ভারতের সিনেমাজগতে মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির বিপরীতে অন্য ধরনের ছবির একটি সমান্তরাল ধারা নির্মাণের জন্য মৃণাল সেনের নাম সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটকের সাথে একত্রে উচ্চারিত হয়। কিন্তু শিল্পদৃষ্টি ও চিন্তাভাবনার দিক দিয়ে এরা প্রত্যেকেই ছিলেন একে অন্যের চেয়ে আলাদা। কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য মৃণাল সেন ছিলেন অনন্য।
শৈশবের রাজনৈতিক পরিবেশ, যৌবনে কমিউনিস্ট পার্টি এবং ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সাথে ওঠাবসা এবং ব্যাপক পড়াশোনা মৃণাল সেনকে গোড়া থেকেই একজন রাজনীতিসচেতন মানুষ ও অঙ্গীকারবদ্ধ শিল্পী হিসেবে গড়ে তোলে।
মৃণাল সেন ফরিদপুরের ছেলে। পড়াশোনা করতে কলকাতা গিয়েছিলেন। সেই যে কলকাতার প্রেমে পড়া, আর ফেরেননি।
শুধু তো লেখাপড়া নয়, জড়িয়ে পড়লেন অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে। দেশের দারিদ্র্য, বৈষম্য দেখে দেখে ফুঁসছিলেন। নিজের ভেতর জ্বলছিল আগুন। সে আগুন কী করে বাইরে আনেন? নাটক, গান তো আছে, আর কী করা যায়? তখনই আরেকবার প্রেমে পড়া। মৃণাল প্রেমে পড়লেন চলচ্চিত্রের।
প্রথম ছবি ‘রাতভোর’ (১৯৫৬) থেকে ‘আমার ভুবন’ (২০০২) পর্যন্ত তিনি ৩০টি ছবি তৈরি করেছেন। এই দীর্ঘ সময়ে, সময়ের সঙ্গে বদলেছে তাঁর ছবির বিষয়বস্তু, পাল্টেছে আঙ্গিক, পরিবর্তিত হয়েছে পটভূমি। পঞ্চাশের দশকে যে জায়গা থেকে শুরু করেছিলেন, সেখানে থেমে থাকেননি তিনি। নিরন্তর সামনে এগিয়েছেন, কোনো বৃত্তে আবর্তিত হননি।
ষাটের দশকের শেষার্ধ থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে যে তোলপাড় শুরু হয়, তার ঢেউ লাগে সমাজে, শিল্পে, সাহিত্যে। এটি ছিল এমন এক সময়, যখন রাজনীতিকে অস্বীকার করে কিছু বলা যায় না, করা যায় না, কোনো মহৎ শিল্প সৃষ্টি করা যায় না। সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালকও তখন রাজনৈতিক বিষয়বস্তু নিয়ে ছবি করেছেন—‘প্রতিদ্বন্দ্বী’। মৃণাল সেনও এ সময়েই পরিচালক হিসেবে রাজনৈতিক পর্বে প্রবেশ করেন। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ তৈরি করার পর সত্যজিৎ আবার ফিরে যান তাঁর অরাজনৈতিক বলয়ে। কিন্তু মৃণাল সেন আর পেছন ফেরেননি।
সিনেমা নিয়ে মৃণাল সেনের নিরীক্ষা আর ভাঙা-গড়ার খেলা চলতে থাকে। চলচ্চিত্রকার হিসেবে মৃণাল সেন কিংবা তাঁর চলচ্চিত্র ক্রমেই রাজনৈতিক হয়ে ওঠে। পরপর তিনি তিনটি ছবি করে ফেলেন। ‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’ ও ‘পদাতিক’।
কলকাতার সে সময়ের উত্তাল দিনগুলোর ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে ছবিগুলোতে। প্রশংসা যেমন পান, তেমনি পেয়েছেন সমালোচনাও। তবে সবকিছু ছাপিয়ে মৃণাল সেন চলচ্চিত্রকার হিসেবে হয়ে উঠলেন দারুণভাবে আলোচিত।
আজ ১৪ মে এই কিংবদন্তী চলচ্চিত্রকারের শততম জন্মদিন। এই উপমহাদেশের সিনেমাজগতে মৃণাল সেনের চেয়েও বড় ও মেধাবী পরিচালকের জন্ম হয়তো হবে, কিন্তু তাঁর স্থান পূরণ হবে না।