মহামারি করোনায় টানা দুই বছর ব্যবসায় ছিল নিদারুন মন্দা। সেই মন্দাকাল কেটে গেছে। করোনার প্রকোপও নেই। এরইমধ্যে ঈদ-উল ফিতরকে কেন্দ্র করে বাজারে কেনাকাটা জমে উঠেছে। এ বছর তাই রেকর্ড পরিমান লেনদেনের আশা করছেন ব্যবসায়ীরা। এতে গত দুই বছরের ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নিতে পারবেন তারা। আর অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এবারের দুটি ঈদের বাণিজ্য দেশের থমকে পড়া অর্থনীতিকে ফের গতিশীল করে তুলবে।
আর্থিক অচলাবস্থা কাটানোর আশা
এবার রোজার মাসেই পহেলা বৈশাখ উৎসব পালিত হয়েছে। যার ফলে ঈদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ব্যবসার বাড়তি লাভ যোগ হয়। কেন না এবার রোজার মাসের শুরু থেকেই কেনাবেচা রমরমা অবস্থা বিরাজমান। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ঈদের কেনাকাটার সাথে যদি রোজার বাজার ধরা হয়, তাহলে লেনদেন এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। সর্বোচ্চ দুই লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি হতে পারে লেনদেন। আর এবার রাজনৈতিক দলসহ নানা ধরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের ইফতার পার্টির আয়োজন তো আছেই। এটিও অর্থনীতির জন্য একটি ইতিবাচক দিক।
সর্বোচ্চ লেনদেন পোশাক খাতে
এবারের ঈদ ঘিরে অন্তত দেড় লাখ কোটি টাকার কেনাকাটা হবে সারা দেশে। দেশে মোট পরিবারের (খানা) সংখ্যা তিন কোটি ৯৩ লাখ ৩০ হাজার। এর মধ্যে দুই কোটি ৮২ লাখ ৬০ হাজার পরিবার গ্রামে, এক কোটি ১০ লাখ ৭০ হাজার পরিবার শহরে বাস করে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ বলছে, মূলত রোজার প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হয় ঈদের কেনাকাটা। চলে ঈদের এক সপ্তাহ পর পর্যন্ত।
ঈদ কেনাকাটার শীর্ষে থাকে পোশাক পরিচ্ছদ। এর পরই জুতা-স্যান্ডেল, লুঙ্গি-গেঞ্জি-গামছা। খাদ্যপণ্যের মধ্যে সেমাই-চিনি, মাংস, মিষ্টি, গ্রোসারি পণ্য। প্রসাধনী, ইলেকট্রনিকস, টিভি, মোবাইলসহ নানা ধরনের পণ্যও কেনা হয় ঈদ উপলক্ষে। এর বাইরে ঈদের ছুটিতে পর্যটন খাতেও মানুষ অর্থ ব্যয় করে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি পরিবার ন্যূনতম পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা ব্যয় করে ঈদকে ঘিরে। সামর্থ্য অনুযায়ী এই অঙ্ক আরো বাড়ে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, খাদ্যপণ্য, পোশাক, বিনোদন ও পরিবহন খাতে বাড়তি এই অর্থ যোগ হবে। সরকারি চাকরিজীবী, দোকানের কর্মচারী, পোশাক ও বস্ত্র খাতের শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণির শ্রমজীবীদের বোনাসও এই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যোগ হবে। উৎসবকে ঘিরে বিভিন্ন খাতে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতবদল হওয়ায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তেজিভাব এসেছে এরই মধ্যে।
কোন খাতে কত লেনদেন
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের তথ্য মতে, ঈদে পোশাকসহ পরিধেয় খাতে ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার কোটি, জুতা-কসমেটিকস তিন হাজার কোটি, ভোগ্য পণ্য সাত হাজার কোটি, জাকাত-ফিতরা ও দান-খয়রাত ৩৮ হাজার কোটি, যাতায়াত বা যোগাযোগ খাতে ১০ হাজার কোটি, সোনা-ডায়মন্ড পাঁচ হাজার কোটি, ভ্রমণ খাতে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি, ইলেকট্রনিকস চার হাজার কোটি, স্থায়ী সম্পদ ক্রয় এক হাজার কোটি, পবিত্র ওমরাহ পালন তিন হাজার কোটি, আইন-শৃঙ্খলাসহ অন্যান্য খাতে লেনদেন হয় এক হাজার কোটি টাকা।
গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্স ফেলো ড. খন্দকার মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ঈদে গ্রাম ভিত্তিক রাজনীতি বৃদ্ধির ফলে অর্থনীতির চাঙ্গার পাশাপাশি বিকেন্দ্রীকরণ হয়। করোনার প্রভাবে গত দুই বছর ঈদে অর্থনীতি ধুঁকেছে। এবার ঈদ বাজারকে ঘিরে দেশের অর্থনীতি আরো চাঙ্গা ও গতিশীল হচ্ছে।এর বাইরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সও ঈদ অর্থনীতিতে যুক্ত হবে। কারণ ঈদের সময়ে প্রবাসীরা তাঁদের আত্মীয়-স্বজনের বাড়তি ব্যয় মেটাতে টাকা পাঠান।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, এবার রোজায় অতিরিক্ত এক লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন যোগ হবে। ’তাঁর হিসাব মতে, পোশাকের বাজারে যোগ হবে ৬০ হাজার কোটি টাকা। নিত্যপণ্যের বাজারে যোগ হবে ২৮ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা। ধনীদের দেওয়া জাকাত ও ফিতরা বাবদ যোগ হবে ৩৮ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা। পরিবহন খাতে অতিরিক্ত যোগ হবে ৬৫০ কোটি টাকা। রোজার ঈদকে কেন্দ্র করে ভ্রমণ ও বিনোদন খাতে যোগ হবে চার হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া আয়ের হিসাবে সাড়ে ১২ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, বেসরকারি খাতের ৬০ লাখ দোকান কর্মচারী, তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের ৭০ লাখ শ্রমিকের বোনাস ঈদ অর্থনীতিতে যোগ হবে।
বাড়তি রপ্তানি ও রেমিট্যান্স
ঈদের আগে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স থেকে আয়ের পরিমানও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যংকের সবশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্চ মাসে ১৮৬ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। যা ফেব্রুয়ারি মাসের চেয়ে ৩৭ কোটি ডলার বা ৩ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা বেশি। ফেব্রুয়ারি মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৪৯ কোটি ডলার বা ১২ হাজার ৮৮২কোটি টাকা। আর জানুয়ারিতে এসেছিল ১৭০ কোটি ডলার বা ১৪ হাজার ৬২০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যংকের সবশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্চ মাসে ১৮৬ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। যা ফেব্রুয়ারি মাসের চেয়ে ৩৭ কোটি ডলার বা ৩ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা বেশি। ফেব্রুয়ারি মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৪৯ কোটি ডলার বা ১২ হাজার ৮৮২কোটি টাকা। আর জানুয়ারিতে এসেছিল ১৭০ কোটি ডলার বা ১৪ হাজার ৬২০ কোটি টাকা।
আর একই সময়ে ‘রপ্তানি আয়ে ৩২ থেকে ৩৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার এরই মধ্যে চাঙা হয়েছে। তবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষজনের সংকট থেকেই যাবে।’