পুঁথি সাহিত্য চর্চা ও বাংলাভাষা প্রতিষ্ঠায় এক প্রাজ্ঞ পুরুষ

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

অক্টোবর ১১, ২০২১, ০৮:৫৬ এএম

পুঁথি সাহিত্য চর্চা ও বাংলাভাষা প্রতিষ্ঠায় এক প্রাজ্ঞ পুরুষ

বাংলা ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক; হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সেতুবন্ধনের অন্যতম কারিগর, মুক্তচিন্তার এক বিশাল হৃদয়-বিভিন্ন ভাবে তাকে উপস্থাপন করা হয়। তবে আমাদের পুঁথি সাহিত্যচর্চায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে যার নাম তিনি হচ্ছেন আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ। তবে তার সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো তিনি আপদমস্তক বাঙালি এবং সাম্যবাদী। আমাদের মায়ের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রীয়ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন।

বাংলা সাহিত্যের এই কীর্তিমান সাহিত্যপণ্ডিতের পুরো নাম মুন্সি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। ভারতের নদীয়া সাহিত্য সভা মুন্সী আবদুল করিমকে ‘সাহিত্যসাগর’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে এবং চট্টল ধর্মমণ্ডলী তাঁকে ‘সাহিত্য বিশারদ’ উপাধিতে ভূষিত করে। তিনি বরাবরই শেষোক্ত খেতাবটি পছন্দ করতেন এবং নিজ নামের সঙ্গে তা ব্যবহার করতেন।

কর্ণফুলী নদীর পূর্বতীর থেকে টেকনাফ পর্যন্ত অঞ্চলে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে তিনিই প্রথম ও একমাত্র ব্যক্তি যিনি ১৮৯৩ সালে প্রথম এন্ট্রাস পাস করেন। তিনি ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলের একমাত্র এফ.এ পড়ুয়া ছাত্র ছিলেন। তবে অসুস্থতার কারণে তিনি এফ.এ পরীক্ষার পাঠ শেষ করতে পারেননি।

১৮৯৩ সালে দ্বিতীয় বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জেলার অর্ধাংশে প্রথম মুসলিম ইংরেজি শিক্ষিতের অসামান্য গৌরব অর্জন করেন।বস্তুত আবদুল করিমই কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব পূর্বকালে ছিলেন একমাত্র মুসলিম লেখক, যিনি হিন্দু মুসলিম সমাজে সমভাবে ছিলেন পরিচিত এবং স্বীকৃত।

১৮৭১ সালের এই দিনে (১১ অক্টোবর)চট্টগ্রামের পটিয়ার জন্ম নেয়া এই ক্ষণজন্মা সাহিত্য সাধক ছিলেন ব্রিটিশ ভারত ও পাকিস্তানের একজন বাঙালি সাহিত্যিক। পুথিসাহিত্যকে আপন সন্তানের মতো ভালোবাসতেন তিনি। চাকরি জীবনে অঢেল খাটুনির পর তিনি পুথি সংগ্রহ ও সাহিত্য সাধনায় জীবনের বড় অংশ কাটিয়ে দিয়েছেন। প্রাচীন পুথি সংগ্রহ ও সাহিত্যের ঐতিহ্য অন্বেষণকারী এক বিরল ব্যক্তিত্ব ছিলেন।  

বাংলার শ্রেষ্ঠ মনীষী বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তখন মারা গেছেন, মুসলিম বাংলার অন্যতম চিন্তাবিদ বাঙালি প্রাবন্ধিক, বিশিষ্ট সমালোচক, নাট্যকার ও জীবনীকার কাজী আবদুল ওদুদ সবেচমাত্র জন্মগ্রহণ করেছেন, প্রেম ও দ্রোহের কবি কাজী নজরুল পৃথিবীতে আসি আসি করছে -সেই ওই সময় ১৯৯৪ সালে লেখক হিসেবে কলম ধরেন।

খাঁটি বাঙালি এই সাহিত্যিক ছিলেন অগ্রসর চিন্তার মানুষ। তাই স্বদেশ, সংস্কৃতি, মাতৃভাষা নিয়ে যখন সমাজ-মন রক্ষণশীল, দ্বিধান্বিত ও প্রতিকূল, তিনি তখন মুক্তচিন্তা ও উদার দৃষ্টি দিয়ে এসব বিষয় বিবেচনা করেছেন। বাঙ্গালী মুসলমানের মাতৃভাষা বিতর্ক ও জাতীয়তা সংকট নিয়ে তার মতামত ছিল কালের নিরিখে স্বতন্ত্র ও অনন্য।

১১৮ বছর আগে তাইতো তার কথায় বাংলার ভবিষৎ প্রতিফলিত হয়। ১৯০৩ সালে তিনি বলেছেন, “... বাঙ্গালা ভাষা ত্যাগ করিলে বঙ্গীয় মুসলমানের কোনো মঙ্গল আছে বলিয়া আমাদের বিশ্বাস নাই। যদি কখনো অধঃপতিত বাঙ্গালীর উদ্বোধন হয়, তবে বাঙ্গালার অমৃতনিষ্যন্দিনী বাণী ও অনলগর্ভা উদ্দীপনাতেই হইবে” (‘নবনূর’, আষাঢ় ১৩১০)।

১৯১৮ সালে মাতৃভাষা বাংলা সম্পর্কে তিনি যে কথা বলেছিলেন, তা যুগের প্রেক্ষাপটে ব্যতিক্রমী বক্তব্য বলে স্বীকার করতে হয়। ১৯৪৮ সাল থেকে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে যখন ভাষা আন্দোলন শুরু হয় তা যেনো সাহিত্যবিশারদের বক্তব্যেরই প্রতিফলন।

ভাষা আন্দোলনের ৩০ বছর আগেই বাংলা ভাষা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন “বাঙ্গালা ভাষা ভিন্ন অন্য কোনো ভাষা বাঙ্গালী মুসলমানের মাতৃভাষা ও জাতীয় ভাষা হইতেই পারে না। চিরকাল মাতৃভাষা ও জাতীয় ভাষা বলিয়া স্বীকৃত ও গৃহীত দেশভাষার স্থলে নূতন ভাষার আমদানি হইলে তাহা পরিণামে সমাজের পক্ষে কেবল মারাত্মক হইবে মাত্র। তাহাতে সমাজের উন্নতি হওয়া দূরে থাকুক, জীবনীশক্তি হারাইয়া উহা বরং একবারে অচল ও পঙ্গু হইয়া পড়িবে।” (‘আল এসলাম’, আশ্বিন ১৩২৫)।

বাংলাভাষা যে আবদুল করিমের কত আপন তার আরও প্রমাণ পাওয়া যায় ১৩৫২ সালে কুমিল্লা সাহিত্য সম্মেলনে দেওয়া ভাষণে। ওই সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, “আমার এই বিশ্বাস আছে যে, আমার দেশের মৃত্যু নাই; আমার দেশের আত্মা যে জনগণ, তাহারও মৃত্যু নাই; তেমনই অমর আমার এই বাঙ্গলা ভাষা” (‘দিলরুবা’, ভাদ্র ১৩৫৯)।

জীবনের পড়ন্ত বেলায় দাঁড়িয়েও ভাষা আন্দোলনে সমর্থন করেছেন তিনি। মাতৃভাষা বাংলার সংকট ও বিপন্নতায় তিনি ক্ষুব্ধ, ব্যথিত ও প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন। ‘দৈনিক পূর্ব পাকিস্তান’ পত্রিকায় ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নামে এক প্রবন্ধ লিখে বাংলার পক্ষে তার মত প্রকাশ করেন।

এছাড়া, ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ২০ জন বিশিষ্ট লেখক-সাংবাদিক-শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবী পূর্বপাকিস্তানের গভর্নর খাজা নাজিমুদ্দীনের কাছে যে স্মারকলিপি পেশ করেন, তাতে প্রথম স্বাক্ষর দেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ।

তৎকালীন রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে, দরিদ্র মুসলমান সমাজ বৃহত্তর অংশ হলে ও তাঁরা ছিলেন নিষ্প্রভ। সাহিত্য-সংস্কৃতিতে পশ্চাৎপদ। শিক্ষিত সমাজের পাঠযোগ্য কোন রচনা বা গ্রন্থ ছিলো না। সেই অবস্থায় আবদুল করিমের ইতিহাস জ্ঞান তাঁকে বাংলার ঐতিহ্য সন্ধানে আগ্রহী করে তুলে।

সাহিত্যে রাজকীয় সময়কাল পার করেছেন  আবদুল করিম। লিখেছেন প্রায় ৪৫০ টি প্রবন্ধ নিবন্ধ। সংগ্রহ করেন প্রায় এক হাজার পুঁথি। এগুলোর বিবরণ ও বর্ণনা বিধিবদ্ধ হয়েছে। তাঁর লেখার বিষয় - ভাষা, সাহিত্য, ধর্ম সমাজ , সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, নৃতত্ত্ব ও ইতিহাস। তাঁর রচনার সবই কেজো সাহিত্য। এসবই কাজে লেগেছে বাঙালির জাতীয় জীবনে, সন্ধিক্ষণ থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে।

আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের লেখা প্রবন্ধে জাতিকে পথের দিশা দেওয়ার চিত্র ফুটে উঠেছে। মুক্তবুদ্ধির চর্চায় অগ্রগণ্য এই সাহিত্যের রচনায় তাঁর ব্যক্তিত্ব, পাণ্ডিত্য ও যুক্তির প্রাখর্য ছিলো প্রশংসনীয়।মুসলমানদের বাঙালিত্ববোধ জেগে ওঠার পেছনে তাঁর রচিত ও প্রকাশিত প্রবন্ধের প্রভাব অপরিসীম।

অসম্ভব বাংলাভাষাপ্রেমিক এই সাহিত্যিক ১১টি প্রাচীন বাংলা গ্রন্থ সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছেন। চট্টগ্রামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির উপর ইসলামাবাদ নামে তাঁর লেখা বই রয়েছে। সমাজে যেসব প্রতিভাময়ী কবি প্রচারের অভাবে পরিচিত পান নাম এমন  শতাধিক মুসলিম কবিকে তিনি পরিচিত করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য সম্পাদিত পুথিসমূহের মধ্যে জ্ঞানসাগর, গোরক্ষ বিজয়, মৃগলব্ধ, সারদা মুকুল ইত্যাদি অন্যতম।

Link copied!