‘ভারতীয় দর্শকদের কথা যদি চিন্তা করেন তাহলে তারা ব্যাকওয়ার্ড দর্শক। এই সব বোকা দর্শক নিয়ে চিন্তা করলে তো হবে না। তারা বেশি গান বাজনার সিনেমা দেখতেই অভ্যস্ত।’ ১৯৮৯ সালে সাংবাদিক পিয়েরা আন্দ্রে বোয়েটিংকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অস্কার বিজয়ী বাঙালি পরিচালক সত্যজিৎ রায় এ কথা বলেন।
মাত্র ১০ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা হয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের। শান্তিনিকেতনের পৌষমেলায় ছেলেকে কবিগুরুর সঙ্গে দেখা করানোর জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন সুপ্রভা রায়। স্যগৃহীত ছবি
ভারত তথা বৈশ্বিক সিনেমায় যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিলেন সত্যজিৎ রায়। কিন্তু নিজ দেশেই শুনতে হয়েছিল বেশ সমালোচনা। তবে এই উপমহাদেশে দর্শকদের দৃষ্টিভঙ্গি ও রুচিবোধ পরিবর্তনে যে তিনি ভূমিকা রেখেছেন তার প্রভাব এখনও বিদ্যমান।
আউটডোর শ্যুটিং
সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম আউটডোরে শ্যুট করা সিনেমা। এর আগে কখনও এমন হয়নি। তখনকার সিনেমা নির্মাতা ইনডোরে শ্যুট করতো। কিন্তু যখন সত্যজিৎ রায় এমন সিদ্ধান্ত নেন তখন অনেকেই কিন্তু নাক সিটকিয়েছিল। তবে পথের পাঁচালী সব সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দেয়। এই সিনেমাটি শুধু দর্শকই নয় বরং নির্মাতাদের অবস্থানেরও পরিবর্তন আনে।
গান ও সাউন্ডের ব্যবহার
ভারতীয় মুভিতে নাচ গান থাকবে এটাই স্বাভাবিক ছিল। এমনকি এখনও বলিউড কিংবা দক্ষিণী চলচ্চিত্রে (কন্নড়, মালয়ালম, তামিল, তেলুগু এবং তুলু) নাচ,গান থাকবে এটা বাধ্যতামূলক। যার ফলে মিউজিক কম্পোজাররা বড় সাউন্ড ট্রাক অর্থাৎ ৩-৪ মিনিটের সাউন্ডট্রাক বানাতে অভ্যস্ত ছিল।
১৯৫৫ সালে পথের পাঁচালী বানিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। যে জন্য তাঁর ঝুলিতে এসেছে ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার। ১৯৫৬ সালে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট অ্যাওয়ার্ড পান সত্যজিৎ রায়। সংগৃহীত ছবি
সত্যজিৎ রায় এই ধারণাটিকেই পুরোপুরি ভেঙে দেন। তার চলচ্চিত্রে অপ্রয়োজনীয় গানতো নেই বরং ছোট ছোট সাউন্ডট্রাক ছিল। যখন এই ধারণা প্রথমে তার মিউজিক কম্পোজারকে দেন তারা অবাক হয়ে যান। ১৭ সেকেন্ডর সাউন্ডট্রাক কি হয়? সব মিলিয়ে সিনেমায় মিউজিকের ব্যবহারই বদলে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়।
যথাযথ ডায়লগ
ভারতের সিনেমা নির্দিষ্ট একটি ছাঁচে করেই ডায়লগ দেয়া হতো। জোরে জোরে কথা বলার পাশাপাশি বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় ডায়লগের ব্যবহার করার প্রবণতা ছিল। তবে সত্যজিৎ রায় ডায়লগকে খুব বেশি গুরুত্ব দেন। মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা সিডনি লুমেট পরিচালিত ‘টুয়েলভ অ্যাংরি মেন’(১৯৫৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত) ছবিটির কথা উল্লেখ করে সত্যাজৎ রায় বলেন, “ডায়লগ যদি যথাযথ ব্যবহার করা হয় তাহলে পুরো সিনেমা বাড়তি কিছু প্রয়োজন হয়না।” এরই প্রতিফলন কিন্তু তার চলচ্চিত্রে দেখা যায়।
প্রথন রঙিন বাংলা চলচ্চিত্র 'কাঞ্চনজঙ্ঘা' বানিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। সংগৃহীত ছবি
ল্যান্ডস্কেপ শ্যুট
ফরাসী ফিল্মমেকার জেন রেনওয়ারের দ্য রিভার মুভি দেখে ভার্সেটাইল পরিচালক সত্যজিৎ রায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। হলিউডে কাজ করলেও রেনওয়ার ভারতীয় বিষয়বস্তু নিয়ে মুভিটি নির্মাণ করেছিলেন। আর সেখানে ল্যান্ডস্কেপ দৃশ্যায়ন দারুনভাবে হয়ছিল। সেটি থেকে কিন্তু পথের পাচালীর অনেক দৃশ্যায়ন প্রভাবিত হয়েছে। আর স্টুডিও বাদ দিয়ে আউটডোরে ল্যান্ডস্কেপে পুরো দৃশ্যায়ন করাটা ভারতীয় দর্শকদের জন্য নতুন ছিল। ধীরে ধীরে কিন্তু এই ধরনের দৃশ্যায়ন এখন সর্বত্র দেখা যায়।
সমাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করা
দেবি সিনেমা নিয়ে তৎকালীন সময়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলে। সত্যজিৎ রায় ব্রাহ্মধর্ম ছিলেন বিধায় এই ধরণের সিনেমা বানিয়েছিলেন বলে অনেকেই মন্তব্য করেন। কিন্তু তিনি ধর্মীয় গোড়ামি তুলে ধরেন বলে উল্লেখ করেন।
১৯৭৭ সালে হিন্দি ছবি সতরঞ্জ কি খিলাড়ি-র পরিচালক হিসাবে দেখা যায় সত্যজিৎ রায়কে। সংগৃহীত ছবি
এমনকি যখন তিনি কালজয়ী সিনেমা ‘মহানগর’ শ্যুট করছিলেন তখনও এই ধরনের সিনেমার প্রয়োজনীয়তা কি সেটি নিয়ে সমালোচনা হয়। কিন্তু মুক্তির ৬০ বছর পরও বর্তমান সমাজেও যেন এখনও সিনেমাটি প্রাসঙ্গিক।
সত্যজিৎ রায় সবসময় নতুনকে গ্রহণ করতে চেষ্টা করেছিলেন। বিভিন্ন বিদেশী নির্মাতাদের থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে ভারতকেই যেন শিখিয়ে গেছেন কিভাবে সিনেমা নির্মাণ করতে হয়। যার প্রভাব শুধু ভারতীয় সিনেমা নয় বরং বিশ্বের সিনেমাতে দেখা যায়।