‘ভিয়েতনামের মানুষের সঙ্গে আমার কোনো ঝগড়া নেই। শুধু সাদা চামড়ার মানুষের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য ১০ হাজার মাইল দূরের কোনো দেশে গিয়ে মানুষের ওপর অত্যাচার করা, খুন করা, বোমা ফেলা এই কাজে আমি যুক্ত হব না। পৃথিবীর বুকে এসব অবিচার বন্ধ হওয়া উচিত।’
কথাগুলো বলছিলেন এমন একজন মানুষ, যাঁর ছিল মানবতার প্রতি ভালোবাসা, খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারে জেনেও তিনি এই কথাগুলো বলেছিলেন। দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। খেলার লাইসেন্স সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ হয়েছিল। গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। তার পরও মানবতার বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো কাজ করেননি। মানুষটি আমাদের সবার প্রিয় বক্সার মোহাম্মদ আলী। তিনি বলতেন, কখনো দিনকে গুনতে যেও না। এমন কিছু কর যেন দিনই তোমাকে মনে রাখে।
বক্সিং কিংবদন্তি মোহাম্মদ আলী ওরফে ক্যাসিয়াস ক্লে সংগ্রামী জনগণের প্রতিভূ হিসেবে সারা বিশ্বেই মোহাম্মদ আলী পরিচিত। তার কিংবদন্তিতুল্য বক্সিং ম্যাচগুলোর পাশাপাশি নিপীড়িত মানুষের পক্ষে সোচ্চার থাকার জন্য সমগ্র বিশ্বই মোহাম্মদ আলীকে স্মরণ করবে বহুকাল। এ কারণেই তিনি কখনো দিন গোনেননি, দিন-কাল-মহাকাল তাকে যাতে স্মরণে রাখে, সেই কীর্তিই গড়ে গেছেন গোটা জীবন জুড়ে।
আর দশটা সাধারণ ছেলের মতোই ছিল তার শৈশব। বাবার কাছ থেকে একটা লাল সাইকেল উপহার পেয়ে সেটা নিয়েই ঘুরে বেড়াতেন ১২ বছর বয়সী আলী। কিন্তু একদিন বন্ধুদের সাথে আড্ডাশেষে ফেরার সময় দেখেন, সাইকেলটা কেউ চুরি করে নিয়ে গিয়েছে। সেই চোরকে শায়েস্তা করার জন্য তিনি প্রতিবেশী জো মার্টিনের কাছে গেলেন, যিনি পুলিশ অফিসার ছিলেন। সেই পুলিশের পরামর্শেই চোরকে শায়েস্তা করার জন্য শিখেন বক্সিং।
একটা সময় মনে হতো, আলী নিজেই বক্সিং বা বক্সিং নামের খেলাটার সমার্থক। ইতিহাসের উন্মাতাল সেই সময়কাল—সত্তর থেকে আশির দশক। যখন ভিয়েতনামে রক্ত ঝরছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়ন—দুই বড় শক্তির স্নায়ুযুদ্ধ ঘোর কালো ছায়া ফেলেছে পৃথিবীর প্রতিটি কোণে। তখন এ-ও মনে হতো, মোহাম্মদ আলী মানে মোহাম্মদ আলী ক্লে, ওরফে ক্যাসিয়াস ক্লে না থাকলে বক্সিং খেলাটাই ধরণি থেকে বেমালুম লোপাট হয়ে যাবে। তা অবশ্য হয়নি। মোহাম্মদ আলী ৩২ বছর ধরে পারকিনসন্স রোগের কাছে ন্যুব্জ থাকার পরও বক্সিং টিকে আছে। টিকেই আছে আসলে।
এ বাক্যটির সমর্থনে একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। তিনটি বিশ্ব বক্সিং সংগঠনের বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন এখন যুক্তরাজ্যের অ্যান্টনি জোসুয়া, যুক্তরাষ্ট্রের ডিওন্টে ওয়াইল্ডার ও যুক্তরাজ্যের টাইসন ফিউরি। প্রথমজন আন্তর্জাতিক বক্সিং ফেডারেশনের, দ্বিতীয়জন ওয়ার্ল্ড বক্সিং কাউন্সিলের, তৃতীয়জন ওয়ার্ল্ড বক্সিং অ্যাসোসিয়েশনের। কজন এদের নাম জানেন? আর আলী যখন ১৯৬৪ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে সনি লিস্টনকে হারিয়ে বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হলেন, আলোড়িত হলো গোটা বিশ্ব।
১৯৭৪ সালে সেই সময়কার জায়ারে আর অধুনা কঙ্গো রিপাবলিকে ‘রাম্বল ইন দ্য জাঙ্গল’খ্যাত লড়াইয়ে জর্জ ফোরম্যানকে নকআউট করে যখন চ্যাম্পিয়ন হলেন, রীতিমতো সুনামি বয়েছিল এই গ্রহে। ১৯৭৩ সালে কেন নর্টনের কাছে শিরোপা খুইয়ে ওই বছরই সেটি পুনরুদ্ধার করেন। তখন থেকেই আলী বক্সিংয়ের অলংকার। আর ১৯৭৫ সালে যখন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী জো ফ্রেজিয়ারকে ম্যানিলায় ‘থ্রিলা ইন ম্যানিলা’য় নকআউট করে শোধ নিলেন ১৯৭১ সালের হারের, তিনি ‘ব্ল্যাক সুপারম্যান’—যাকে হারানো যায় না।
সেই প্রমাণ তিনি তিন বছর পরও দিয়েছেন, ১৯৭৮ সালে লিওন স্পিংকসের কাছে খেতাব হারানোর ছয় মাসের মধ্যেই সেটি পুনরুদ্ধার করে। তিনি সর্বোচ্চ তিনবারের হেভিওয়েট বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। তিনবার খেতাব খুইয়েও তা পুনরুদ্ধার করেছেন। বক্সিংকে রাঙিয়ে দিতেই যেন তার আবির্ভাব ঘটেছিল খেলাটির ‘আলোর ঈশ্বর’ হয়ে। হেভিওয়েট বক্সিং কতটা আলী প্রভাবিত, তা পরিষ্কার ছোট্ট এই পরিসংখ্যানেই—৬১টি বাউটে হেরেছেন মাত্র পাঁচবার। ৩৭টি বাউটেই ভূপাতিত করেছেন প্রতিপক্ষকে।
১৯৭৯ সালে বক্সিং থেকে অবসর নিয়ে দ্রুতই সেটি ভেঙে আবার রিংয়ে ফেরেন ১৯৮০ সালে। তখন তার বয়স ৩৮, আর চ্যালেঞ্জার ল্যারি হোমসের ৩১। তত দিনে ক্ষিপ্রতা হারিয়ে ফেলেছেন, সেই ভয়ংকর লেফট হুক হারিয়ে গেছে, রাইট জ্যাবেরও ধার নেই। প্রজাপতিনৃত্য তো অতীতের স্মৃতি। তবু মানুষ মনে করেছিল, আলীই জিতবেন, তিনি যে অজেয়! কিন্তু এক হেমন্তের বিকেলে হোমস নির্মমভাবে হারিয়ে দিলেন আলীকে। জয়ের পর হোমস লকাররুমে গিয়ে নীরবে কেঁদেছিলেন। চিরবিজয়ী আলীকে যে এভাবে হারতে দেখতে চাননি তিনি! ১৯৮১ সালে জীবনের শেষ বাউটটিতেও হেরেছেন, জ্যামাইকার ট্রেভর বারবিকের কাছে। ওই বছরই চিরবিদায় জানিয়েছেন বক্সিং রিংকে। মস্তিষ্কের বৈকল্যজনিত রোগ পারকিনসন্স তাকে রিংয়ে আর নামতে দেয়নি। সারা জীবন প্রতিপক্ষের যত আঘাত সয়েছেন, সেটির মূল্য না চুকিয়ে পারেননি।
বক্সিং রিংয়ে প্রজাপতিনৃত্য, মৌমাছির হুল ফোটানো ক্ষিপ্রতা, যুদ্ধ ও আগ্রাসনবিরোধী মানবতাবাদ, প্রতিপক্ষকে কথার তিরে বিদ্ধ করা বাকপটুতা, বক্সিংয়ের বুনো আদিমতাকে শিল্পে রূপ দেওয়ার ক্ষমতাকে অ্যারিজোনার ফিনিক্স এরিয়া হাসপাতালে চিরতরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেলেন ২০১৬ সালের ৩ জুন। তবে পেছনে রেখে গেছেন ১৯৭১ সালের ‘শতাব্দীসেরা লড়াই’, ১৯৭৪ সালের ‘রাম্বল ইন দ্য জাঙ্গল’ ১৯৭৫-এর ‘থ্রিলা ইন ম্যানিলা’র মতো দুনিয়া কাঁপানো অজস্র গল্প।