মফস্বল সাংবাদিকতার জনক কাঙাল হরিনাথ

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

এপ্রিল ১৬, ২০২১, ০৩:০৬ পিএম

মফস্বল সাংবাদিকতার জনক কাঙাল হরিনাথ

সারাজীবন অবহেলিত গ্রাম-বাংলায় শিক্ষা বিস্তার ও শোষণের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রের মাধ্যমে আন্দোলন করেছেন কাঙ্গাল হরিনাথ। অত্যাচারিত, অসহায়, নিষ্পেষিত কৃষক-সম্প্রদায়কে রক্ষার হাতিয়ারস্বরূপ সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন তিনি। বাংলা লোকসংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক হিসেবে পরিচিত বাউল সংগীতের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন সাহিত্য সাধক, সাংবাদিক কাঙ্গাল হরিনাথ।

আজ শুক্রবার (১৬ এপ্রিল) কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ১২৬তম প্রয়াণ দিবস। মফস্বল সাংবাদিকতার পথিকৃৎ এই ব্যক্তি ১৮৯৬ সালের ১৬ এপ্রিল পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমান। ১৮৩৩ সালের ২২ জুলাই কুমারখালির কুণ্ডুপাড়ায় জন্ম এই গুণী ব্যক্তির। বাংলা লোকসংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক হিসেবে পরিচিত বাউল সঙ্গীতের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন। তিনি সর্বসমক্ষে ফকির চাঁদ বাউল নামেও পরিচিত ছিলেন। কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালিতে  জন্মগ্রহণ করেন। খুব ছোটবেলায় তার পিতা-মাতা লোকান্তরিত হন। তার পিতার নাম হরচন্দ্র মজুমদার।

অর্থাভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বেশি দূর অগ্রসর হতে না পারলেও সারাজীবন অবহেলিত গ্রাম-বাংলায় শিক্ষা বিস্তারের জন্য ও শোষণের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রের মাধ্যমে আন্দোলন করেছেন তিনি।

সাংবাদিকতা

অত্যাচারিত, অসহায়, নিষ্পেষিত কৃষক-সম্প্রদায়কে রক্ষার হাতিয়ারস্বরূপ সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন হরিনাথ মজুমদার। অল্পশিক্ষা নিয়েই তিনি দারিদ্র্য ও সচেতনতা বিষয়ক লেখনি সংবাদপত্রে প্রকাশ করতেন। প্রথমে ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় লিখতেন। পরবর্তীকালে ১৮৬৩ সালের এপ্রিল মাসে কুমারখালি এলাকা থেকে ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি। মাসিক এ পত্রিকাটি কালক্রমে প্রথমে পাক্ষিক ও সবশেষে এক পয়সা মূল্যমানের সাপ্তাহিকী পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। এতে সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ক প্রবন্ধ নিয়মিত মুদ্রিত হতো।

গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা

ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট ও দেশি জমিদারদের অব্যাহত হুমকিও তাকে এ-কাজ করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি।  পত্রিকাটি অনুপ্রাণিত করেছে বিপ্লবীদের। আবার আঘাত করা হয়েছে ব্রিটিশ শাসনের মূলে। সেই সময়ের কুষ্টিয়া থেকেই বিপ্লবী বাঘা যতীনের উত্থান, জমিদার দর্পণ-এর নাট্যকার মীর মশাররফ হোসেনের ক্রমশ বিপ্লবী লেখক হয়ে ওঠা এবং লালনের বিপ্লবী ন্যাংটা বাহিনীর ইংরেজ লাঠিয়ালদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ইতিহাস। হরিনাথের সাহস আর সংগ্রামে কেঁপে উঠেছিল শাসকগোষ্ঠী, যাকে হত্যা করার জন্য ইংরেজদের ঘুম হারাম হয়ে যায়, তার লেখনীই বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।

অত্যাচার-জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার পাশাপাশি হরিনাথ সে সময় ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’কে ঘিরে লেখক গোষ্ঠী তৈরি করেন। ফলে এ পত্রিকার মাধ্যমে ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, সাহিত্যিক রায় বাহাদুর জলধর সেন, দীনেন্দ্র কুমার রায়, মীর মশাররফ হোসেন, শিবচন্দ্র বিদ্যানর্ব প্রমুখ সাহিত্যিক সৃষ্টি করে গেছেন হরিনাথ। হরিনাথের স্নেহধন্য প্রখ্যাত সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন রচিত বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী সার্থক উপন্যাস ‘বিষাদ সিন্ধু’ হরিনাথের এমএন প্রেস থেকেই প্রথম প্রকাশিত হয়। লালন সাঁইজীর ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’সহ মোট ২১টি গান সর্বপ্রথম মুখের শব্দ থেকে কাগজে ছাপার অক্ষরে ঠাঁই পায় কাঙ্গালের এমএন প্রেসের মুদ্রণে।

বাউল সঙ্গীত

দীর্ঘ আঠারো বছর গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা সম্পাদনা করার পর সাংবাদিকতা পেশা পরিত্যাগপূর্বক ধর্ম সাধনায় মনোনিবেশ করেন তিনি। হরিনাথ মজুমদার আধ্যাত্মিক গুরু ও মহান সাধক ফকির লালনের গানের একান্ত অনুরাগী ছিলেন। বাউল সঙ্গীতকে সামাজিক জীবনধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার মানসে ঊনবিংশ শতকে যে কয়েকজন সাহিত্য সাধক সাহিত্যে নিয়োজিত হয়েছিলেন, কাঙ্গাল হরিনাথ তাদের মধ্যে অন্যতম। যে যুগে হরিনাথ সাহিত্য সাধনা করেন সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তার ভাষা ও কল্পনার যুক্তভঙ্গি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক কালজয়ী অধ্যায়। ১২৮৭ সালে ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় মহাশয়ের অনুপ্রেরণায় ও রায় জলধর সেন প্রত্যক্ষ আগ্রহ আর সহযোগিতায় ‘ফিকির চাঁদ ফকিরের দল’ গঠনের মাধ্যমে বাউল গান রচনা, প্রসার-প্রচারের যাত্রা শুরু করেন। বাউল গানের দল গঠনের অনুপ্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন লালন সাঁইজীর কাছে। কাঙ্গাল হরিনাথ ছিলেন লালন সাঁইজীর ভাবশিষ্য।

মানবিক মূল্যবোধের চর্চার কারণেই তিনি উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের শেষ পর্যায়ের পূর্ব বাংলার সমসময়ের হিন্দু ও মুসলিম মৌলবাদের নিন্দা করেছেন। হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক বিদ্বেষ স্বাভাবিকভাবেই তাকে বিচলিত করেছিল।

গানও মুক্ত নয়, তবু কখনো-কখনো এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তাতে শিল্প-সৌন্দর্য আবিষ্কার করা চলে। আবার তার সৃষ্টি গানগুলোতে আধ্যাত্মিকতায় ভরপুর ছিল। গান রচনায় তিনি অসম্ভব পারদর্শিতা ও পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেন। স্বলিখিত গানে কাঙ্গাল ভণিতার ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষণীয় ছিল। তার রচিত বাউল সংগীতগুলো ফকির চাঁদের বাউল সঙ্গীত নামে সুপ্রসিদ্ধ ছিল। ধর্ম সাধনার অঙ্গরূপে তিনি বহু সহজ-সুরের গান রচনা করে সদলবলে সেই গান গেয়ে বেড়াতেন।

“হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো/পার করো আমারে/তুমি পারের কর্তা জেনে বার্তা/তাই ডাকি তোমারে/আমি আগে এসে/ঘাটে রইলাম বসে /যারা পাছে এলো আগে গেল/আমি রইলাম পড়ে/শুনি কড়ি নাই যার /তারে তুমি কর পার/আমি দীনভিখারি নাইকো কড়ি/দেখো ঝুলি ঝেড়ে/আমার পারের সম্বল/তোমার নামটি কেবল/কাঙ্গাল ফিকিরচাঁদ কেঁদে/অকুল পাথারে সাঁতারে ॥” এই গানটি কাঙ্গাল হরিনাথের অন্যতম সৃষ্টি।

কাঙ্গাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘর

নতুন প্রজন্মের কাছে কাঙ্গাল হরিনাথের স্মৃতিকে তুলে ধরতে ২০১৭ সালের ৫ ডিসেম্বর জাদুঘর নির্মাণ করে সরকার। কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার গড়াই নদীর তীরবর্তী  কুন্ডুপাড়ায় অবস্থিত এ জাদুঘর। জেলাশহর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১৬ কিলোমিটার। লাল ইট আর মোজাইক টাইলসের কারুকাজে নির্মিত একটি ভবন। বাহারি ফুলের বাগানে ঘেরা ভবনটির নাম কাঙ্গাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘর। ভেতরে পরিপাটি করে সাজানো কয়েকশ’ বছর আগের ছাপানো পত্রিকা, লেখা কবিতা ও ছবিসহ নানা স্মৃতিচিহ্ন।

রচনা সমগ্র

তার মুদ্রিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৮টি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে-

বিজয় বসন্ত (১৮৫৯), চারু-চরিত্র (১৮৬৩), কবিতা কৌমুদী (১৮৬৬), কবিকল্প (১৮৭০), অক্রুর সংবাদ (১৮৭৩), চিত্তচপলা (১৮৭৬),

কাঙ্গাল-ফিকির চাঁদ ফকিরের গীতাবলী (১২৯৩-১৩০০ বঙ্গাব্দ). দক্ষযজ্ঞ, বিজয়া, পরমার্থগাথা, মাতৃমহিমা, ব্রহ্মা-বেদ।

প্রভাব

কাঙ্গাল হরিনাথের বাউলগান তার সমকালে সমগ্র বাংলাদেশকে আলোড়িত করতে সমর্থ হয়েছিল। কাঙ্গালের গান জনচিত্তে বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছিল। হরিনাথের গানগুলো অনেক লেখক, সঙ্গীত বোদ্ধাদের মন জয় করে ও ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে। তন্মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অন্যতম। আমৃত্যু বঙ্গদেশে শিক্ষার প্রসার ও সর্বপ্রকার শোষণের বিরুদ্ধে অবস্থান করেছিলেন তিনি। সাহিত্যকর্মে তার সুযোগ্য শিষ্যগণের মধ্যে- অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, দীনেন্দ্রনাথ রায়, জলধর সেন প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ পরবর্তী জীবনে যথেষ্ট খ্যাতি ও সুনাম অর্জন করেছিলেন।

প্রয়াণ

প্রকৃতপক্ষে বিষয়বৈচিত্র্য ও শিল্প-চেতনায় কাঙ্গালের মরমি বাউলগান সংগীত-সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করেছে এবং সেইসঙ্গে বলা যায়, কালান্তরেও এই গানের আবেদন নিঃশেষিত হয়নি। হরিনাথের জীবন শুরু হয়েছিল সাহিত্যচর্চা, সাময়িকপত্র-সম্পাদনা, শিক্ষাপ্রসার ও সমাজহিতব্রতের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে। লালন ফকিরের সখ্য-সাহচর্যে এসে তার জীবনে যুক্ত হয় মরমি ভাবসাধনার ধারা এবং সেই সূত্রে বাউলগান রচনার পর্ব। এক সময়ে লালন ও তার পথ এসে একটি মিলনবিন্দুতে মেশে মূলত বাউলগানের অনুষঙ্গে। ১৬ই এপ্রিল, ১৮৯৬ সালে এই ক্ষণজন্মা লেখক, শিক্ষানুরাগী ও সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব পরলোকগমন করেন।

 

Link copied!