বাংলা গদ্য ভাষাকে শিল্পিত রূপ দিয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র

আফছার মুন্না

জুলাই ২৯, ২০২১, ০৫:৫৩ পিএম

বাংলা গদ্য ভাষাকে শিল্পিত রূপ দিয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র

আজ ২৯ জুলাই। ঈশ্বরচন্দ্র  বিদ্যাসাগরের ১২৪তম মৃত্যুদিবস। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের এই দিনে তিনি মারা যান।ভারতীয় উপমহাদেশে উনিশ শতকের নবজাগরণের মধ্য দিয়ে আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটে। ওইসময় বহুকীর্তিমান বাঙালির পদপাতে মুখরিত হয়েছিল। আর এই নবজাগরণের প্রধান চরিত্র বিদ্যাসাগর। পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। 

বাংলা গদ্য ভাষাকে গড়ে তোলা এবং শিল্পিত রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শুধু কি গদ্য প্রণয়নের রূপরেখাই প্রণয়ন করেছিলেন? না। বাংলা বাংলা বর্ণমালার আধুনিক রূপ দিয়েছেন, প্রণয়ন করেছেন বাংলা ভাষার ব্যাকরণ।

ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন ইংরেজ সরকারের বড় শিক্ষা কর্মকর্তা। তিনি তার দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালনের পাশাপাশি এদেশের মানুষের কথা ভেবেছেন। তিনি জানতেন ইংরেজি শিক্ষা ছাড়া মুক্তি অসম্ভব তাই তিনি এর প্রতি গুরুত্বারোপ করেছিলেন। এ অঞ্চলের মানুষগুলোকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে অসংখ্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি।

বিদ্যাসাগর ছিলেন আধুনিক মনোভাবাপন্ন। সমাজে আবহমান কাল ধরে চলে আসা কুসংস্কারগুলোকে সমূলে উৎপাটন করতে চেয়েছিলেন তিনি। তিনি উপলব্ধি করেছেন, পুরোনো মূল্যবোধ এবং পরিবারের ভেতর থেকে পরিবর্তন আনতে না পারলে সমাজ এবং দেশের কখনো প্রকৃত উন্নতি হবে না। এ জন্যে তিনি বিধবা-বিবাহ চালু করা, বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ করা এবং স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের জন্যে আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন।

বীরসিংহ গ্রামে বিদ্যাসাগর স্মৃতিমন্দির।
পশ্চিম মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈত্রিক বাড়ি। এখন এটি তাঁর স্মৃতি সংগ্রহশালা হিসাবে সংরক্ষিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ‘আহমদ শরীফ অধ্যাপক চেয়ার’ আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, যখন ঈশ্বরচন্দ্রের কর্মজীবন শুরু হয় বাংলা গদ্য তখনও খুব পরিচ্ছন্ন রূপ লাভ করেনি, তিনিই সর্বপ্রথম বাংলা গদ্যের একটি পরিচ্ছন্ন রূপ দেন। এজন্য বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের জনক বলা হয়। বাংলা গদ্য ভাষাকে গড়ে তোলা এবং ভাষাকে শিল্পিত রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। বাক্যে কর্তা, কর্ম, করণ, ক্রিয়া’র ব্যবহার কীভাবে হবে তা তিনি ঠিক করেছেন। শুরুতে বাংলা বর্ণমালা বর্তমানের রূপে ছিল না, এটি ছিল বিক্ষিপ্ত আকারে। বিদ্যাসাগর এটিকে একটি রূপ দিয়েছেন, মোটামুটি সেটিই এখনও চলছে।

অধ্যাপক আবুল কাসেম আরো বলেন, বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। যদিও এ কলেজে মূল পাঠ্য ছিলো হিন্দু ধর্ম, হিন্দু শাস্ত্র, তবুও তার চিন্তা ভাবনার বিকাশ ঘটেছিলো ঈশ্বর ও অলৌকিকতাকে বাদ দিয়ে। তিনি বাংলার মানুষকে ধর্ম ও পরকালীন জীবনের চিন্তাধারার সীমাবদ্ধতা থেকে বের করে ইহজাগতিক কল্যানের কথা ভাবতে উদ্ভুদ্ধ করেন। যাকে ইংরেজিতে বলে “স্যাকুলারিজম”, যার মানে হলো ইহলৌকিকতা। অনেকেই এটিকে ধর্মনিরপেক্ষতা বলেন, এটি যথাযথ নয়।

কলকাতায় বিদ্যাসাগর স্ট্রিটের এই বাড়িতেই জীবনের শেষ বছরগুলো কাটিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
১৮৭৭ সালের জানুয়ারি থেকে কলকাতায় বাদুড়বাগানে তৈরি এই বাড়িটিতে বসবাস শুরু করেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বর্তমান বিদ্যাসাগর স্ট্রিটের এই বাড়িতেই তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।

তিনি আরও বলেন, হিন্দু ধর্মের পুরোহিতরা হিন্দু ধর্মকে মানুষের কাছে যেভাবে উপস্থাপন করে, সেই চিন্তা ধারণা থেকে মানুষকে মুক্ত করার নিমিত্তেও কাজ করেছে। তৎকালে হিন্দু ধর্মে মেয়েদের সেই মর্যাদা এবং অধিকার ছিলো না কিন্ত তিনি সমাজের এই প্রথার প্রতিবাদ করেন। মেয়েদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্যে তিনি চেয়েছিলেন বহু বিবাহ ও বাল্য বিবাহ বন্ধ হোক। তিনি বিধবা বিবাহের প্রচলন করেন।

তৎকালীন বাঙালি সমাজে এসবের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ছিলো আর সমাদানের আক্ঙ্খা ছিলো বলেও উল্লেখ করেন আবুল কাসেম ফজলুর হক।

বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, যাকে আমরা সাহিত্য বলি সেটা বিদ্যাসাগরই এক অর্থে প্রথম শুরু করেছিলেন। ১৮৪৭ সালে তার প্রকাশিত গ্রন্থ ’বেতাল পঞ্চংবিংশতি’কেই আমরা বাংলা ভাষায় আধুনিককালে লেখা প্রথম সাহিত্যিক গদ্য বলি। এরপরে তিনি আরো কিছু বই অনুবাদ করেছিলেন সংস্কৃত এবং ইংরেজি থেকে। তারা এই কাজের মধ্য দিয়ে একদিকে আমরা বাংলা ভাষায় অন্য ভাষার সাহিত্য পেলাম অন্যদিকে বাংলা ভাষায় সাহিত্যকর্ম লিখন পদ্ধতির একটা নমুনাও পাওয়া পেলাম। বাংলা ভাষায় এর সুগভীর প্রভাব রয়েছে।

তিনি আরো বলেন, বিদ্যাসাগরের সবচেয়ে বড় অবদান বলে ‍যেটিকে উল্লেখ করা হয় তা হলো বাংলা গদ্যে। উনিশশতকে এক ধরেনের নতুন গদ্য লেখা শুরু হয়েছিলো, সেই গদ্যটা ছিলো একটু বিকট, একটু খারাপ। কতগুলো সংস্কৃত শব্দ, নতুন ধরনের বাক্য তখনও ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারে নাই। ওই বিকট গদ্যটা গুছিয়ে কিভাবে সুশৃঙ্খল এবং শিল্পসম্মত হতে পারে তা দেখাতে পেরেছেন। এজন্য রবীন্দনাথ ঠাকুর বলেছিলেন বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের প্রথম যথার্থ শিল্পী।

ড. আজম আরো বলেন, তাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় বাংলা সুশিক্ষার বই রচনার জন্যে। তিনি শিশুশ্রেণি থেকে শুরু করে উপরের কয়েক শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা গদ্য পড়ার জন্য তিনি অনেকগুলো বই লিখেছিলেন। এবং সেই বইগুলোতে তিনি বিভিন্ন বয়সীদের উপযোগী করে গদ্য লিখেছেন।

বিদ্যাসাগর ইংরেজ সরকারের অনেক বড় শিক্ষা কর্মকর্তা ছিলেন। সমগ্র বাঙলার জন্যে যে শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরী করা হয়েছে তা প্রণয়নে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা ছিলো অনেক। ছাত্রদেরকে নতুন চিন্তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে তিনি অনেকগুলো পাঠ্যপুস্তক লিখেছেন বলেও উল্লেখ করেন অধ্যাপক আজম।

Link copied!