দিতে চাই। কোনো ফ্যাসিবাদী শক্তি বা ফ্যাসিবাদের দোসরেরা যাতে আমাদের ভেতরে অনৈক্যের বীজ বপন করতে না পারে, সেদিকে আমাদের লক্ষ রাখতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা আজ আমাদের আহ্বান করেছিলেন, আমরা এসেছি, কথা বলেছি। আমরা আমাদের পরামর্শ, রাষ্ট্র পরিচালনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে যেসব চিন্তাভাবনা আমাদের দেওয়া প্রয়োজন, সেটা আমরা দিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানসম্পর্কিত ঘোষণাপত্র নিয়ে কিছু আলোচনা হয়েছে। সব রাজনৈতিক দলের নেতারা তাদের পরামর্শমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। আমরা প্রশ্ন করেছি, আসলে সাড়ে পাঁচ মাস পরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের কোনো প্রয়োজন ছিল কিনা। যদি থেকে থাকে, সেটার রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক এবং আইনি গুরুত্ব কী, সেগুলো নির্ধারণ করতে হবে। এ ঘোষণাপত্রকে কেন্দ্র করে যাতে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি না হয়, সেদিকেও আমাদের লক্ষ রাখতে হবে।’
জামায়াতে ইসলামী: সরকারকে সহযোগিতা করে যাবে
দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ গোলাম পরওয়ার বলেছেন, আমরা চার সদস্যের প্রতিনিধি এসেছিলাম। সর্বদলীয় বৈঠকে আমরা মতামত দিয়েছি। উপস্থিত সব দল জাতীয় ঐক্য ধারণ করে জুলাই ঘোষণাপত্রের ব্যাপারে সম্মত হয়েছি। সাবজেক্ট টু সাবজেক্ট আলোচনার সুযোগ আজ ছিল না। আমরা পরামর্শ দিয়েছি, যাতে কোনো অস্থিরতা এই দলিল তৈরির ক্ষেত্রে না থাকে। ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে যে চেতনা তৈরি হয়েছে, সঠিক ইতিহাস যাতে বাদ না পড়ে সে বিষয়ে আলোকপাত করেছি। সময়ের সীমাবদ্ধতার কারণে কিছু অসংলগ্নতা ছিল। আজকের বৈঠকটি ছিল প্রাথমিক একটি বৈঠক। জামায়াতে ইসলামী সরকারকে সহযোগিতা করে যাবে।
গণসংহতি আন্দোলন: দলিল তৈরিতে পদ্ধতিগত প্রস্তাব
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেছেন, কীভাবে দলিলটি হতে পারে সে বিষয়ে জানিয়েছি। ড্রাফট কমিটি করা দরকার। যেখানে সকলের মতামতকে যুক্ত করে যথাযথ সময় নিয়ে দলিলটি তৈরিতে আমরা পদ্ধতিগত প্রস্তাব দিয়েছি।
এবি পার্টি: সংবিধান সংস্কার কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া যায় কিনা প্রস্তাব
আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি) সেক্রেটারি জেনারেল আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেছেন, ‘সব দলের একমত হওয়া কঠিন। তবে প্রক্রিয়ার ব্যাপারে, উপকরণের ব্যাপারে একমত হওয়া যেতে পারে। সংবিধান সংস্কার কমিশনকে এ দায়িত্ব দেয়া যায় কিনা সে প্রস্তাব দিয়েছি।
গণঅধিকার পরিষদ: জুলাই ঘোষণাপত্র কারা লিখেছে জানতে চেয়েছে
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ রাশেদ খান বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য শুনে হতাশ হয়েছি। ৩৬ দিনের আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতন হয়নি। এর পেছনে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন হয়েছে। সেসব আন্দোলন ঘোষণাপত্রে সংযুক্ত করতে বলেছি। যে ঘোষণাপত্র দেখানো হয়েছে তা কারা লিখেছে, সে জিজ্ঞাসার কোনো সদুত্তর পাইনি। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার ও তাদের দল যাতে নির্বাচনে আসতে না পারে তা অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছি। ঘোষণাপত্রের জন্যআরেকটি জাতীয় কমিটি বা কমিশন গঠনের আহ্বান জানিয়েছি।
ইসলামি আন্দোলন: রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনতে বলেছে
ইসলামি আন্দোলনের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব কাজী আতাউর রহমান বলেছেন, ‘ছাত্রদের কেন জুলাই বিপ্লব ও ৫ আগস্টের জন্য ঘোষণাপত্রের জন্য আল্টিমেটাম দিতে হয়। সে প্রশ্ন প্রধান উপদেষ্টাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কেন দূরত্ব তৈরি হচ্ছে বর্তমান সরকারের? তার কারণ খুঁজে বের করে দূরত্ব কমিয়ে আনতে বলেছি। ঘোষণাপত্র লিখতে হলে মৌলিক জায়গায় এক হতে হবে। সেটা জানিয়েছি।’
খেলাফতে মজলিস: সংবিধান সংশোধন করতে বলেছে
খেলাফতে মজলিসের মহাসচিব আহমদ আব্দুল কাদের বলেছেন, ডকুমেন্টসে কিছু ভুল-ত্রুটি আছে। সেগুলো ঠিক করতে বলেছি। সংবিধান সংশোধন করতে বলেছি।
হেফাজতে ইসলাম: শাপলা চত্বরের ঘটনা উল্লেখ করার কথা বলেছে
হেফাজতে ইসলামের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মো. জুনায়েদ আল হাবিব বলেছেন, ‘যে খসড়া আমরা দেখেছি তাতে অনেকগুলো ‘যেহেতু’ দেখেছি। সেখানে শাপলা চত্বরের ঘটনা উল্লেখ করার কথা বলেছি। ৫ মাসের বিপ্লবের সরকারের কার্যক্রম সেভাবে দেখিনি। সেটা বলেছি।’
খেলাফতে আন্দোলন: সরকারকে সহযোগিতা করবে
খেলাফতে আন্দোলনের মহাসচিব মুফতি ফখরুল ইসলাম বলেছেন, যে ঘোষণাপত্র আসতে চলেছে আমরা তার সাথে একমত। সরকারকে সহযোগিতা করব।
এনডিএম: সকল ছাত্রদের অন্তর্ভুক্তি চেয়েছে
এনডিএম মহাসচিব মোমিনুল আমিন বলেছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বলতে আমরা বুঝি সকল ছাত্রদের অংশগ্রহণ। কিন্তু তা হয়নি। আমরা সকল ছাত্রদের অন্তর্ভুক্তি চেয়েছি।
জাতীয় নাগরিক কমিটি: কোনো ডেডলাইন নাই
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার কাছে সময় চেয়েছেন অন্যরা। সময়ক্ষেপণ যাতে না হয় প্রধান উপদেষ্টা সেদিকে লক্ষ্য রাখতে বলেছেন। আমরা ধৈর্য ধরছি। আমরা সবাই পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে আছি। কোনো ডেডলাইন নাই। তবে দ্রুত ঘোষণাপত্র হবে সে ব্যাপারে আশাবাদী।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন: অভ্যুত্থানকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতির আশা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যসচিব আরিফ সোহেল বলেছেন, ‘সরকার ১৫ তারিখের মধ্যে ঘোষণাপত্র দেবে বলে আশা করেছিলাম। তা হয়নি। তবে আজ ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। আলোচনা জারি থাকবে। আশা করি, এই অভ্যুত্থানকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দিতে পারবো।’
প্রধান উপদেষ্টা: একতাই আমাদের শক্তি
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চলমান বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সকলকে একতাবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
আসিফ নজরুল: সময় নেওয়া হবে
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, জুলাই ঘোষণাপত্রের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে। ঘোষণাপত্র আরও ফলপ্রসূ করতে আরও আলোচনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সর্বসম্মতিক্রমে ডকুমেন্টেড করতে সময় নেওয়া হবে।
এদিকে বৈঠক শুরুর আগে অনিশ্চয়তা থাকলেও শেষ পর্যন্ত বিএনপির প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধি দল বৈঠকে যোগ দেন। বৈঠকে অংশ নেয়া অন্য দলের নেতাদের মধ্যে ছিলেন- গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মুহাম্মাদ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ও সদস্য সচিব আখতার হোসেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল ও সংগঠনটির মূখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসুদ।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আব্দুল কাদেরের নেতৃত্বে তিন সদস্য, ইসলামি আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমানের নেতৃত্বে দুই সদস্য, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ূম বৈঠকে অংশ নিয়েছেন। এছাড়া যোগ দিয়েছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ মার্কসবাদীর সমন্বয়ক মাসুদ রানা ও জাতীয় গণফ্রন্টের কামরুজ্জামান।