ভিনদেশী মুক্তিবন্ধু ওডারল্যান্ড

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

মে ১৮, ২০২২, ০৬:১০ এএম

ভিনদেশী মুক্তিবন্ধু ওডারল্যান্ড

তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাপিয়ে পড়েছে পশ্চিমা হানাদাররা। এমন একটি সময়ে দামাল বাঙালিদের সাথে বহুসংখ্যক বিদেশীও আমাদের প্রাণের লড়াইয়ে শামিল হয়ে যায়। মুক্তির সংগ্রামে মুক্তিবন্ধু এই বিদেশীদের সংখ্যাও কম নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছেন—এমন বিদেশির সংখ্যা কমও নয়। তাঁদের মধ্যে একটি ব্যতিক্রমী নাম উইলিয়াম আব্রাহাম সাইমন ওডারল্যান্ড (ডব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড)। তিনিই যে আমাদের মুক্তি সংগ্রামের একমাত্র বিদেশী বীরপ্রতীক।

১৯৭১ সালে ওডারল্যান্ড টঙ্গীতে বাটা সু কোম্পানিতে প্রধান ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এই মানুষটি যুদ্ধের শুরুতেই টের পেয়েছিলেন বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা কী করতে যাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে। যখন বুঝলেন যুদ্ধ ছাড়া বাঙালির কোনো পথ খোলা নাই, নিজেই নেমে পড়েছিলেন মাঠে। গেরিলা ট্রেনিং দিয়ে সংগঠিত করার পাশাপাশি হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়া, সবই করেছেন তিনি। এসব কাজ করতে গিয়ে মানুষটি হানাদারদের হাতে শহীদ হলেও হতে পারতেন। এমনকি তার কৌশল ধরা পড়ে গেলেও জান হারাতেন। অথচ এ যুগের তরুণ-যুবকেরা একজন ওডারল্যান্ড এর নামও জানে না। চেনেও না তাঁকে।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন পরই ওডারল্যান্ড সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের। অথচ তার কোনো দায় ছিল না বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। তিনি বাটার কর্মকর্তা হিসেবে উচ্চ বেতন-ভাতা নিয়ে বেশ ছিলেন। নির্ঝঞ্ঝাট জীবন তিনি বেশ উপভোগই করছিলেন। কিন্তু নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাক বাহিনীর অন্যায় হামলা তিনি মানতে পারেননি। তিনিও যোগ দেন বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে।

বাটা সু কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে তাঁর বাংলাদেশের সর্বত্র যাতায়াতের প্রায় অবাধ সুযোগ ছিল। পূর্ব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে থাকেন যুদ্ধের সেই দিনগুলোতে। বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তার সাথে। বেসরকারি কর্মকর্তাদের সাথেও তিনি একইভাবে সখ্য গড়ে তোলেন।

এ সুযোগে তিনি সব ধরনের ‘নিরাপত্তা ছাড়পত্র’ পেয়ে যান এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তত্পরতা ও পরিকল্পনা গোপনে পাঠাতে থাকেন ২ নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টার্সে। একই সঙ্গে টঙ্গীর বাটা শু কোম্পানির কারখানা প্রাঙ্গণে স্থাপন করেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গোপন ক্যাম্প। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর কারখানায় আশ্রয় নিয়ে আশপাশে গেরিলা অপারেশন করতে থাকেন। এর পাশাপাশি অস্ত্র সংগ্রহ, চিকিৎসাসামগ্রী, আর্থিক সাহায্য প্রদানসহ নানাবিধ কাজ ও প্রশিক্ষণেও সহযোগিতা করেন।

মুক্তিযুদ্ধে এ এস ওডারল্যান্ডের ভূমিকা ছিল বহুমুখী। ১৯৭১ সালে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদেরই একজন হিসেবে। প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ তাঁর হয়নি। ১৭ বছর বয়সে জীবিকার প্রয়োজনে বাটা শু কোম্পানিতে ছোট এক চাকরিতে যোগ দেন। কিছুদিন পর নাম লেখান ‘ডাচ্ ন্যাশনাল সার্ভিস’-এ। বছর খানেক পর নেদারল্যান্ড জার্মানি কর্তৃক আক্রান্ত হয়। তখন ওডারল্যান্ড নেদারল্যান্ডের হয়ে যুদ্ধে অংশ নেন ও বন্দী হন। পরে যুদ্ধশিবির থেকে পালিয়ে যোগ দেন গোপন প্রতিরোধ আন্দোলনে। এ সময় তিনি গুপ্তচরের কাজ করেন। পরে আবার সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়ে জার্মানদের বিরুদ্ধে অসম সাহস ও বীরত্বও প্রদর্শন করেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট, জার্মানদের নৃশংসতা, বন্দিশিবিরে অবর্ণনীয় কষ্ট ইত্যাদিই ওডারল্যান্ডকে সাহসী, প্রতিবাদী ও মানবতাবাদী করে তোলে। তাঁর এই মনোভাব মনের গভীরে সুদৃঢ়ভাবে প্রোথিত ছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তাঁকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। ৫৪ বছর বয়সে তিনি আবার আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন।

সে সময় তিনি ঢাকাস্থ অস্ট্রেলিয়ান ডেপুটি হাইকমিশনের গোপন সহযোগিতা পেতেন। ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পর তিনি ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং পূর্বতন কর্মস্থলে যোগ দেন। তিনি ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করে নিজ স্বদেশভূমি অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যান। ১৮ মে ২০০১ সালে ৮৩ বছর বয়েসে তিনি প্রয়াত হন।

বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের অস্ট্রেলিয়ার পার্থ শহরে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন বাংলাদেশের মুক্তিবন্ধু বীরপ্রতীক ওডারল্যান্ড।

Link copied!