এডওয়ার্ড ওয়াদি/উইলিয়াম সাইদ। এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাইদ নামেই যিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত। বিশ শতকের শেষ কয়েক দশকের অন্যতম প্রখ্যাত এবং প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবী। যাকে প্রথাবিরোধী বুদ্ধিজীবী বা চিন্তক হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। যাকে বলা হয় ‘পোস্ট কলোনিয়াল স্টাডিজ’ এর প্রতিষ্ঠাতা।
তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন সাইদ। ১৯৩৫ সালে জন্ম জেরুজালেমে। তবে জীবনের বড় অংশটাই কেটেছে যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৪৭ সালে ফিলিস্তিনের বুকে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা করা হলে সাইদের পরিবার প্রথমে কায়রো এবং কয়েকবছর পর সেখান থেকে আমেরিকায় চলে যান। তারপর থেকে সেখানেই সাইদের বেড়ে ওঠা, পড়ালেখা, অধ্যাপনা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনার পর তিনি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের লেকচারার হিসেবে নিযুক্ত হন। তবে সাইদের বিশেষত্ব প্রকাশ পায় তুলনামূলক সাহিত্যে। সাইদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে পরিচিত ‘ওরিয়েন্টালিজম’ এই তুলনামূলক সাহিত্য পর্যালোচনার ওপরই দাঁড়িয়ে।
সাইদ এমন একজন তাত্ত্বিক-বুদ্ধিজীবী যার দ্বারা প্রভাবিত লেখক, বুদ্ধিজীবী, ইতিহাসবেত্তা, নৃতাত্ত্বিকের সংখ্যা নেহায়েতই কম নয়। বরং বলা ভালো, সাইদ নব্য উপনিবেশবাদ ও নব্য সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আধুনিক তাত্ত্বিকদের গুরু। তাকে নিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি। বিশেষ করে পশ্চিমে। তাদের অনেকেই সাইদকে সহজ ভাবে নিতে পারেননি। তাদের েএকজন হলেন, স্যামুয়েল ফিলিপ হান্টিংটন। হান্টিংটন তার ‘ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন’ বইতে সাইদের ‘ওরিয়েন্টালিজম’এর জবাব দিতে এবং সাইদকে ভুল প্রমাণ করতে সাইদের ‘উই বা আমরা’ এবং ‘আদার বা অন্য’রা ধারনার অন্য ব্যাখ্যা হাজির করেন। হান্টিংটন বলতে চান প্রতে্যক সভ্যতা নিজেদের ‘উই বা আমরা’ এবং বাকীদের ‘আদার বা অন্য’ হিসেবে বিবেচনা করে। হান্টিংটন সাইদের ওরিয়েন্টালিজম বইতে প্রকাশিত আশঙ্কা সত্য করে দিয়ে পাশ্চাত্যের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ইসলামকে দাঁড় করিয়ে দেয়। অবশ্য হান্টিংটন ইসলামের সঙ্গে চৈনিক সভ্যতাকেও পশ্চিমা সভ্যতার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখাবার প্রয়াস পান। তবে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই দুই বই পাঠ করলে বুঝা যায় সাইদ ‘ওরিয়েন্টালিজমে’ পশ্চিমা মননের যে স্বরূপ উদঘাটন তা হাড়ে হাড়ে সত্য। হান্টিংটনের বক্তব্য কেবল পশ্চিমা মানসিকতার একাডেমিক রূপ।
অনেক তাত্ত্বিক-গবেষক সাইদকে বলে থাকেন মধ্যপ্রাচ্যে আরব জাগরণের মূল কারিগর বলে। আবার অনেকে তাকে নাকচ করে দেন। তবে সাইদ তার বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তা অনস্বীকার্য। তার লেখা ‘ওরিয়েন্টালিজম’ই এর বড় পরিচয়। ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত এই রচনার পর তার সব লেখাই কোন না কোনভাবে এর সাথে জড়িত। বিশেষ করে তার ‘রিপ্রেজেন্টেশন অব দি ইন্টেলেকচুয়ালস’ এবং ‘কাভারিং ইসলাম’ যেন এর সাথে অঙ্গাঙ্গি জড়িত।
‘ওরিয়েন্টালিজম’-এ সাইদ যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পশ্চিমা সাহিত্যের ব্যবচ্ছেদ করেন তা প্রাচ্য সম্পর্কে পশ্চিমের দৃষ্টিভঙ্গি উদঘাটনে এক দূর্দান্ত অগ্রযাত্রা, সেটা চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়। সাইদের আগে মানুষের মধ্যে এবং তাত্ত্বিক পরিসরে পশ্চিম বিরোধীতা থাকলেও সাইদের মাধ্যমে তা তাত্ত্বিক পূর্ণতা পায় এবং তা ব্যাপক আকারে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। সাইদ ‘ওরিয়েন্টালিজমে বলেন, পশ্চিমার তাদের মনে করে ‘উই বা আমরা’ হিসেবে এবং বাকী দুনিয়া বিশেষ করে আরব দুনিয়া তাদের কাছে ‘অন্য’। আর যারা ‘অন্য’ তারা অশিক্ষিত, বর্বর এবং তাদের সভ্যতার জন্য হুমকি। ফলে এই ‘অন্য’দের শিক্ষা দেওয়া, তাদের সভ্যতার স্বাদ দেওয়ার জন্যই তাদের শাসন করা পশ্চিমাদের কর্তব্য।
এডওয়ার্ড সাইদ নেরভাল, ফ্লবেয়ারসহ আরো অন্যন্য পশ্চিমা সাহিত্যকতের সাহিত্যকর্ম বিশ্লেষণ করে তারা তাদের মননে পূর্ব বিশেষ করে আরব এবং এশিয়া সম্পর্কে কী মনোভাব লালন করতেন এবং সেই মনোভাবের দরুণ তারা কতোটা আগ্রাসী হয়ে সারা দুনিয়ায় তাদের কলোনী বিস্তার করেছিল তার ইতিহাস আমাদের সামনে হাজির করেন। ফলে আমাদের চেনা ইতিহাসের পাঠ হঠাৎ করে বদলে যায়। যদিও আমাদের জানা ইতিহাসের অনেকটাই বিজয়ী পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে দেখা এবং লেখা। তবে ‘ওরিয়েন্টালিজম’ প্রকাশিত হওয়ার পর ইতিহাস দেখার সেই একচ্ছত্র চিন্তার প্রাধান্য কমেছে। এখন বিজেতা এবং স্থানীয়দের দৃষ্টিতেও দেখা এবং লেখা হচ্ছে ইতিহাস। হয়তো সে কারনেই কালচারাল স্টাডিজেও এসেছে বিরাট বিবর্তন। এখন কালচারাল ইম্পেরিয়ালিজমের বিপরীতে কন্ট্রা ফ্লো তৈরি হওয়ার নজির আমার চোখের সামনে দেখতে পাই। উদাহরণ হিসেবে কোরিয়ার কে-পপ কালচার কে বিবেচনা করতে পারি। এছাড়াও ইরান, আফ্রিকা এমনকি খোদ পশ্চিমা সভ্যতার বর্তামন কেন্দ্র আমেরিকার নাকের ডগায় মেক্সিকো, ল্যাটিন আমেরিকায় নিজস্ব সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন হচ্ছে।
সাইদ বলেছেন বুদ্ধিজীবী নিয়েও। বুদ্ধিজীবীর পরিচয়, দায় এবং সঙ্কট নিয়ে তার আলোচনা স্পষ্ট। এবং পূর্ব বিশেষ করে আরব এবং দক্ষিণ এশিয়া দেখার যে নয়া তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি পশ্চিম নিয়েছে বা নিতে বাধ্য হয়েছে তা অনেকটা সাইদের অবদান। পশ্চিম যেভাবে ইসলামকে মূল্যায়ন করে তার একটা বিবরণ আছে ওরিয়েন্টালিজমে। এবং তারই বর্ধিতা আলাপ আছে কভারিং ইসলামে। পশ্চিমা বুদ্ধিজীবী এবং তাদের মুখপাত্র পশ্চিমা মিডিয়া ইসলামকে যেভাবে কাভারেজ দেয় তা যে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের বাইরে না তা স্পষ্ট করে উল্লেখ করেন সাইদ। ফলে সাইদ পশ্চিমে থেকে পশ্চিমের গলার কাঁটা হয়ে উঠেন।
এডওয়ার্ড সাইদ যে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর থেকে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে যে পাথরের ঢিল ছোঁড়েন তা আকারে ছোট হলেও তার তাৎপর্য বিশাল। বুদ্ধিজীবীর দায় তিনি এখানে স্পষ্ট বুঝিয়ে দেন।
এডওয়ার্ড সাইদ পশ্চিমা এনলাইটমেন্টের পর দুনিয়াকে নতুনভাবে দেখার এক নতুন তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি হাজির করেন। এর একক কৃতিত্ব তার। জ্ঞান এবং ইতহাস কেবল পশ্চিমারা উৎপাদন করবে এবং পশ্চিমাদের বাইরে থাকা ‘অন্য’রা তা নির্দ্বিধায় মেনে নেবে এমন বুদ্ধিবৃত্তিক অহংয়ের গোঁড়ায় কুঠারাঘাত করেন সাইদ।
এডওয়ার্ড সাইদ স্রোতের বিপরীতে থাকা এক অসাধারণ বুদ্ধিজীবী। প্রথারিবোধী এই বুদ্ধিজীবী ২০০৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মৃত্যু বরণ করেন। তবে মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তার সব শেষ হয়ে যায়নি। বরং এখনো তাকে আরো আরো নতুন করে আবিস্কার এবং বুঝাপড়ার চেষ্টা হচ্ছে নিয়মিত। ফলে সাইদের প্রয়োজনীয়তা এখনো ফুরিয়ে যায়নি। হয়তো যাবেও না। অন্তত যতোদিন পশ্চিমা সভ্যতা বাকী দুনিয়াকে নিজেদের চেয়ে হীনতর মনে করা বন্ধ না করবে, যতোদিন ইসলামকে তারা তাদের প্রতিপক্ষ ভাবা বন্ধ না করবে সর্বোপরি যতোদিন দুনিয়ায় শাসিত এবং শোষিতের হিসাব রয়ে যাবে ততদিন সাইদ প্রাসঙ্গিক।