শিল্পাচার্য জয়নুল: যার চিত্রে দ্রোহ ও প্রেম মিশে একাকার

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ডিসেম্বর ২৯, ২০২১, ০৯:৪১ এএম

শিল্পাচার্য জয়নুল: যার চিত্রে দ্রোহ ও প্রেম মিশে একাকার

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। বাংলাদেশের চিত্রকলাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জনক তিনি। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে উপমহাদেশের চিত্রকলার ইতিহাস বলতে গেলে চলে আসে তার নাম। প্রেম ও দ্রোহের কবি বলতে যেমন কবি নজরুল, তেমনি চিত্রকলায় জয়নুল। বাংলাদেশের এই ক্ষণজন্মা ও চিত্রকলার বিস্ময়কর সাধক, ধারক ও বাহক  জয়নুল আবেদিন, যিনি ‘শিল্পাচার্য’ নামেই বেশি পরিচিত।

জয়নুল আবেদিন ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জের কেন্দুয়াতে জন্মগ্রহণ করেন। শিশুকাল থেকেই আঁকাআকিঁর অভ্যাস ছিল তার। অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী থাকাকালে বোম্বে (বর্তমানে মুম্বাই) ক্রনিক্যাল পত্রিকায় গলফ খেলা বিষয়ে ছবি আকাঁ প্রতিযোগিতায় তার ছবি প্রথম হয়। এরপরই সবার নজরে চলে আসেন তিনি।

মাত্র ১৬ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে জয়নুল বন্ধুদের সাথে কলকাতায় যান শুধু ‘গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস’ দেখার জন্য। সেখান থেকে ফিরে আসার পর সাধারণ পড়াশোনায় আর মন বসেনি তার। পরবর্তী  ইতিহাস সবারই জানা। ছেলের আগ্রহ দেখে মা তার গলার সোনার হার বিক্রি করে ভর্তি করান কলকাতা আর্টস স্কুলে। ১৯৩৮ সালে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।

ইতিমধ্যে গণ্যমান্য চিত্রশিল্পী হিসেবে জয়নুল আবেদিনের নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। যামিনী রায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ বিখ্যাত চিত্রশিল্পীগণ জয়নুলের পরামর্শ নিতেন কীভাবে ভারতীয় চিত্রকলাকে আরও বেগবান করা যায়। 

বাংলার প্রাকৃতিক দৃশ্যই জয়নুলকে শিল্পী তৈরি করেছে। একথা অকপটে স্বীকারও করেছেন তিনি। এক স্মৃতিচারণে জয়নুল আবেদিন লিখেছেন, “যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করে আমি ছবি আকাঁ শিখলাম কী করে? বা কার কাছ থেকে? তবে উত্তর দিতে পারবো না। বলবো, আমার দেশের প্রকৃতি আর পরিবেশ আমাকে ছবি আকাঁর অনুপ্রেরণা দিয়েছে। এদেশের আকাশ, বাতাস, নদী, মাঠ, বন, এখানকার মানুষের চলাফেরা, ওঠাবসা, হাসি-কান্না আমাকে ছবি আকঁতে বলে।”

১৯৪৩ সালের ঘটনা। বাংলার দুর্ভিক্ষ জয়নুলকে পুরোপুরি বদলে দেয়। যে জয়নুল সারাজীবন প্রকৃতির দৃশ্য এঁকেছেন, এবার তিনি নিসর্গ শিল্পী থেকে রুপান্তরিত হন দুর্দান্ত বিদ্রোহী ব্যক্তিত্বে। তারপর থেকেই সারাজীবন বিক্ষুব্ধ থেকে গেছেন। 

ওই সময় দুর্ভিক্ষের বাজারে উন্নত মানের শিল্পসামগ্রী দুর্লভ ও দুর্মূল্য হওয়ায় জয়নুল আবেদিন বেছে নেন শুধু কালো কালি আর তুলি। শুকনো তুলিতে কালো চীনা কালির টানে স্কেচ করেন সস্তা কাগজের ওপর। একাজে ব্যবহার করেন কাটিজ পেপার বা প্যাকেজিং কাগজ। এই সস্তা উপকরণ দিয়ে তিনি দুর্ভিক্ষের যে ছবি আকঁলেন তা পরিণত হলো অমূল্য সম্পদ। আর সফলতা ও খ্যাতিতে জয়নুল পৌঁছে যান হিমালয় সমান উচ্চতায়।  

১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা ছাড়াও তার আরও বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম রয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ের ওপর তিনি ছবি আঁকতেন। তবে গ্রাম, অবহেলিত জনপদ, ছিন্নমূল মানুষ, ক্ষুধা-দারিদ্র্যের ওপর ছবি আঁকাকে তিনি প্রাধান্য দিতেন। বিষয়বস্তুতে ফুটে উঠতো তার দরদি মনের ছবি। তার বিখ্যাত চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে আছে নৌকা (১৯৫৭), সংগ্রাম (১৯৫৯), বীর মুক্তিযোদ্ধা (১৯৭১), ম্যাডোনা প্রভৃতি। তার দুটি বিখ্যাত স্ক্রল চিত্রকর্ম আছে, একটি হলো নবান্ন (১৯৫৯)। চিত্রটি দৈর্ঘ্যে ৬৫ ফুট। অন্যটি মনপুরা (১৯৭০)। এটি দৈর্ঘ্যে ৩০ ফুট। জয়নুল আবেদিনের চিত্রকর্ম তিন হাজারেরও বেশি বলে অনেকে ধারণা করে থাকেন।

প্রয়াত সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ এক সাক্ষাৎকারে জয়নুলকে প্রশ্ন করেছিলেন, “আপনি দুর্ভিক্ষের উপর ছবি আঁকলেন অথচ বন্যার ছবি আঁকলেন না কেন? জবাবে শিল্পাচার্য বলেন, “বন্যা প্রকৃতির। তাই এর বিরুদ্ধে করবার কিছুই নেই। দুর্ভিক্ষ মানুষের সৃষ্টি। মানবতার অপমান আমাকে ব্যথিত করেছিল। তাই দুর্ভিক্ষের ছবি একেঁছি।” (তথ্যসূত্র:জয়নুল আবেদিন/কালি ও কলম)

পাকিস্তান সরকারের প্রতিও প্রচণ্ড ক্ষোভ ছিল তার। তাইতো শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারকে শিল্পাচার্য বলেছিলেন, “মনোয়ার, দুর্ভিক্ষ হলে সে ছবি আঁকা যায়, নিরন্ন মানুষের হাহাকার ছবিতে দেখানো যায়। কিন্তু পাকিস্তানি শোষণের সময় মনের দুর্ভিক্ষ চলছে, এটা তো কোনো ছবিতে আকাঁ যায় না।” (তথ্য সূত্র: জয়নুল স্মৃতি/সম্পাদনা মতলুব আলী)

দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ জয়নুলকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের এই জাতীয় অধ্যাপক স্বাধীনতার পরপরই শিল্পচর্চা সংগঠনের কাজে লেগে যান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে বাংলাদেশের সংবিধানের অঙ্গসজ্জার দায়িত্ব পালন করেন। তার নেতৃত্বে এই কাজে সহায়তা করেন আরও কয়েকজন শিল্পী।

১৯৪৮ সালে পূর্ববঙ্গের প্রথম প্রজন্মের শিল্পীদের পুরোধা ব্যক্তিত্ব জয়নুল আবেদিনের উদ্যোগে পুরান ঢাকায় ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুলের একটি জীর্ণ কক্ষে গভর্নমেন্ট আর্ট ইন্সটিটিউট স্থাপিত হয়। তিনি এর প্রথম শিক্ষক ছিলেন। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর একই প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়’। তিনি ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে এটি  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। 

খ্যাতির শীর্ষে অবস্থানের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন আর্টস বিষয়ক ফাংশনে জয়নুল আবেদিনের ডাক পড়তো। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, পশ্চিম জার্মানি, মেক্সিকো, সোভিয়েত ইউনিয়ন, মিসর, সিরিয়া, লেবানন প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেন।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন সম্মামনায় ভূষিত হয়েছেন। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি প্রদান করে। তিনি রকফেলার ফাউন্ডেশনের ফেলোশিপ পান। তেহরান আন্তর্জাতিক শিল্পকলা প্রদর্শনীতে তিনি বিচারক হিসেবে মনোনীত হন। 

২০০৯ সালের  ঘটনা। জয়নুল আবেদিনের নামের সাথে মিল রেখে সৌর জগতের বুধ গ্রহের একটি জ্বালামুখের নাম ‘আবেদিন জ্বালামুখ’ নামকরণ করা হয়। মানবসভ্যতায় জয়নুলের মানবিক মূল্যবোধ ও উপলদ্ধিকে গভীরতর করার পরিপ্রেক্ষিতে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন এই নামকরণ করে। 

১৯৫৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের সবচেয়ে বড় খেতাব হেলাল-ই-ইমতিয়াজ, ১৯৬৮ সালে ঢাকা আর্ট কলেজের ছাত্রদের তরফ থেকে 'শিল্পার্চায' উপাধি পান। চিত্রাঙ্কনে উল্লেখওেযাগ্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে স্বাধীনতা পদক পুরষ্কারে ভূষিত করে।

১৯৭৬ সালের ২৮ মে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান সবার প্রিয় শিল্পাচার্য।

Link copied!