জনদরদী রাজনীতিবিদ হিসেবে গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহারওয়ার্দীর পরিচয় এ উপমহাদেশে সবার জানা। কিন্তু প্রেমিক সোহরাওয়ার্দীর খবর জানে সেরকম মানুষ হাতে গোনা। আজ ৫ ডিসেম্বর মহান এই নেতার প্রেমকাহনের ছায়াবৃত সেই অধ্যায় নিয়েই কিছু আলাপচারিতা করব।
১৯৪০ সালের ২৭ জুন। কোলকাতার চৌরঙ্গী এলাকার নাখোদা মসজিদে গিয়ে পরমাসুন্দরী পোলিশ বংশোদ্ভূত এক রাশান ভদ্রমহিলা ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর আগের নাম ভেরা আলেকজান্ড্রোভনা ট্রিসেনকো ক্যালডার বদলে নতুন নাম নেন বেগম নূর জাহান।
এর আগে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনিশ্চিত সময়ের ডামাডোলে ১৯৩৮ সালে ভেরা তার স্বামী ইউজিন ট্রিসেনকোকে ইংল্যান্ডের এডিনবার্গে রেখে ভারতে চলে আসেন। বার্লিনে বসবাসকারী ইউজিন ট্রিসেনকো এডিনবার্গ গিয়েছিলেন ডাক্তারি পড়তে। কিন্ত তার স্ত্রী ভেরা এবং সন্তান ওলেগ বার্লিন থেকে রোম এবং রোম থেকে চলে আসেন ভারতের কোলকাতায়। ভারতে আসতে তাকে সাহায্য করেন হাসান সোহরাওয়ার্দী; যিনি সম্পর্কে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মামা। ভেরা ট্রিসেনকো কোলকাতায় খেয়েপরে চলতেন নিজ উপার্জনে। মাঝেমাঝে তার মা তাকে টাকাকড়ি পাঠাতেন রাশিয়া থেকে।
কোলকাতায় আসার পর ভেরার পরিচয় হয় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে। তখন ভেরার বয়স ৩৬ এবং সোহরাওয়ার্দীর ৪৬। তখনো ভেরার কাছে মনে হয়েছে সোহরাওয়ার্দী প্রজ্ঞাবান ও পছন্দসই ব্যক্তিত্বের এক মানুষ। মামার মাধ্যমেই ভেরার সঙ্গে পরিচয় ঘটে সোহরাওয়ার্দীর। দুজনের চেনাজানা এবং নিজ নিজ দাম্পত্য বিচ্ছেদ তাদের আরও কাছে টেনে আনে। প্রায় দুই বছরের চেনাজানার পর তারা সিদ্ধান্ত নেন, তারা বিয়ে করবেন। এর আগে, ১৯২২ সালে সোহরাওয়ার্দীর প্রথম স্ত্রী নিয়াজ ফাতিমার মৃত্যুতে তাদের মাত্র ২ বছরের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটে।
পরে, ১৯৪০ এর শেষ দিকে তারা আনুষ্ঠানিক বিয়ে করলেও সেবছরই তাদের সন্তান, প্রখ্যাত ব্রিটিশ অভিনেতা এবং রাজনীতিবিদ রাশিদ সোহরাওয়ার্দী ওরফে রবার্ট অ্যাশবির জন্ম হয়। বেগম আখতার সোলাইমান নামে তাদের এক কন্যা সন্তানও ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর এই দুই সন্তানের ভূমিকা ছিল বিপরীতমুখী। বেগম আখতার সোলাইমান যেখানে ইয়াহিয়া সরকারের পক্ষে কাজ করেছেন সেখানে রবার্ট অ্যাশবি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে উচ্চকিত ছিলেন।
ঘটনার ঘনঘটা ঘটার এখনো বাকি। সোহরাওয়ার্দী এবং ভেরা ট্রিসেনকোর বিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এক ঘটনা। তাদের বিয়ে আদালত অবধি গড়িয়েছিল। বিয়ের আগে, ভেরা তার পূর্বতন স্বামী ইউজিন ট্রিসেনকোকে তার ইসলাম ধর্মগ্রহণ সম্পর্কে জানিয়ে তাকে ইসলাম গ্রহণ করতে বলেছিলেন! কিন্তু ইউজিন সেটা প্রত্যাখ্যান করেন। তখন ভেরা কোলকাতা হাইকোর্টে বিয়ে বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেন। প্রথমে ভেরার মামলায় বিবাদী পক্ষ থেকে কোন প্রতিবাদ না থাকায় ইসলামি শরিয়া আইন অনুসরণে আদালত ভেরার পক্ষে রায় দেয়। কিন্তু রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি লেখার আগেই আদালত এই রায় প্রত্যাহার করে। এবং তিনজন অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দেয় মামলার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের জন্য। পরে বিভিন্নভাবে বিচার বিশ্লেষণের পর আদালত ভেরার আবেদন খারিজ করে দেয়।
পরে আদালত ভেরার বিপক্ষে রায় দিলেও ইউজিন ট্রিসেনকোর তরফ থেকে কোন বাঁধা না থাকায় ভেরা-সোহরাওয়ার্দী তাদের বৈবাহিক জীবন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
সোহরাওয়ার্দীর জীবনে ভেরার প্রভাব ছিল বিপুল। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে সোহরাওয়ার্দীর জয় এবং বাংলার প্রধানমন্ত্রী দৌঁড়ে ভেরার নির্বাচনী কৌশল ব্যবহৃত হয়েছিল। এমনকি বিভিন্ন রাজনৈতিক নেগোসিয়েশনে সোহরাওয়ার্দীকে পরামর্শ দিতেন ভেরা। সেসময়ে কোলকাতায় সমাজকর্মী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে ভেরা ট্রিসেনকোও বেশ আলোচিত এবং প্রভাবশালী ছিলেন।
কিন্তু কথায় আছে, 'বড়র পিরিতি বালির বাঁধ ক্ষনেকে হাতে দড়ি, ক্ষনেকে চাঁদ।' ভেরা-সোহরাওয়ার্দীর প্রেমও নিষ্কন্টক ছিল না। সুখের হয়নি তাদের বৈবাহিক বা প্রেমের জীবন। বিয়ের ১১ বছরের মাথায় ১৯৫১ সালে তারা আলাদা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
বিচ্ছেদের পর ভেরা ট্রিসেনকো ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাসের চরিত্র ভেরা ভ্লসা নামে আমেরিকায় থিতু হন। বিচ্ছেদের ১২ বছর পর ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর বৈরুতের এক হোটেলে মারা যান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এবং ভেরা মারা যান আরও ২০ বছর পর। ১৯৮৩ সালে।
ভেরা ট্রিসেনকো এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রেম বিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে আলোচিত কিন্তু ছায়াবৃত এক অধ্যায়।