এক অকুতোভয় বিপ্লবী রবীন্দ্র নিয়োগী

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

এপ্রিল ২৯, ২০২১, ০১:৪১ এএম

এক অকুতোভয় বিপ্লবী রবীন্দ্র নিয়োগী

বিপ্লবী রবীন্দ্র চন্দ্র নিয়োগী ১৬ বৈশাখ ১৩১৬ বঙ্গাব্দ, ২৯ এপ্রিল ১৯০৯ সালের বৃহস্পতিবার শেরপুর শহরের গৃদানারায়ণপুর (পুরাতন গরুহাটী) এলাকায় এক বিখ্যাত জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ‘বিপ্লবী রবি নিয়োগী’ নামে জন-মানুষের কাছে কিংবদন্তীতুল্য। বাড়ির নাম ‘নিয়োগী লজ’। তার পিতার নাম রমেশ নিয়োগী ও মাতা সুরবালা নিয়োগী। রবি নিয়োগীরা ছিলেন ১১ ভাইবোন। বৃটিশবিরোধী এই বিপ্লবী তার ৯২ বছরের জীবনে ৩৪ বছরই জেলে কাটিয়েছেন। 

শেরপুর ভিক্টোরিয়া একাডেমিতে রবি নিয়োগীর শিক্ষা জীবন শুরু হয়। পরে গোবিন্দপুর পিস মেমোরিয়াল হাইস্কুল (বর্তমানে জি. কে পাইলট স্কুল) ভর্তি হন এবং ১৯২৬ সালে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। মাত্র ১১ বছর বয়সেই রবি নিয়োগী খেলাফত আন্দোলনে যুক্ত হন। ১৯২৬ সালে রবি নিয়োগী ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন। সেখানে গিয়েই তিনি পুরোদমে জড়িয়ে পড়েন সশস্ত্র বিপ্লবী দল ‘যুগান্তরে’র সাথে। ময়মনসিংহে তখন ‘যুগান্তর’ ও ‘অনুশীলন সমিতি’র শক্ত ঘাঁটি। একদিন আনন্দমোহন কলেজে এক তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশ বিনা কারণে ছাত্রদের গালাগালি করতে থাকে। রবি নিয়োগী ও তাঁর বন্ধুরা এতে ভীষণ ক্ষেপে রেগেমেগে পুলিশকে জোড় করে ধরে এনে পুকুরে ফেলে দেন। এ ঘটনায় রবি নিয়োগীর বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা দায়ের করে। কলেজ কর্তৃপক্ষও তাঁকে বহিস্কার করে। মামলা থেকে বাঁচার জন্য তিনি কলকাতায় পালিয়ে চলে যান। সেখানে গিয়ে ভর্তি হন বিদ্যাসাগর কলেজে। কিন্তু কলেজে ভর্তি হলেও পড়াশোনা আর হয়ে ওঠেনি। একের পর এক রাজনৈতিক সংগ্রামেই নিজেকে আরো বেশি করে নিমগ্ন করে রাখেন রবি নিয়োগী।

১৯২৯ সালে সিদ্ধান্ত নেন শেরপুরে ফিরে আসবেন এবং ‘আইন অমান্য’ আন্দোলনকে সংঘটিত করবেন। শেরপুরে ‘আইন অমান্য’ আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। ১৯৩০ সালের দিকে কংগ্রেস সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ডাক দেয়। এই সময় তিনি ছিলেন নিখিল বঙ্গ কংগ্রেসের কার্যকরী কমিটির সদস্য। ১৯৩৮ সালে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু যখন কংগ্রেসের প্রচার কাজ চালাতে শেরপুরে আসেন তখন সেই সভাতে সভাপতিত্ব করেন বিপ্লবী রবি নিয়োগী। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় যুদ্ধের সময় তাঁকে নিজ বাড়িতে দু’বছর অন্তরীণ অবস্থায় রাখা হয়। ১৯৪২ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। ১৯৩৭ সালে নেত্রকোনা জেলার দলার গ্রামে যে টঙ্ক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয় তার অংশ হিসেবে ১৯৪৩ সালে নালিতাবাড়িতে প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলন হয়। এই সম্মেলন সফলভাবে সমাপ্ত করার কারণেই নেতৃবৃন্দ ১৯৪৫ সালে নেত্রকোনায় সর্বভারতীয় কৃষক সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নেয়। নেত্রকোনা জেলার এই কৃষক আন্দোলন ভারত উপমহাদেশে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।

১৯৩০ সালের দিকে শেরপুরে সত্যাগ্রহের সময় গাঁজা-মদের দোকান ভাঙ্গা আন্দোলনে যোগ দিতে গিয়ে তিনি প্রথম কারাবরণ করেন। গ্রেফতারের পর প্রথমে তাঁকে জামালপুর ও পরে ময়মনসিংহ জেলে আটক রাখা হয়। জেলেও তিনি রাজবন্দীদের মর্যাদার জন্য আন্দোলন করেন। জেলে আন্দোলনের কারণেই জেল কর্তৃপক্ষ তাঁকে দমদম জেলে পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকে প্রায় একবছর পর মুক্তি পান। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে আবার সশস্ত্র আন্দোলনে যোগ দেন। তারপর কলকাতা থেকে ময়মনসিংহে চলে আসেন। ১৯৩১ সালে শেরপুর ঢোকার মুখে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। তখনকার ‘গুদারাঘাট শুটিং কেইস’ মামলায় রবি নিয়োগীর সাত বছর জেল হয়। এসময় তিনি ময়মনসিংহ ও রাজশাহী জেলে বেশ কিছুদিন বন্দি ছিলেন। কিন্তু রাজশাহী জেলে থাকাবস্থায় জেলের সুপারিনটেন্টকে গুলি করে হত্যা প্রচেষ্টার জন্য তাঁকে শাস্তি হিসেবে আন্দামানে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আন্দামান তখন কালাপানির দ্বীপ। রবি নিয়োগী ‘মহারাজ জাহাজে’ সেখানে যান। ১৯৩৩ সালে আন্দামান সেলুলার জেলে থাকাবস্থায় সেখানকার বন্দিরা জেল জীবনের দুঃসহ জীবনের প্রতিবাদে চিফ কমিশনারের কাছে তিনদফা দাবীনামা পেশ করেন।

● ভালো খাদ্য প্রদান।

● জেলে আলোর ব্যবস্থা করা এবং

● বই ও পত্রিকা পড়ার সুযোগ দেয়া। কর্তৃপক্ষ সে দাবি না মানলে বিপ্লবীরা অনশন শুরু করেন। অনশন অবস্থায় তিনজন বিপ্লবীকে জোর করে খাওয়াতে গিয়ে হত্যা করে জেল কর্তৃপক্ষ। এই খবর বাংলায় ছড়িয়ে পড়লে প্রবল আন্দোলন গড়ে ওঠে জেলের ভিতরে ও বাইরে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মহাত্মা গান্ধীসহ অনেক দেশবরেণ্য নেতাই বিপ্লবীদের অনশন থামানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। একটানা ৪৬ দিন অনশন করার পর বিপ্লবীদের দাবি মেনে নেয় কর্তৃপক্ষ।

আন্দামানকে তখন বলা হত বিপ্লবীদের মার্ক্সবাদী বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানেই মূলত বিপ্লবীরা সশস্ত্র সংগ্রামের পথ ছেড়ে রাজনৈতিকভাবে শ্রেণী-সংগ্রামের ভিত্তিতে আন্দোলন গড়ে তোলায় সচেষ্ট হন। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৩৩ সালেই তারা ৩২ জন বিপ্লবী জেলখানায় কমিউনিস্ট কনসলিডেশন গড়ে তোলেন। জেলখানাতে এটিই ছিল কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম শাখা। ১৯৩৭ সালের ২৫ জুলাই আন্দামান জেলের বন্দিরা পুনরায় তিন দফা দাবিতে অনশন শুরু করেন।

● সকল রাজবন্দিদের মুক্তি।

● আন্দামান বন্দিদের অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে আনা এবং

● মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত সব রাজনৈতিক বন্দিকে কমপক্ষে ডিভিশন ‘টু’-র বন্দি হিসেবে গণ্য করা। একটানা ৩৭ দিন অনশন-আন্দোলনের এক পর্যায়ে বন্দিরা দেশে ফেরার নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি আদায় করেন।

বিপ্লবী রবি নিয়োগী আন্দামানের বন্দিদশা থেকে যেদিন মুক্তি পান তার পরদিনই আবার দিনাজপুরে গ্রেফতার হয়। ১৯৩৮ সালে ছাড়া পেয়ে সেখানেই কমিউনিস্ট পার্টিকে সংগঠিত করার কাজে নেমে পড়েন। ১৯৩৯ সালে তিনি আবার গ্রেফতার হন এবং মুক্তি পান ১৯৪১ সালে। একই বছর ‘না এক ভাই, না এক পাই’ অর্থাৎ ‘যুদ্ধে যাব না’ শ্লোগান দেয়ার অপরাধে রবি নিয়োগী নিরাপত্তা আইনে তিন মাসের জন্য আটক থাকেন। এসময় বৃহত্তর ময়মনসিংহে কৃষকরা টংক প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। এই আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে তিনি ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গ্রেফতার হন এবং ছাড়া পান ১৯৫৩ সালে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচার কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে রবি নিয়োগীকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ ধর্মঘটে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৯৫৫ সালে গ্রেফতার হন তিনি। কিছুদিন পর তিনি ছাড়া পান। একই বছর খাদ্য আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে পুনরায় আটক হন এবং ছাড়া পান ১৯৫৬ সালে। ১৯৫৮ সাল থেকে পাকিস্তানের সামরিক সরকার আইয়ুব খান ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত রবি নিয়োগীকে কারাগারে আটক রাখে। পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে ১৯৬৫ সালে রবি নিয়োগীকে নিরাপত্তা আইনে বন্দি করা হয়। একই বছরের শেষ দিকে তিনি ছাড়া পেলেও পরে আবার গ্রেফতার হয়ে যান। মুক্তি পান ১৯৬৯ সালে। ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের ক্ষমতার মসনদ দখল করলে রবি নিয়োগী বন্দি হন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে ডালু, নালিতাবাড়ি, হালুয়াঘাট, মহেন্দ্রগঞ্জ সীমান্তের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে ও মুক্তিযোদ্ধা মোটিভেশন ক্যাম্পে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। এসময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাঁর শেরপুরের বাড়িটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। ১৯৭৫ সালের পর কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থায় ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত রবি নিয়োগী নিরাপত্তা আইনে কারাগারে আটক থাকেন। এরশাদের স্বৈরশাসনামলে ১৯৮৮ সালে শেষ বারের মতো বৃদ্ধ বয়সে আবার কারারুদ্ধ হন রবি নিয়োগী। এভাবে রবি নিয়োগী তার ৯২ বছরের জীবনে ৩৪ বছর জেলে কাটিয়েছেন।

রবি নিয়োগী দীর্ঘদিন সাংবাদিকতাও করেছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বিভিন্ন রণাঙ্গণ থেকে রিপোর্ট করতেন। এসব রিপোর্ট কলকাতার ‘কালান্তর’ পত্রিকায় নিয়মিত ছাপা হত। তিনি ছিলেন ‘দৈনিক সংবাদের’ সংবাদাদাতা। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর তিনি শেরপুরে ‘সাংবাদিক সমিতি’ গঠন করেন এবং তিনি এই সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে শেরপুর জেলা প্রেসক্লাবের তিনি আজীবন সভাপতি হিসেবে মনোনীত হন।

বিপ্লবী রবি নিয়োগী তাঁর বিপ্লবী জীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন অনেক অনেক সংবর্ধনা। তার মধ্যে রয়েছে

● ১৯৮৯ সালে ডালু গণহত্যা দিবস সম্মাননা,

● ১৯৯১ সালের ২৫-২৮ ফেব্রুয়ারি মুম্বাই বীর সাভারকর স্মৃতি ট্রাস্ট রাষ্ট্রীয় স্মারক সম্মাননা,

● ১৯৯১ সালে পুণার তিলক ট্রাস্ট সম্মাননা ও মহানগর পালিকা সম্মাননা,

● ১৯৯৪ সালে জিতেন ঘোষ কল্যাণ ট্রাস্ট সম্মাননা,

● ১৯৯৫ সালে মাস্টারদা সূর্যসেন পরিষদ কর্তৃক সম্মাননা,

● ১৯৯৬ সালে তেভাগা সম্মাননা,

● ১৯৯৬ সালে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সম্মাননা,

● ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি’র সূবর্ণ জয়ন্তী উৎসবে সম্মাননা,

● নকলা-নালিতাবাড়ি একাডেমি সম্মাননা,

● বৃহত্তর ময়মনসিংহ সাংস্কৃতিক ফোরাম সম্মাননা।

দীর্ঘ সংগ্রামী জীবন যাপনের পর ২০০২ সালের ১০ মে রবি নিয়োগী শেরপুরে মৃৃৃত্যুবরণ করেন।

 

তথ্য সূত্র: ● উইকিপিডিয়া ● গুণীজন ● বাংলাপিডিয়া

Link copied!