এ মাসেই ষষ্ঠ বাংলাদেশী হিসাবে বাবর আলীর এভারেস্ট বিজয়ে আনন্দের রেশ না কাটতেই নতুন আরেকটি অর্জনের বাংলাদেশ মুকুটে।
এ যাবতকাল পর্যন্ত নিজ দেশের পতাকা হাতে সর্বোচ্চ উচ্চতা থেকে লাফ দিয়ে দেখিয়ে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে ঠাঁই করে নিচ্ছেন বাংলার দামাল ছেলে আশিক চৌধুরী।
৪ হাজার ফুটের কাছাকাছি আসার পর প্যারাস্যুটের বাঁধন খুলে পরবর্তীতে মাটিতে নেমে আসেন আশিক।
যুক্তরাষ্ট্রের মেমফিসের উইংস ফিল্ড বিমানঘাঁটি থেকে স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে আটটায় বিমানে চড়েন।এই উদ্যোগের নাম রাখা হয়েছে ‘দ্য হাইয়েস্ট এভার স্কাইডাইভ উইথ আ ফ্ল্যাগ’।
অজানাকে জানা, অদেখাকে দেখা আর অসম্ভবকে সম্ভব করার ঝোঁক মানুষের চিরকালের। তবে এই বাসনা কারও কারও মধ্যে যেন একটু বেশিই প্রবল, আশিক যেন তারই একটি বড় দৃষ্টান্ত।
পাখির মতো আকাশে উড়ে উড়ে, মেঘের ভাজে ঘুড়ে বেড়ানো আশিক একজন বাংলাদেশি স্কাইডাইভার। পাইলট পরিবারের সন্তান আশিকের ছোটবেলা থেকেই উড়ে বেড়ানোর শখ।
কৌতূহল আর কল্পনার মতো সুন্দর এই রোমাঞ্চের নাম স্কাইডাইভিং। বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে পাখির মতো এমন করে উড়তে উড়তে কেউ মাটি স্পর্শ করছেন, এমন নান্দনিক দৃশ্য বিশ্ববাসী দেখলো স্কাইডাইভার আশিক চৌধুরীর কল্যাণে।
পেশায় একজন ব্যাংকার হয়েও আশিক রপ্ত করেছেন বিমান চালানো। তবে তার স্বপ্ন আবদ্ধ থাকেনি বিমানের ককপিটের মধ্যে। ইতোমধ্যেই অন্তত ৫০ বার ঝাঁপ দিয়েছেন, হাজার ফুট উচ্চতার বিমান থেকে। অর্জন করেছেন স্কাইডাইভারের সার্টিফিকেটও।
আশিকের পৈতৃক চাঁদপুরে, তবে বাবার চাকরির সুবাদে আশিকের বেড়ে ওঠা যশোরে।
স্কুল-কলেজের পাট চুকিয়েছেন সিলেট ক্যাডেট কলেজে। এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে (আইবিএ)। ২০০৭ সালে স্নাতক হয়েই যোগ দেন দেশের বেসরকারি একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে।
একটু ছুটিছাটা পেলেই ছুটতেন রোমাঞ্চের টানে। ২০১১ সাল পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানেই চাকরি করেছেন। তারপর পড়তে যান বিলেতে। স্বপ্নের বীজ যেন যেন ডালপালা ডালপালা ছড়াতে থাকে সেখানেই।
২০১২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর, আশিক চৌধুরীর স্বপ্নপূরণের দিন। যুক্তরাজ্যের ব্র্যাকলি শহরের হিনটন স্কাইডাইভিং সেন্টারে হাজির হলেন তিনি।
জাম্পস্যুট, হেলমেট, প্যারাস্যুট, গগলসসহ যাবতীয় সুরক্ষাসামগ্রী পরে উঠে পড়লেন প্লেনে, সঙ্গে দুজন প্রশিক্ষিত স্কাইডাইভার। কয়েক হাজার ফুট ওপরে ওঠার পর একজন স্কাইডাইভার আশিককে সঙ্গে নিয়ে বিমান থেকে লাফ দেন।
একটা কিন্তু যেন রয়েই গেছে স্কাইডাইভারের স্বীকৃতি পাবার জন্য লাইসেন্স প্রয়োজন। আর সেটা পাবার জন্য পাড়ি দিতে হয় লম্বা পথ। থিওরি জানা, বই পড়া, লিখিত পরীক্ষা দেয়া এবং ন্যূনতম ২৫ বার বড় কোনো উচ্চতা থেকে সফলতার সঙ্গে সঙ্গে থাকতে হবে স্কাইডাইভিংয়ের অভিজ্ঞতাও।
তবে সবগুলো ধাপ পেরিয়েই লাইসেন্স হাতে পেয়েছেন আশিক।
এর পাশপাশি লন্ডন বিজনেস স্কুল থেকে মাস্টার্স শেষ করে আমেরিকান এয়ারলাইন্সের লন্ডন অফিসে যোগ দেন তিনি। সে পর্যন্ত কিছুটা সময় বিরতি নিলেও পেশাদার স্কাইডাইভারের সাহায্য ছাড়া লাফ দেয়ার ইচ্ছা কখনই তাকে ছেড়ে যায়নি। আকাশে পাখির মতো উড়ে বেড়ানোর রোমাঞ্চ যেন সব সময়ই তাড়া দিতো তাকে।
বাবা বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডর হারুন চৌধুরীর কথা মনে পড়ে তার। ছোটবেলা থেকেই পাইলট বাবার কাছে শুনেছেন আকাশে ওড়ার কত গল্পই। গল্প আর বাস্তবতার ফারাকটা ঘুচিয়ে ফেলতে ইচ্ছা করে আশিকের।
২০১৪ সালে ভর্তি হন একটি প্রাইভেট পাইলট প্রশিক্ষণ স্কুলে। এক বছর ধরে চলে প্রশিক্ষণ। তারপর একদিন ককপিটে বসেন আশিক। লন্ডন থেকে উড়োজাহাজ নিয়ে ছুটে যান পাশের এক শহরে।
স্মৃতিচারণ করে আশিক বলেন, “এরপর মাঝেমধ্যেই প্লেন ভাড়া করে পরিবার নিয়ে লন্ডন থেকে ম্যানচেস্টারে চলে যেতাম। লাঞ্চ করে আবার ফিরতাম লন্ডনে। সেই দেশে এটা খুবই সাধারণ ঘটনা।”
পাইলট হলেও স্কাইডাইভিংয়ের পোকাটা রয়েই যায় আশিকের মাথায়। পেশাগত কাজের চাপে ফুরসত মেলেনা প্রশিক্ষণ নেওয়ার।
আমেরিকান এয়ারলাইনসের এশিয়া ও ইউরোপ অঞ্চলের ফিন্যান্স বিভাগের প্রধানের পথ থাকা অবস্থাতেই চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দেশে ফিরে দেন বহুজাতিক হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন-এইচএসবিসি ব্যাংকে। ঢাকায় চার বছর দায়িত্ব পালন শেষে গত বছরের শুরুতে চলে যান সিঙ্গাপুরে।
নতুন পেশাগত জীবন শুরু হওয়ার পর সপরিবারে চলে আসেন। তারপর যেন আশিকের স্কাইডাইভিংয়ের স্বপ্নটা যেন নতুন করে জ্বলে ওঠে। সিঙ্গাপুরের কাছাকাছি দেশ থাইল্যান্ডে আছে স্কাইডাইভিংয়ের দারুণ সুযোগ, সেইসঙ্গে সিঙ্গাপুর যাতায়াতও তুলনামূলক সহজ।
আশিক যোগাযোগ করলেন থাই স্কাই অ্যাডভেঞ্চার কোম্পানির সঙ্গে। লিখিত পরীক্ষাসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষে গত বছর হাজির হলেন অনুশীলনে। অবশেষে এক দশকের বেশি সময় পর স্কাইডাইভিংয়ের উদ্দেশ্যে উঠে পড়লেন উড়োজাহাজে।
একজন পেশাদার স্কাইডাইভারকে সঙ্গে নিয়ে লাফ দিলেন আশিক। সেই থেকে শুরু। সপ্তাহ শেষে প্রশিক্ষণের জন্য সিঙ্গাপুর থেকে ছুটে যেতেন থাইল্যান্ডে। প্রতি সপ্তাহে দুই দিন অনুশীলন করে সিঙ্গাপুর ফিরে অফিস ধরতেন। দ্বিতীয় সপ্তাহের কোনো প্রশিক্ষক ছাড়াই লাফ দিলেনআশিক।
কেবল দুজন পেশাদার স্কাইডাইভার থাকলেন আশিকের দুই পাশে। আশিক নিজে নিজের প্যারাস্যুট খুলে নেমে এলেন মাটিতে। এভাবে ১০ চলার পর সহযোগিতার জন্য সঙ্গে থাকল না কেউ। লাফ দিলেন একা। সেই লাফে সফলও হলেন আশিক। এভাবে চার সপ্তাহ পর ২৫তম বার লাফ দেন আশিক।
এভাবে আরও কয়েকবার লাফ দেওয়ার পর আশিকের হাতে তুলে দেওয়া হয় স্কাইডাইভিংয়ের লাইসেন্স। এই লাইসেন্স দেখিয়ে বিশ্বের যেকোনো দেশে স্কাইডাইভিং করতে পারবেন আশিক, আর যার শুরুটাই তিনি করতে চেয়েছিলেন লাল-সবুজ পতাকা হাতে রেকর্ড গড়ে।
এক্সট্রিম স্পোর্টস হিসাবে বিবেচিত স্কাইডাইভিংয়ে ঝুঁকি কতখানি –এমন প্রশ্নের জবাবে আশিক চৌধুরী বলেন, বর্তমান প্রযুক্তির কল্যাণে স্কাইডাইভিংয়ে প্রাণহানীর সম্ভবনা অনেক কম। মনোজাগতিক বাধা অতিক্রম আর প্রশিক্ষণে রপ্ত কৌশলগুলো ব্যবহার করতে পারলে কাজটি বেশ সহজ।
আবহাওয়া ঠিক থাকায় পুরবনির্ধারিত তারিখ অনুযাযী গত ২৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের মেনফিস্ট শহরের টেনেসি স্টেটে স্কাইডাইভিং করেন আশিক। সফলতার পর এখন কেবল ‘ওয়ার্ল্ড এয়ার স্পোর্টস ফেডারেশনের’ চূড়ান্ত ঘোষণার অপেক্ষা। এই সংস্থার একজন প্রতিনিধি গতকাল উইংস ফিল্ড বিমানঘাঁটিতে উপস্থিত ছিলেন। ১ হাজার ফুট উপর থেকে যখন লাফ দেয়ার সময় তখন আশিক চৌধুরীর হাতে ছিলো বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা।
সফলতার সাথে যখন পা রাখেন মাটিতে, এখন শুধু আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মাধ্যমে অতীতের দুটি রেকর্ড ভেঙে গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নিজের পাশাপাশি বাংলাদেশের নাম লেখানোর অপেক্ষায়।