আব্দুর রাজ্জাক: না লিখেও জ্ঞানতৃষ্ণা মেটানো এক দুরন্ত শিক্ষক

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

নভেম্বর ২৮, ২০২১, ১১:১৭ পিএম

আব্দুর রাজ্জাক: না লিখেও জ্ঞানতৃষ্ণা মেটানো এক দুরন্ত শিক্ষক

পরপর দুবার বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক থাকা আব্দুর রাজ্জাক বেশিরভাগ মানুষের কাছেই দুর্ভেদ্য এবং রহস্যময়। কেননা জীবদ্দশায় যে পরিমাণ জ্ঞান আহরণ করেছেন, তার সিকিভাগ তো দূরের কথা শতভাগের একভাগও লিখে যাননি। তিনি লিখে রেখে যাননি। একারণে, তার দর্শন, মতবাদ, চিন্তাচেতনা কিংবা পান্ডিত্যের কোন চিহ্ন পর্যন্ত পাওয়া যায় না খুব একটা। কেবল তার শিক্ষকতা এবং শিক্ষকতার বাইরে ব্যক্তিগতভাবে যারা তার সান্নিধ্য লাভ করেছেন তারাই জানেন এবং জানাবার চেষ্টা করেছেন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক কতটা মহান ব্যক্তি এবং জ্ঞানী দার্শনিক ছিলেন।

অধ্যাপক রাজ্জাক কেন লিখেননি তা নিয়ে খুব একটা তথ্য পাওয়া যায়না। আব্দুর রাজ্জাকের সান্নিধ্যে যারা এসেছেন তাদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে অনেকে বেশ বিখ্যাত ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন বিশেষ করে ড. কামাল হোসেন, ড. হোসেন জিল্লুর, সলিমুল্লাহ খান এবং আরও অনেকে। কিন্তু তারাও খুব একটা এব্যাপারে জানাননি কিছু। কেবল আব্দুর রাজ্জাককে গুরু বলে মান্য করা আহমদ ছফা এবং সরদার ফজলুল করিম এবং সলিমুল্লাহ খানের লেখায় কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

আব্দুর রাজ্জাক না লিখলেও তার পাণ্ডিত্য নিয়ে কারো কোন সন্দেহ ছিল না। এপ্রসঙ্গে দু-একটি তথ্য দিয়ে রাখি। আব্দুর রাজ্জাক কতবড় মাপের জ্ঞানী, দার্শনিক ছিলেন সেটার একটা ছোট্ট প্রমাণ পাওয়া যায় লেখক-সাংবাদিক খুশবন্ত সিং সম্পাদিত 'ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া' এর একটি আর্টিকেল থেকে। সেখানেও আব্দুর রাজ্জাককে ‘এশিয়ার ডায়োজেনিস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ও ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করেছিল। আব্দুর রাজ্জাক পিএইচডি করতে গিয়েছিল বিখ্যাত ইংলিশ তাত্ত্বিক অর্থনীতিবিদ হ্যারল্ড লাস্কির অধীনে। কিন্তু পিএইচডি বাদ দিয়ে মাঝপথে দেশে ফিরে এসেছিলেন। স্বাধীনতার আগে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাসিক ৯০০ টাকা বেতনের চাকরির অফার অবলীলায় ত্যাগ করেছিলেন কেবল দেশে থাকার জন্য। যে দেশের জন্য এত টান সেই দেশের জন্য কেন তিনি লিখে যাননি সেটাই এক বিরাট রহস্য।  

লিখতে না পারলেও আলাপে অধ্যাপক রাজ্জাক সরেস ছিলেন। তবে তিনি তার শিক্ষকতা জীবনে ব্যাপক খাবি খেতেন। এপ্রসঙ্গে, সরদার ফজলুল করিমের সাথে আলাপচারিতায় আব্দুর রাজ্জাক স্যার বলেছিলেন, "আমাদের ইউনিভার্সিটিতেও প্রথম ছয়মাস আমি কোন ক্লাস নিতে পারতাম না। পাঁচ মিনিট-দশ মিনিটের বেশি ক্লাসে থাকতে পারতাম না। পড়া একেবারে মুখস্থ কইরা যাইতাম। তবু ক্লাসে যাইয়া মনে থাকতো না। চেষ্টা করতাম কিন্তু মোটের উপর একেবারেই বক্তব্য দিবার পারতাম না।" কিন্তু পরে এই আব্দুর রাজ্জাকই অসাধারণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। এক মহীরুহ হয়ে উঠেছিলেন। যার ছায়ায় সমৃদ্ধ হয়েছেন অনেকে।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো নিযুক্ত হয়েছিলেন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। 

আজীবন ক্লাসে ভালো করে না পড়িয়ে, কোন কিছু না লিখেও যে কেবল আড্ডা, আলাপচারিতা দিয়ে একটা মানুষ এমন দূর্দান্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেন সেটা এক বিরল ঘটনা। আব্দুর রাজ্জাকের আলাপচারিতা, আড্ডায় বলা প্রত্যেকটা কথাই ইনসাইটে পরিপূর্ণ। এপ্রসঙ্গে ছফা বলেছিলেন যে, আব্দুর রাজ্জাক স্যার ছফাকে কোন বিষয়ে ইন্টারেস্টেড বা আগ্রহী করে তোলার জন্য সে বিষয়ক বিভিন্ন বই পত্র তার সামনে নাড়াচাড়া করতেন। এরকম একটা গল্প 'যদ্যপি আমার গুরু'তে ছফা বলেছিলেন।

এত কিছুর পরও আব্দুর রাজ্জাক লিখে যাননি কোন কিছুই। তার একাধিক শুভাকাঙ্ক্ষীর বারবার তাগিদ সত্বেও। এবং, আমাদের এই আলোচনা তিনি কেন লিখেননি সেই বিষয়ের উপরই সীমাবদ্ধ থাকবে।

অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের লেখা যে একেবারে নেই তা নয়। একটি অসমাপ্ত বই, দশ-বারোটা চিঠি, অল্প কয়েকটা ছুটির দরখাস্ত, কিছু সুপারিশনামা-আর্জি, একটা বক্তৃতা আর আনুমানিক ছয়-সাতটা ইন্টারভিউ ছাড়া পি.এইচ.ডি ডিগ্রির জন্যে লেখা থিসিস ‘Political Parties in India’, আর প্রবন্ধ ‘পাকিস্তান মিলিটারি (The Military in Pakistan)’ এবং ‘বাংলাদেশ: একটা জাতির অবস্থা (Bangladesh: State of a Nation)’-এই হলো তার লেখালেখির জীবন। তার ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচর্য অধ্যাপক মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী স্মরণে তিনি একটি বক্তৃতা দেন তিনি। যা পরে ‘Bangladesh: State of the Nation’ নামের বইয়ে রুপান্তর করা হয়।

তার লেখালেখির এই নিরুৎসাহ দৃষ্টিভঙ্গি এবং নিস্পৃহ মনোভাব প্রসঙ্গে অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান আহমদ ছফাকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন, “নিষ্কাম জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে, দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা নির্মাণে আর প্রচলিত জনমত উপেক্ষা করিয়া আপন বিশ্বাসের উপর স্থির থাকিবার ব্যাপারে আবদুর রাজ্জাক অদ্বিতীয় ছিলেন।”

সলিমুল্লাহ্ খান আহমদ ছফাকে উদ্ধৃত করে অধ্যাপক রাজ্জাক কেন লিখেননি সে বিষয়ে দুটো কারণ উল্লেখ করেছেন। সলিমুল্লাহ খান একটি নিবন্ধে লিখেছেন, "অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক একটা থিসিস (আগেই বলেছি, তিনি হ্যারল্ড লাস্কির অধীনে পিএইচডি করতে ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন) লিখিয়াছিলেন। ১৯৫০ সালে উহা শেষ না করিয়াই তিনি ইংরেজভূমি হইতে বঙ্গদেশে ফিরিয়া আসেন। অনেক পরে ১৯৮০ সালে তিনি তাঁহার ছাত্র মোজাফফর আহমেদ চৌধুরীর নামে একটা বক্তৃতা লিখিয়াছিলেন। ইহা ছাড়াও তাঁহার আরো ছোটখাট লেখা থাকিতে পারে। কিন্তু সেইগুলি আজি পর্যন্ত এক জায়গায় করা হয় নাই। তাই লোকে বলে তিনি বিশেষ লেখেন নাই। ছফা বলিয়াছেন ইহার কারণ দুই হইতে পারে। অনেক সময় উৎকৃষ্ট বীজ পাথরে পড়িয়া নষ্ট হয়। ছফা সাহেবের ধারণা রাজ্জাক সাহেবের বেলায় তাহাই ঘটিয়াছে। ১. দেশ ও কাল তাঁহার সহায় হয় নাই। ২. আরেকটা কারণ—রাজ্জাক সাহেবের মানসিক উন্নতি। সেই কালের বামনদের স্তরে তিনি নামিতে পারেন নাই। ছফা শুদ্ধ দুইটা উদাহরণ দিয়াছেন: রাজ্জাক সাহেব যৌবনে ট্রটস্কি নামা রুশীয় দার্শনিক রাজপুরুষের চিরস্থায়ী এনকেলাব (পারমান্টে রেভুলুশন) শীর্ষক বহিও তর্জমা করিয়াছিলেন। আর এদিকে বাংলাভাষায় লেখা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশি পুস্তিকা বাংলার ব্রত ইংরেজিতে লিখিয়াছিলেন।" (যদ্যপি আমার গুরু; সলিমুল্লাহ খান, ২০০৯)

সলিমুল্লাহ খান আরও বলছেন, “১৯৪০ সালের দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অবস্থা এবং উপমহাদেশের ব্রিটিশ শাসনের শেষ সময়ে অনেক মুসলমান বুদ্ধিজীবীর ন্যায় তিনিও পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। নাজীর আহমেদ সহ আরো অন্যান্যদের সাথে মিলে ‘পাকিস্তান’ নামে একটি স্বল্পায়ু পত্রিকা প্রকাশ করেন।” (খান, সলিমুল্লাহ, ২০০৯)

নিচের উদাহরণ হতে আব্দুর রাজ্জাকের না লেখার যে কারণগুলো ছফা উল্লেখ করেছিলেন তার সমর্থন পাওয়া যায়। ১৯৫০ সালে লন্ডনের স্কুল অফ ইকোনমিক্সে আব্দুর রাজ্জাক তার গবেষণা সন্দর্ভ জমা দেবার আগেই প্রফেসর লাস্কির মৃত্যু হয়। লাস্কির মতো শিক্ষকের মৃত্যুতে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক প্রচন্ড মর্মাহত হন এবং গবেষণাকর্মে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। লাস্কির মৃত্যুর পর কর্তৃপক্ষ নবীন অধ্যাপক মরিস জোন্সকে তার সুপারভাইজার হিসেবে নিযুক্ত করে। থিসিসের কাঠামোর সাথে মরিস জোন্সের মতানৈক্য দেখা যাচ্ছিল। আর তাছাড়া অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের নিজের পান্ডিত্য এবং মেধার ওপর ছিলেন আস্থাশীল এবং আত্মবিশ্বাসী। এর সাথে প্রিয় শিক্ষকের মৃত্যু মিলিয়ে থিসিসের কাজ শেষ পর্যায়ে এনেও তিনি সিদ্ধান্ত নেন থিসিস জমা না দেয়ার।

তারপরও বন্ধুবান্ধবের অনুরোধে তিনি থিসিস জমা দেন, কিন্তু পরীক্ষকগণ থিসিসের ফুটনোট সুসংবদ্ধ নয় বলে অভিযোগ তোলেন এবং তা পুনরায় ঠিক করে জমা দেয়ার আহবান জানান। কিন্তু আব্দুর রাজ্জাক সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখান করে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন।

যে ভদ্রলোক ট্রটস্কির মতে তাত্ত্বিকের লেখা বাংলা করার সাহস দেখান, যিনি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইংরেজি লেখা বাংলা করার সাহস দেখিয়েছিলেন তিনিই কিনা আর লিখলেন না। সুতরাং, দক্ষতা বা যোগ্যতা কিংবা পাণ্ডিত্যের অভাব নয় বরং মানসিক ও নৈতিক উৎকর্ষ, ব্যক্তিগতভাবে কাউকে তোষামোদ না করার মানসিকতা এবং তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়েই তিনি লিখেননি।

১৯১৪ সালে জন্ম নেওয়া এই মহীরুহ ১৯৯৯ সালের ২৮ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।

Link copied!