সর্বসম্মতিতে ‘গ্লাসগো জলবায়ু চুক্তি’ সাক্ষরের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক সম্মেলন কপ-২৬। করোনা ভাইরাসের প্রকোপে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা থাকায় কপ-২৬ সম্মেলন প্রায় একবছর বন্ধ ছিল। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বিশ্বের ১৯৭ টি দেশের প্রতিনিধিরা বৈশ্বিক জলবায়ুর বিপর্যয়কর অবস্থা ঠেকাতে প্রায় মতৈক্যে পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু ভারত-চীনের আপত্তিতে শেষ পর্যন্ত তা বরং দূর্বল অবস্থায়, দূর্বল একটি চুক্তির মাধ্যমে শেষ হয়েছে। নইলে হয়তো এই সম্মেলেনেই ২০৩০ সালের মধ্যেই বিশ্বজুড়ে জ্বালানী হিসেবে কয়লার ব্যবহার নিষিদ্ধ করা সম্ভব হতো। তবে এটাও আশার কথা যে, শেষ পর্যন্ত অন্তত কয়লার ব্যবহার কমানোর ব্যাপারে সবদেশের প্রতিনিধিরা একমত হতে পেরেছেন।
এই সম্মেলনের শেষে এর ফলাফল দেখে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘এটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং একটি সম্মেলন ছিল‘। গুতেরেস ’গ্লাসগো জলবায়ু চুক্তি’কে বলেছেন ‘কম্প্রোমাইজ’ বা ‘সমঝোতা’। এই প্রসঙ্গে বিশ্ব নেতাদের সদিচ্ছা সম্পর্কে বলেন, ‘তারা বেশ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কিন্তু সামষ্টিকভাবে তাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা জলবায়ু নিয়ে যে গভীর সঙ্কট রয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে যথেষ্ট ছিল না’।
গুতেরেস এসময় কপ-২৬ সম্মেলনের আগে করা মন্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে বলেন, ‘বৈশ্বিক তাপমাত্র বৃদ্ধির হার ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার যে লক্ষ্য তা বাস্তবায়ন করতে আমাদের তড়িৎ পদক্ষেপ নিতে হবে’।
তিনি বলেন, জলবায়ু বিপর্য় আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। কিন্তু এখনো সব শেষ হয়ে যায়নি। এখনই আমাদের জন্য উপযুক্ত সময়, জলবায়ু বিপর্যয় থামাতে কার্বন নিঃসরণ শূন্য করার। নইলে আমরাই একসময় শূন্যে মিলিয়ে যাব।
যাই হোক, এখানে আমরা বলতে চাই যে, যেসব লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কপ-২৬সম্মেলন শুরু হয়েছিল তার অর্ধেক লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। কেননা, প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ১.৫ ডিগ্রি সেলিসিয়াসের নিচে রাখার যে টার্গেট ছিল সে বিষয়ে কোন প্রকার আশাবাদ ব্যক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে। যদিও অনেকেরই আশা ছিল এ নিয়ে একটি ঐক্যমতে পৌঁছাবে দেশগুলো।
তারপরও সেরকম কিছু না হলেও অনেকের আশা, গ্লাসগো চুক্তি অন্তত বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমানোর যে লক্ষ্যমাত্রা তা অর্জনে সম্ভাবনাকে খোলা রাখছে। ওয়ার্লড রিসোর্স ইনস্টিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট হেলেন মাউন্টফোর্ড এ প্রসঙ্গে বলছেন, গ্লাসগো চুক্তির ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা কমানোর ক্ষেত্রে যেসব ফাঁক ফোকর ছিল তা বন্ধ করা।
তবে, গ্লাসগো সম্মেলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হলো, এই সম্মেলনে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ কামানোর যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল তা অর্জনে নিজেদের মধ্যে ঐক্যমতে পৌঁছাতে পেরেছে। এ লক্ষ্য অর্জনে কাজ শুরু করার কথা ছিল ২০২৫ সাল থেকে। এই সম্মেলনে ২০২২ সালের শেষ দিক থেকেই কাজ শুরু করার কথা হয়েছে।
বর্তমানে দেশগুলো যে হারে তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে, তাতে করে চলতে থাকলে ২১০০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা ২.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে। তাই এক্ষেত্রে হেলেনের সাজেশন হলো, ২০৩০ সালের মধ্যে অন্তত ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা কমানোর লক্ষ্যে কাজ করা। তবেই অনেকটা নিরাপদে থাকার সম্ভাবনা থাকবে। তার মতে, বিশ্বের দেশগুলোকে এই কঠিন লক্ষ্য অর্জনে একযোগে কাজে করতে হবে।
তিনি বলেন, যদি আমরা এই লক্ষ্য অর্জনে সফল হই তবেই আমরা পরবর্তী লক্ষ্য হাসিলের জন্য যেতে পারব এবং দেখেতে পারব যে, কোন দেশ আসলে এই লক্ষ্য অর্জনে কতোটা কাজ করেছে।
জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার কমানোর যে ওয়াদা দেশগুলো দিয়েছে এবং তার বিপরীতে যেভাবে জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার বাড়িয়েছে তাতে করে তাতে করে তাদের ওয়াদাকে কেবল ‘বাক সর্বস্ব’ বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। কেননা, আইএমএফের একটি হিসাব বলছে, ২০২০ সালে বিশ্বে দেশগুলো ৬ ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে কেবল জীবাশ্ম জ্বালানী খাতে।
এমন বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে গ্লাসগো সম্মেলনে তেল, গ্যাস, কয়লার ব্যবহার কামানোর ব্যাপারে কোন স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। তার বদলে যেন জীবাশ্ম জ্বালানী খাতে কম কম অর্থ বরাদ্দ করা হয় সে ব্যাপারে ‘তরান্বিত প্রচেষ্টা’ চালানোর কথা বলা হয়েছে।
এই সম্মেলনে সবদেশেই কয়লার ব্যবহার কমানোর ব্যাপারে একমত হয়েছিল কিন্তু শেষ দিকে এসে চীন এবং ভারত কয়লার ব্যবহার বন্ধ করার বদলে কমানোর প্রস্তাব দেওয়ায় তা অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এবং শেষ পর্যন্ত তাদের দাবী মেনেই কয়লার সীমাবদ্ধ ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেই গ্লাসগো জলবায়ু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
এই সম্মেলন শেষে আরেকটি দুঃখজন বিষয় সামনে এসেছে যে, প্রায় এক দশক আগে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর পক্ষ থেকে জলবায়ু তহবিল হিসেবে বিশ্বের জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার কথা ছিল তা বাস্তবায়িত হয়নি।
গত অক্টোবরে প্রকাশিত ওইসিডি (Organisation for Economic Co-operation and Development) এর একটি গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, আগামী ২০২৩ সালের মধ্যেও এই ১০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল উন্নয়নশীল এবং জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর কাছে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। যেখানে এই তহবিল ২০২০ সালের মধ্যে দেশগুলোর কাছে পৌছানোর কথা ছিল এবং ২০২৫ সালের মধ্যে এই তহবিল ব্যয় করে নির্দিষ্ট লক্ষ্য হাসিলের কথা ছিল। তারপরও, কপ-২৬ সম্মেলনে অন্তত এসব দেশের ক্ষয়ক্ষতি (Loss & Damage) সম্পর্কে স্বীকৃতি মিলেছে। এই সম্মেলনে লস বলতে বুঝানো হয়েছে, যা কিছু চিরতরে হারিয়ে গেছে। আর কখনোই ফিরে আসবে না। সেটা হতে পারে মানুষ এবং অন্য কোন প্রাণীর জীবন এবং ড্যামেজ বলতে বুঝানো হয়েছে, যা কিছু নষ্ট বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিন্তু মেরামতযোগ্য।
কিন্তু সম্মেলনে এই ক্ষয়ক্ষতি (Loss & Damage) বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে শক্ত বিরোধীতার মুখে পড়েছিল। ফলে তা চূড়ান্ত বিচারে চুক্তিতে স্থান পায়নি।
ফলে ওপরের আলোচনা থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, এই সম্মেলনে বেশ কিছু ইতিবাচক দিক অর্জিত হলেও চূড়ান্ত বিচারে ভারত-চীনের বিরোধীতায় কয়লার ব্যবহার বন্ধ না করা, জলবায়ু তহবিল ছাড় না করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার না করার কারণে এই জলবায়ু সম্মেলন প্রকৃতপক্ষে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য হাসিলে ব্যর্থ হয়েছে। কেননা, উন্নয়নশীল এবং জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মানুষের ব্যাপারে এই সম্মেলন কোন নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত দিতে ব্যর্থ হয়েছে।