সুরের সাধক হাসন রাজা

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ডিসেম্বর ২১, ২০২১, ০৮:৩১ পিএম

সুরের সাধক হাসন রাজা

মরমি সাধনা আর আঞ্চলিকতার দর্শন চেতনার সঙ্গে সংগীতের সংযোগ ঘটানো অসামান্য ব্যক্তিত্ব হাসন রাজা। বৃহত্তর সিলেট তথা বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলের মরমি সাধক কবি এবং বাউল শিল্পী তিনি। তার প্রকৃত নাম হাসন রাজা। 

অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে, লালন শাহ্ এর প্রধান পথিকৃৎ। দর্শনচেতনার নিরিখে লালনের পর যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নামটি আসে, তা হাসন রাজার। তবে হাসন রাজা নানাদিক থেকে আমাদের কাছে অজানাই থেকে গেছেন। 

যেমন, হাসন রাজা কোন পন্থার সাধক ছিলেন তা স্পষ্ট জানা যায় না। তার পদাবলিতে কোনো গুরুর নামোল্লেখ নেই। কেউ কেউ বলেন তিনি চিশতিয়া তরিকার সাধক ছিলেন। সুফিতত্ত্বের প্রেরণা ও প্রভাব তার সংগীতে ও দর্শনে থাকলেও, তিনি পুরোপুরি এই মতের সাধক হয়তো ছিলেন না। নিজেকে তিনি ‘বাউলা’ বা ‘বাউল’ বলে কখনো কখনো উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি বাউলদের সমগোত্রীয় হলেও নিজে আনুষ্ঠানিক বাউল ছিলেন না। সুফিমতের সঙ্গে দেশীয় লোকায়ত মরমিধারা ও নিজস্ব চিন্তা-দর্শনের সমন্বয়ে তাঁর সাধনার পথ নির্মিত হয় বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। তার সংগীতরচনার পশ্চাতে একটি সাধন-দর্শনের প্রভাব বলা যায়।

মরমি সাধক হাসন রাজা

বাল্যকাল

১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর তৎকালীন সুনামগঞ্জের তেঘরিয়া পরগণার লক্ষণশ্রী গ্রামে জন্ম হয় হাসন রাজার। তার বাবা ছিলেন দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী, মাতা হরমত জাহান বিবি। হাসন রাজার পূর্বপুরুষেরা হিন্দু সম্প্রদায়ের ছিলেন। তাদের আদি বাস ছিল অযোধ্যায়। সিলেটে আসার আগে তারা দক্ষিণ বঙ্গের যশোর জেলার অধিবাসী ছিলেন।

উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি বিশাল ভূসম্পত্তির মালিক ছিলেন। প্রথম যৌবনে তিনি ছিলেন ভোগবিলাসী এক শৌখিন জমিদার, তার এক গানে নিজেই উল্লেখ করেছেন, ‘সর্বলোকে বলে হাসন রাজা লম্পটিয়া’।

অন্যরকম জীবন

১৮৭১ সালে বাবা ও ভাইদের মৃত্যু, তারপর ১৮৯৭ সালে ভয়াবহ ভূমিকম্পে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু দেখে ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকেন তিনি। এরপর তিনি বেশির ভাগ সময় সাদাসিধা পোশাক পরতেন। সাদা ধুতি পরতেন লুঙ্গির মতো পেঁচিয়ে। গায়ে থাকত সাদা গেঞ্জি। পায়ে কাঠের খড়ম। উৎসব-অনুষ্ঠানে গেলে পরতেন জরির কারুকাজখচিত আলখাল্লা।

বর্ষা মৌসুমে বজরা (বৃহৎ নৌকা) সাজিয়ে নৃত্যগীতের ব্যবস্থাসহ তিনি চলে যেতেন এবং বেশ কিছু কাল ভোগবিলাসের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করে রাখতেন। এরই মধ্যে তিনি প্রচুর গান রচনা করে ফেলেন, এসব গান নৃত্য এবং বাধ্য সহকারে গাওয়া হতো। আশ্চর্যের বিষয় হল, এসব গানে তার নিজের জীবনের নৈতিকতা সম্পর্কে, ভোগবিলাসের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে এক সময় নিজের মধ্যে বিরাট পরিবর্তনের সূচনা করেন।

জমকালো পোশাক পড়া ছেড়ে দিলেন। শুধু বহির্জগত নয়, তার অন্তর্জগতেও এলো বিরাট পরিবর্তন। বিষয়-আশয়ের প্রতি তিনি নিরাসক্ত হয়ে উঠলেন। তার মনের মধ্যে এলো এক ধরনের উদাসীনতা। এক ধরনের বৈরাগ্য। সাধারণ মানুষের খোঁজ-খবর নেয়া হয়ে উঠলো তার প্রতিদিনের কাজ। আর সকল কাজের উপর ছিল গান রচনা। তিনি আল্লাহ্র প্রেমে মগ্ন হলেন। তার সকল ধ্যান ধারণা গান হয়ে প্রকাশ পেতে লাগলো। সেই গানে তিনি সুরারোপ করতেন এ ভাবে-

“লোকে বলে বলেরে, ঘর বাড়ি ভালা নায় আমার

কি ঘর বানাইমু আমি, শূন্যের-ই মাঝার

ভালা করি ঘর বানাইয়া, কয় দিন থাকমু আর

আয়না দিয়া চাইয়া দেখি, পাকনা চুল আমার।”

পার্থিব সম্পদ, আকাঙ্ক্ষা আর সম্ভোগের মোহ ত্যাগ করে নিজেই নিজের ভুল বুঝতে পারেন। তখন লেখেন-

“যমের দূতে আসিয়া তোমার হাতে দিবে দড়ি।

টানিয়া টানিয়া লইয়া যাবে যমেরও পুরিরে।।

সে সময় কোথায় রইব (তোমার) সুন্দর সুন্দর স্ত্রী।

কোথায় রইব রামপাশা কোথায় লক্ষণছিরি রে।।

করবায় নিরে হাছন রাজা রামপাশায় জমিদারী।

করবায় নিরে কাপনা নদীর তীরে ঘুরাঘুরি রে।।

(আর) যাইবায় নিরে হাছন রাজা রাজাগঞ্জ দিয়া।

করবায় নিরে হাছন রাজা দেশে দেশে বিয়া রে।।

ছাড় ছাড় হাছন রাজা এ ভবের আশা।

প্রাণ বন্ধের চরণ তলে কর গিয়া বাসা রে।।”

হাসন রাজার বাড়ি

রবীন্দ্রনাথের চোখে হাসন রাজা

১৯২৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর ভারতে দর্শনের ওপর এক আলোচনা সভায় সভাপতির ভাষণে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাসন রাজার গানে বিরাট দর্শন তত্ত্বের কথা উল্লেখ করেছেন।

ভাষণটি 'Modern Review' ( January 1926 ) পত্রিকায় 'The philosophy of Our People' শিরোনামে প্রকাশিত হয়। এর অনুবাদ প্রকাশিত হয় 'প্রবাসী' ( মাঘ ১৩২২ ) পত্রিকায়। ভাষণে হাছন রাজা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-

"পূর্ববঙ্গের এক গ্রাম্য কবির (হাছন রাজা) গানে দর্শনের একটি বড় তত্ত্ব পাই সেটি এই যে, ব্যক্তিস্বরূপের সহিত সম্বন্ধ সূত্রেই বিশ্ব সত্য। তিনি গাহিলেন-

মম আঁখি হইতে পয়দা আসমান জমিন

শরীরে করিল পয়দা শক্ত আর নরম

আর পয়দা করিয়াছে ঠান্ডা আর গরম

নাকে পয়দা করিয়াছে খুসবয় বদবয়।”

তার কিছু গান বিশেষ করে ‘লোকে বলেরে ঘর বাড়ি ভালা নাই আমার’, ‘মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়ারে’,‘সোনা বন্ধে আমারে দেওয়ানা বানাইল’, ‘মরণ কথা স্মরণ হইল না, হাসন রাজা তোর’, ‘কানাই তুমি খেইল খেলাও কেনে’,‘একদিন তোর হইবে রে মরণ রে হাসন রাজা’—এসব গান শুধু সমাদৃত ও জনপ্রিয় নয়, সংগীত সাহিত্যে বিরাট মর্যাদার স্থান দখল করে আছে।

মরমী সাধক হাসন রাজার বিশালতা সম্পর্কে লিখে শেষ করা যাবে না। বাউল সংগীতকে তিনি নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। ১৯২২ সালের ৬ ডিসেম্বর ৬৭ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন। মৃত্যুর এত বছর পরও মরমি কবি হাসন রাজা আমাদের মর্মে গেঁথে আছেন তার চিন্তা ও সুর সাধনার মধ্য দিয়ে।

Link copied!