একই মঞ্চে একই গান ১৯ বার গেয়েছেন তিনি!

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ডিসেম্বর ২৩, ২০২১, ০৭:০৮ এএম

একই মঞ্চে একই গান ১৯ বার গেয়েছেন তিনি!

সংগীত শিল্পী, সুরকার, গীতিকার, অভিনেতা, ভাষা সংগ্রামী, মুক্তিযোদ্ধা ও গণসংগীতশিল্পী। সব পরিচয়ে ‘বিশেষিত’ হয়েছেন তিনি। তবে সবচাইতে বড় পরিচয়-তিনি ভাষা শহীদদের স্মরণে রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো, একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানের অমর সুরকার তিনি। বাংলাদেশের এই হিমালয় সমান জনপ্রিয় এই সুরকারের নাম আলতাফ মাহমুদ।

বরিশাল জেলার মুলাদী উপজেলায় পাতারচর গ্রামে ১৯৩৩ সালের এই দিনে (২৩ ডিসেম্বর) জন্মগ্রহণ করেন বরেণ্য এই সুরস্রষ্টা। আজন্ম লেনিনবাদী সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় বিশ্বাসী শিল্পী আলতাফ মাহমুদ বরিশাল জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও বিএম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর চিত্রকলায় পড়তে চলে যান কলকাতা আর্ট স্কুলে। সেখানেই রাজনীতির হাতে খড়ি তার। 

আপাদমস্তক বাঙালি ও প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার অধিকারী ছিলেন বাংলার এই সূর্য সন্তান। তার অনেক চারিত্রিক বৈশিষ্ঠের অন্যতম দিক-তিনি ছিলেন সাহসী ও স্পষ্টবাদী। আলতাফ মাহমুদের একমাত্র সন্তান শাওন মাহমুদ তার বাবা সম্পর্কে বলেন, “১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে বাবা নিখোঁজ হওয়ার সময় আমার  বয়স ছিল প্রায় তিন বছর। আমার মা, বাবার বন্ধুরা ও চাচাদের কাছ থেকে যতটুক জানতে পেরেছি তাহলো আমার বাবা ছোটবেলা থেকেই ছিলেন প্রচণ্ড সাহসী ও স্পষ্টবাদী। তিনি কখনও মিথ্যা কথা বলতেন না। আমার মাকে বাবা বলে গেছেন-মেয়েকে কখনও মিথ্যা বলা শেখাবেনা।”

আলতাফ মাহমুদ ও তার কন্যা শাওন মাহমুদ। 

১৯৫৪ সালের ঘটনা। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় তিনি  মঠবাড়িয়াসহ বরিশাল জেলার সর্বত্র নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন। ওই সময় পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে লেখা তার গাওয়া ‘মোরা কি দুঃখে বাঁচিয়া রবো’ ও ‘মন্ত্রী হওয়া কি মুখের কথা’ এ গান দুটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তবে এই গান দুটি গাওয়ার জন্য পাকিস্তান সরকারের চক্ষুশূলে পরিণত হন তিনি।  হুলিয়া জারি করা হয় তার বিরুদ্ধে।

ওই বছর কিশোরগঞ্জের ভৈরবে জিল্লুর রহমানের (সাবেক প্রেসিডেন্ট) আহ্বানে ও ব্যবস্থাপনায় একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তিনি সংগীত পরিবেশন করেন। তার লেখা, সুরকরা ও গাওয়া ‘মেঘনার কূলে ছিল আমার ঘর/হঠাৎ একটা তুফান আইসা ভাইসা নিল তারে রে’ গানটি মানুষের হৃদয়কে তুমুলভাবে নাড়া দেয়। শ্রোতাদের বারবার অনুরোধে ওই অনুষ্ঠানে আলতাফ মাহমুদ গানটি ১৯ বার গেয়ে শোনা

১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিতে পুলিশের গুলিতে মারা যায় রফিক, সালাম, বরকতসহ অনেকে। তাদের স্মরণে মোশারফ উদ্দিন রচিত ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচাবার তরে’ কবিতাটিতে আলতাফ মাহমুদ সুরারোপ করেন। এই গানটি একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম গান হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারির ঘটনা। আবদুল গাফফার চৌধুরী 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো' গানটি রচনা করেন। এই গানটির প্রথম সুর করেছিলেন আব্দুল লতিফ। ১৯৫৩ ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রভাতফেরীতে আলতাফ মাহমুদের সুরারোপিত ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচাবার তরে’ গানটি গাওয়া হয়। এই সময়ে আবদুল গাফফার চৌধুরীর 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো' গানটিতে তিনি নতুন করে সুরারোপ করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে তিনি ওই গানটির সুরে বেশ কিছু পরিবর্তন করেন। তার পরিবর্তন করা সুরটি পরিচালক জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া' চলচ্চিত্রে  ব্যবহৃত হয়।

আলতাফ মাহমুদ। 

১৯৫৮ সালের ঘটনা। পাকিস্তানের করাচিতে আলতাফ মাহমুদের প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশিত হয়। এই রেকর্ডের ‘পালের নৌকা পাল উড়াইয়া যায়’ এবং ‘কন্যা আর যাইওনা ওই না ঘাটেতে’ দুটি গানের গীতিকার ও সুরকার তিনি নিজেই ছিলেন।

১৯৬৪ সালে প্লেব্যাক সিংগার হিসেবে আবির্ভূত হন আলতাফ মাহমুদ। ‘তানহা’ নামে বেবী ইসলাম পরিচালিত উর্দূ ছবির ‘ও রাহি নাদান’ গানে কণ্ঠ দেন। একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ডাকসু (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) আয়োজিত একুশের প্রথম অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন অসীমে মুক্তির পথিক আলতাফ মাহমুদ। ডাকসুর ওই অনুষ্ঠানে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ ছাড়াও আলতাফ মাহমুদের সুর করা ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা’ গানটি প্রথমবারের মত অজিত রায়ের কণ্ঠে পরিবেশিত হয়।

সংগীত পরিচালক হিসেবেও ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে আলতাফ মাহমুদের। ১৯৬৫ সালে সাদেক খান পরিচালিত উর্দূ ছবি ‘ক্যায়সে কহু’র সঙ্গীত পরিচালনা করেন তিনি। পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালে পরিচালক আমজাদ হোসেন ও নূরুল হক বাচ্চুর যৌথ পরিচালানায় ‘আগুন নিয়ে খেলা’ ছবির সঙ্গীত পরিচালনা এবং কাজী জহিরের পরিচালনায় ‘নয়ততারা’ ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেন।

রাজধানীর পল্টন ময়দানে সোভিয়েত ইউনিয়নের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘আমরা স্ফুলিঙ্গ’ নামক ছায়া নাটকের আয়োজন করা হয়। দুদিন ব্যাপী ওই অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছিলেন কথাসাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সার। পুরো অনুষ্ঠানের সঙ্গীত পরিচালনা ও পরিবেশনার দায়িত্বে ছিলেন আলতাফ মাহমুদ। ওই অনুষ্ঠানে পরিবেশ করেন শহীদুল্লাহ্‌ কায়সারের রচিত আর নিজের সুরারোপিত বিখ্যাত গান-‘আমি মানুষের ভাই স্পার্টাকাস।’

১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সরকারের  বিরুদ্ধে শুরু হয় গণ আন্দোলন। তিনিও আন্দোলনে অংশ নেন, তবে ভিন্ন পথে। ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’ এর ব্যানারে গণ আন্দোলনকে বেগবান করতে তিনি রাজপথে নামেন। ওই বছর চলচ্চিত্র জগতে অনেক বেশি জড়িয়ে গেলেও  ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানে তিনি সঙ্গীত নিয়ে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করেন

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১২টার পর অপারেশন সার্চ লাইট শুরু হলে- তিনি ঢাকাতে থেকে যান। ঢাকায় থেকেই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করা শুরু করেন। সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ এবং মেজর হায়দারের নেতৃত্বে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে গঠিত ‘ক্র্যাক প্লাটুন’ এর সদস্য হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় এপ্রিলের শেষের দিকে প্রচুর গণসঙ্গীত রচনা, সুরারোপ ও কণ্ঠ রেকর্ড করে স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্রে পাঠাতে শুরু করেন

এই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের গোলা-বারুদ আর অস্ত্র লুকিয়ে রাখতেন রাজধানী ঢাকার নিজের বাসভবনে।  দেশিয় রাজাকার আর আল-বদরের সদস্যদের সহায়তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাঁকে ধরে নিয়ে যায় ১৯৭১ সালের ৩ই সেপ্টেম্বর চোখ বেঁধে তাঁকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীতে তাঁর আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।

ওই সময়ের স্মৃতিচারণ করে ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধা ও শিল্পী আবুল বারাক আলভী একটি গণমাধ্যমে বলেছিলেন, “আলতাফ ভাইয়ের বাসায় ঢুকেই তারা বললো ‘মিউজিক ডিরেক্টর সাব কৌন হ্যায়?’ আলতাফ ভাই বললেন, ‘আমি’। তখন তাকে মারতে মারতে মাটি খুঁড়ে বের করা হয়েছিল অস্ত্র। মার্শাল কোর্টে যখন তাকে তোলা হলো তখন তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর ছিল না। অথচ আমরা সবাই ভীষণ আতংকিত। তিনি যেনো বুঝেই গিয়েছিলেন তার গন্তব্য। আলতাফ ভাই ওই সময় বলেছিলেন,‘ আমার সঙ্গে যারা এসেছে, আমি ছাড়া আর কেউই অন্ত্রের ব্যাপারে জানে না।’ তিনি সবাইকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন।”

শিল্পী আবুল বারাক আলভীর মতো আলতাফ মাহমুদের আরেক সহযোদ্ধা লিনু বিল্লাহও একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, “আলতাফ ভাই বলেছিলেন ‘সব দায় আমার।ওরা কিছুই জানে না।’ আর আমাদের কাছে এসে বললেন, ‘তোমরা অস্বীকার করবে। আমি বলেছি সমস্ত দায় আমার। তোমাদের কোনো দোষ নেই।”

বাংলা সংস্কৃতি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান রাখার কারণে ১৯৭৭ সালে আলতাফ মাহমুদকে একুশে পদক প্রদান করা হয়। সংস্কৃতিক্ষেত্রে অসামান্য আবদান রাখায় শহিদ আলতাফ মাহমুদকে ২০০৪ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়।

Link copied!