আমেরিকার রক্তেই মিশে আছে যুদ্ধ

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

মার্চ ২০, ২০২২, ১২:৪৪ এএম

আমেরিকার রক্তেই মিশে আছে যুদ্ধ

যুদ্ধ আর হানাহানি হচ্ছে আমেরিকার প্রাণ। যুদ্ধ-হাঙ্গামা না থাকলে আমেরিকার অর্থনীতি বাঁচবে না। গত শতকের যুদ্ধ এবং এর প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ওই সময়ে শতকরা ৮০ ভাগ যুদ্ধই বাঁধিয়েছে অথবা পেছনে কলকাঠি নেড়েছে এই আমেরিকা। এই যুদ্ধ বাঁধিয়ে তারা নিজেদের ফায়দা হাসিল করে। যুদ্ধের আগুনে আমেরিকা অস্ত্র বিক্রির ‘আলুপোড়া’ খাওয়ার আয়োজন করে। প্রতিটি যুদ্ধেই তারা অস্ত্রবিক্রির পসরা সাজিয়ে বসে। এখানেই শেষ নয়, এই বিশ্বমোড়ল নিজেরাও মাঠে নেমে যুদ্ধ করে অন্যদের উৎসাহিত করে।

নো আর্মস বিজনেস উইদাউট এনিমিস ইজ পসিবল। শত্রু ছাড়া যুদ্ধ হয় না। যুদ্ধ ছাড়া অস্ত্র ব্যবসাও হয় না। তাই প্রথমে শত্রু বানাও, এরপর যুদ্ধ বাঁধাও। অস্ত্রব্যবসার খেল শুরু। দ্য ওয়্যার ইজ জাস্ট দ্য ডিফরেন্ট নেম ফর সাকসেসফুল বিজনেস! দ্যটস ইট!

জ্যাভলিন নামের এই ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী ক্ষেপনাস্ত্রের চাহিদা এখন প্রচুর

ইউক্রেন যুদ্ধটাও বাঁধিয়ে দিয়ে সটকে পড়েছে আমেরিকা। এই যুদ্ধে ইউক্রেন বা রাশিয়া কেউই আমেরিকার শত্রু বা মিত্র নয়। বরং আমেরিকার লক্ষ্য তার দেশের মজুদ বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের বেচাবিক্রি করা। মূলত ইউক্রেন যুদ্ধ ‘লাগিয়ে’ দিয়ে এরমধ্যেই বড়সড় একটি অস্ত্রবিক্রির হাট বানিয়ে নিয়েছে আমেরিকা। এই হাটের অস্ত্র ক্রেতা এখন গোটা ইউরোপের দেশগুলো। আর অস্ত্র বিক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র একা। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের ঝনঝনানি অনেকটাই স্তিমিত বা পর্যাপ্ত অস্ত্র তারা আমেরিকার কাছ থেকে কিনে ফেলেছে। বিশ্বের অন্যান্য দিকেও নেই অস্ত্র বিকিকিনির তোড়জোড় কমে এসেছে।

এ অবস্থায় ইউক্রেনের মতো এমন একটি বাজার আমেরিকার সামনে দরকার ছিল। সেটিরও ‘শুভ উদ্বোধন’ করে দিয়েছে আমেরিকা। বিশ্ববাসী হয়তো সাদা চোখে দেখছে, রাশিয়া নামের এক গোঁয়ার একটি দেশ তার প্রতিবেশী দেশে হামলা চালিয়েছে। মূলত পেছনের দৃশ্যপট ভিন্ন। কে যুদ্ধটি বাঁধিয়ে দিল, কে ইউক্রেনকে আশ্বস্ত করে যুদ্ধ নামের গাছে তুলে দিয়ে মই কেড়ে নিল— এগুলোই আসল ঘটনা। এর নেপথ্য শুধুই আমেরিকা ও তার অস্ত্রবিক্রির দূরভিসন্ধি।    

Romanian Army soldiers deploy a ground-to-air missile launch pad during a joint military exercise with the US Army.

ইউক্রেনে যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আবারও অস্ত্র বিক্রির হাট বসিয়েছে দুনিয়া জুড়ে ‘গণতন্ত্র রপ্তানিকারক’ দেশটি। এরমধ্যেই রমরমা হয়ে উঠেছে মার্কিন অস্ত্রের বাজার। ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ রুশ আগ্রাসনে অনেকটা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আমেরিকার কাছে ছুটে গেছে নানা ধরনের উন্নত অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামাদি কেনার জন্য। এরইমধ্যে বিভিন্ন দেশ তাদের অস্ত্র চাহিদার তালিকা আমেরিকার কাছে পেশ করেছে।

জার্মানি আমেরিকার সঙ্গে বিশাল অস্ত্র চুক্তির কাছাকাছি রয়েছে। মার্কিন লকহিড মার্টিন কোম্পানি নির্মিত ৩৫টি এফ-৩৫ জঙ্গিবিমান কেনার জন্য চুক্তিবদ্ধ হতে যাচ্ছে জার্মানি। এছাড়া দেশটি আমেরিকার কাছ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও কিনতে চায়।

ইউরোপের আরেক দেশ পোল্যান্ড। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আলোচিত এই দেশটি জরুরিভিত্তিতে আমেরিকার কাছ থেকে রিপার ড্রোন কেনার চেষ্টা করছে। রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম এই অত্যাধুনিক ড্রোনটি কিনতে মরিয়া তারা। এছাড়া পূর্ব ইউরোপের আরো বেশ কিছু দেশ বিশেষভাবে বিমান বিধ্বংসী স্টিঙ্গার ক্ষেপণাস্ত্র এবং ট্যাংক বিধ্বংসী জ্যাভেলিন ক্ষেপণাস্ত্র কেনার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। এসব অনুরোধ ও দাবি পূরণের জন্য পেন্টাগন একটি কমিটি গঠন করে কাজ শুরু করে দিয়েছে।

অনেক বিশ্লেষকের মতে, ইউক্রেনকে নানা বুদ্ধি দিয়ে গাছে তুলে এখন মই কেড়ে নিয়েছে আমেরিকা। মই কেড়ে নিলেও সমানে ইউক্রেনের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে চলেছে আমেরিকা। অথচ মূল যে সঙ্কটটি নিয়ে এই যুদ্ধের সূচনা, ইউক্রেনের নেটোতে যোগদানের চেষ্টা, সে ব্যাপারে কিন্তু আমেরিকা তখন ইউক্রেনের পাশে থাকতে একবাক্যে রাজি ছিল। রাশিয়া দাবি করেছিল, ইউক্রেনকে কখনই নেটো জোটের সদস্য করা চলবে না এবং পূর্ব ইউরোপে নেটো নতুন করে কোনো সম্প্রসারণ করতে পারবে না। এর জবাবে আমেরিকা জানিয়েছিল, রাশিয়ার এমন দাবি মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তার মানে এমন মন্তব্যে ইউক্রেন মহা উৎসাহ পায় এবং নেটোতে যোগদানের সার্বিক আয়োজন করতে শুরু করে। পরিস্থিতি বিবেচনায় শেষ পর্যন্ত রাশিয়া আলোচনার চেয়ে ইউক্রেনে হামলাকেই সমাধান হিসেবে বেছে নেয়। লেগে যায় যুদ্ধ।

RT

আধুনিক জঙ্গিবিমান এখন যুদ্ধের ফলাফল ঘুরিয়ে দেয়। ছবি: সংগৃহীত

এই যে ‍যুদ্ধটি বাঁধল, তার কুফল পাচ্ছে রাশিয়া ও ইউক্রেন। এর কুপ্রভাব পড়ছে গোটা বিশ্বেই। কিন্তু এর পুরো সুফল ভোগ করবে আমেরিকা। আর সেটি অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমেই। আমেরিকার এই যুদ্ধ বাঁধানো ও অস্ত্র বিক্রির ব্যবসা নিয়ে বহু গবেষক বহুকাল ধরেই গবেষণা করেছেন। আমেরিকার এই কূটকৌশল সম্পর্কে তারা নানা সময়ে সতর্ক করেছেন। কিন্তু কেউই সতর্ক হয়নি।  

২০০২ সালের ন্যাশনাল রিভিউয়ের এক কলামে মার্কিন কলামিস্ট জোনা গোল্ডবার্গ ইতিহাসবিদ মাইকেল লেডিনের একটি লেখা সম্পর্কে আলোকপাত করেছিলেন। লেখাটি ইতিহাসবিদ মাইকেল লেডিন তার নামে ‘লেডিন ডকট্র্রিন’ শিরোনামে রচনা করেছিলেন; যেখানে বলা হয়েছিল, ‘প্রতি ১০-১২ বছর পরপর আমেরিকা কিছু ছোট্ট দেশকে বেছে নেয় এবং একে উত্খাত করে শুধু বিশ্বকে জানান দিতে যে আমরা ব্যবসা বুঝি।’ এ ব্যবসার মধ্য দিয়ে আমেরিকা পৃথিবীকে জানান দেয় যে, তাদের কর্তৃত্ববাদী আগ্রাসী অস্তিত্ব সম্পর্কে। ওই ব্যবসার প্রসারের সঙ্গে জড়িত যুদ্ধের আবহাওয়া; আমেরিকা এ মুহূর্তে সেই কাজটিই করছে।

কাতার এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ক্রয়ের আবেদন করেছে - আমেরিকা বাংলা

মার্কিন এফ-৩৫ জঙ্গিবিমান। যুদ্ধে শক্তিশালী এক অস্ত্র। ছবি: সংগৃহীত

প্রতিটি যুদ্ধের প্রধান উপকরণ হলো অস্ত্র। অস্ত্রের মজুদের ওপরই নির্ভর করে যুদ্ধের ফলাফল। আবার এ যুদ্ধের ওপরই নির্ভর করে অস্ত্রের ব্যবসা। যে কোনো ব্যবসার মূলনীতি হলো উৎপাদিত পণ্য অধিক মুনাফায় বিক্রি করার এন্তেজাম করা, সেই নীতিটি অস্ত্র ব্যবসার ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। যে পরিমাণ অস্ত্র আমেরিকার হাতে সব সময় মজুদ থাকে, সেগুলো কোনো না কোনোভাবে তো বিক্রি করতে হবে। সেক্ষেত্রে যুদ্ধ ও যুদ্ধের আবহ না তৈরি হলে ব্যবসায় মন্দাভাব দেখা দেবে, সেটিই স্বাভাবিক। তাই কখনো দুই বা ততোধিক দেশ অথবা একটি অঞ্চলের মধ্যে বা দেশের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে যুগ যুগ ধরে এ ব্যবসা ভালোভাবেই চালিয়ে আসছে আমেরিকা।

‘কনভেনশনাল আর্মস ট্রান্সফারস টু ডেভেলপিং নেশনস, ২০০৮-২০১৫’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের মতো এর আগের বছরও উন্নয়নশীল দেশগুলো ছিল অস্ত্রের মূল ক্রেতা। এর মধ্যে কাতার সবচেয়ে বেশি, ১৭ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনেছে এর আগের বছর। মিসর ১২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনতে চুক্তি করেছে। পিছিয়ে নেই সৌদি আরবও, এর আগের বছর তারা এ খাতে ব্যয় করেছে ৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। অস্ত্র কেনার তালিকায় এরপরের দেশগুলোর নাম দক্ষিণ কোরিয়া, পাকিস্তান, ইসরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইরাক। 

US Air Force Quietly Starts MQ-9 Reaper Drone Operations in Poland

রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম আকাশের রাজা মার্কিন রিপার ড্রোন। ছবি: সংগৃহীত

অস্ত্র বিক্রির তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও রয়েছে ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীনের নাম। পরের স্থানগুলোয় আছে সুইডেন, ইতালি, জার্মানি, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য ও ইসরায়েল। তবে অস্ত্র বিক্রিতে আমেরিকা সব সময়ই শীর্ষে থাকে। অস্ত্রের উৎপাদন, মজুদ ও বিক্রিতে শীর্ষস্থান আমেরিকারই। পৃথিবীর প্রথম সারির প্রায় সব অস্ত্র কোম্পানি আমেরিকার মালিকানাধীন। প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কেনাবেচা হয়। এর মধ্যে ৪০ শতাংশেরও বেশি অস্ত্র বিক্রির কৃতিত্ব মার্কিন কোম্পানিগুলোর। এটি খোদ জাতিসংঘের তথ্য। 

ওবামা প্রশাসনের ধারাবাহিকতায় অস্ত্র রফতানিকে গতিশীল করে গেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। অস্ত্র রফতানিতে তাদের চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো এ মূহুর্তে আপাতত কেউ নেই। এ কথা বলেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান আর্মস অ্যান্ড মিলিটারি এক্সপেন্ডিচার (এসআইপিআইআর) প্রোগ্রাম। আবার ব্যক্তিগতভাবে অস্ত্র বহনের হার যুক্তরাষ্ট্রেই বেশি। ২০১৭ সালের সুইজারল্যান্ডের ‘গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ’-এর গবেষণা মতে, যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যা ৩২ কোটি ৬৪ লাখ ৭৪ হাজার। আর মোট ব্যক্তিগত অস্ত্রের সংখ্যা ৩৯ কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার। এ হিসাবে প্রতিজন একটির বেশি অস্ত্র বহন করে। অর্থাৎ আমেরিকা নিজেরা অস্ত্র শুধু বিক্রিই করে না, নিজেদের নাগরিকরাও সমানে তা ব্যবহার করে, কারণে-অকারণে ব্যবহার করে। এভাবেই যুদ্ধ, অস্ত্র, রক্তপাত আর হানাহানি এই জাতির অস্থিমজ্জায় মিশে আছে।  

লেখক: সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ

 

Link copied!