টিপ: আবহমান বাঙলার নারীদের সৌন্দর্য বিকাশের এক ধারক

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

এপ্রিল ৫, ২০২২, ১২:১৩ পিএম

টিপ: আবহমান বাঙলার নারীদের সৌন্দর্য বিকাশের এক ধারক

কী অফিস, কী পার্টি— শাড়ি আর টিপ বাঙালি মেয়েদের সাজে থাকেই। এক সময় মেয়েরা সিঁদুর দিয়ে টিপ আঁকতেন, এরপর লাল রং দিয়ে কপালে বৃত্ত আঁকার চল এল। আরও পরে কাপড়ের টিপ পরা শুরু হয়। যুগে যুগে পরিবর্তন হয়েছে এর রং, আকার ও ধরনে। তবে গোলাকৃতির লাল টিপের আবেদন চিরদিনই এক রয়ে গেছে। টিপ পরার ইতিহাস হাজার বছরের।

টিপ ছাড়া বাঙালি নারীর সাজ যেন পূর্ণতা পায় না, এর উপস্থিতিতেই তো সাজে ষোলোআনা বাঙালিয়ানা ফুটে ওঠে। কত শতসহস্র কবিতা তো লেখা হয়েছে এই টিপ নিয়েই।

উপমহাদেশের টিপের ইতিহাস বেশ পুরানো। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের সাথে সৌন্দর্য ভাবনার শুরু। কেবল নারী নয় পুরুষেরাও প্রসাধন এবং সাজে যত্নশীল ছিলো। এ অঞ্চলের পুরুষেরা লম্বা চুল রাখতো। কোঁকড়ানো চুলে সুগন্ধি তেল মাখাতো। তাঁরা আকর্ষণীয় পুরুষ ছিলো। পুরুষেরাও নখ রাঙাতো।

বড় হোক বা ছোট, কেমন কপালে কেমন টিপ মানায় জেনে নিন in bengali

একটি টিপ নারীর আত্মবিশ্বাস অনেকখানি বাড়িয়ে দেয় বলে জানাচ্ছেন অনেকে। ছবির উৎস, সংগৃহীত

এক কালে সাজের অংশ হিসেবে সৌখিন নারীরা লাক্ষারস অর্থাৎ লাল এক ধরনের তরল রঙ দিয়ে ঠোঁট রাঙাতেন। এ দেশে পারফিউম আসার আগেই ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা ধুপ দিয়ে চুলে সুগন্ধ তৈরি করতেন। গোলাপের পাপড়ি বাহুমূলে রেখে সুগন্ধ সৃষ্টি করত। বাঙালি মেয়েদের কাজল ব্যবহার অনেক প্রাচীন। রান্নার চুলার কালির কালো রং থেকে এর উদ্ভব, পরে কপালে টিপ হিসেবে জায়গা করে নেয়। এরপর তারা কাজল তৈরি করে টিপ হিসেবে ব্যবহার করে। শিশুদের কপালে ব্যবহার শুরু হয়। মেয়েরা চোখে কাজল আঁকে। মেয়েরা আগে সিঁদুর ঠোঁটে দিয়ে ঠোঁট রাঙাতো। লাক্ষারসে ঠোঁট রাঙানোর পাশাপাশি তারা কপালে লাল রঙ দেওয়া শুরু করে। এভাবে লাল আলতা রঙ মেয়েদের কপালে ঠোঁটে, কপালে এবং পায়ে জায়গা করে নেয়।

টিপ এই উপমহাদেশের ভারত, বাংলাদেশ, নেপালসহ শ্রীলংকা, মৌরিতানিয়া, থাইল্যান্ডেও প্রচলিত। ‍ওইসব দেশে টিপকে বলে বিন্দি- আক্ষরিকভাবে এর অর্থ দাঁড়ায় ফোঁটা । আশ্চর্যজনকভাবে ঋকবেদেও টিপের উল্লেখ আছে, যা থেকে বোঝা যায় যে টিপের প্রচলন প্রায় ৫০০০ হাজার বছর ধরে!

সম্প্রতি দেশে একজন নারী শিক্ষককে টিপ পরার কারণে পুলিশের একজন কনস্টেবল হেনস্থা করেছেন, এমন অভিযোগ ওঠার পর ওই পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ওই ঘটনা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়েছে। অসংখ্য নারী নিজেদের টিপ পরা ছবি পোস্ট করে হয়রানির নিন্দাও জানিয়েছেন।

এমনকি অভিনেত্রী ও সংসদ সদস্য সুবর্ণা মোস্তফা ওই ঘটনার তীব্র নিন্দা করে সংসদে বক্তব্য রেখেছেন।

বাংলাদেশ বা বাঙালিদের মধ্যে অথবা দক্ষিণ এশিয়ার নারীদের মধ্যে টিপ পরা নতুন কিছু নয়। কিন্তু টিপ পরার এই রীতি চালু হলো কীভাবে?

হাজার বছর ধরে টিপ পরছেন নারীরা

বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বলছেন, হাজার হাজার বছর ধরেই বিশ্বের অনেক দেশের নারীদের মধ্যে টিপ পরার রীতি চালু রয়েছে।

''এটা শুধুমাত্র বাঙালি জাতির বা হিন্দু সম্প্রদায়ের কোন ব্যাপার ছিল না। আঠারো শতকে তো টিপের ব্যবহার খুব সাধারণ হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে তখনকার ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, বার্মা, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়ার নারীরা টিপ ব্যবহার করতেন।'' তিনি বলছেন।

তিনি বলছেন, সেই সময় সব ধর্মের নারীদের মধ্যেই টিপ পরার প্রচলন ছিল। তখনকার মুসলমানদের মধ্যেও টিপ ব্যবহারের প্রচলন ছিল। তার মতে, ইসলামেও টিপ পরা নিষিদ্ধ করা হয়নি।

একটি টিপ সোমা সাহা স্বাতীর আত্মবিশ্বাস অনেকখানি বাড়িয়ে দেয় বলে তিনি বলছেন

একটি টিপ সোমা সাহা স্বাতীর আত্মবিশ্বাস অনেকখানি বাড়িয়ে দেয় বলে তিনি বলছেন। ছবির উৎস, SOMA SAHA

তিনি বলছেন, টিপকে বরাবরই অঙ্গসজ্জার একটি অনুষঙ্গ হিসাবে দেখা হয়েছে। বিশেষ করে অনুষ্ঠানে যাওয়া, বিশেষ সাজগোজ করার সময় টিপকে শেষ উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করতো নারীরা। সব ধর্ম, সব শ্রেণির নারীদের মধ্যেই এই রীতি চালু ছিল।

বরিশালের বাসিন্দা তানিয়া ইয়াসমিন রোজা রাখেন, প্রায় নিয়মিত নামাজ পড়েন। কিন্তু তিনি টিপ পরতেও পছন্দ করেন।

তিনি বলছেন, ''যখন শাড়ি বা কোন রঙিন কাপড় পরি, একটা টিপ পরলে পুরো চেহারাটাই যেন বদলে যায়। নিজের কাছেই ভালো লাগে। তাই বেশিরভাগ সময়েই টিপ পরা হয়। যখন শাড়ি বা কোন রঙিন কাপড় পরি, একটা টিপ পরলে পুরো চেহারাটাই যেন বদলে যায়। নিজের কাছেই ভালো লাগে। তাই টিপ পরি।''

ইসরাত সুলতানা বলেছেন, টিপ পরতে ভালো লাগে। শাড়ি বা কামিজের সঙ্গে টিপ পরলে অন্যরকম সৌন্দর্য ফুটে ওঠে চেহারায়। 

আর সোমা সাহা স্বাতী মন্তব্য করেন, ''টিপ আমার আত্মবিশ্বাস অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে যখন অফিসে যাই, আবৃত্তি করি, একটা টিপ আমার মেকআপ, গেটআপ যেন পুরো বদলে দেয়।''

প্রবাসী মনিজা রহমান তাঁর নিজের ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, ''আমি শাড়ি পরলেই টিপ পরি। আমি নিউইয়র্ক শহরের যেখানে যাই নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দেই। আর কিছু নয়।''

একসময় শ্রেণিভেদে ব্যবহৃত হতো টিপ?

একসময় টিপের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে পুরুষ বা নারীদের শ্রেণি বা অবস্থান বোঝাতে টিপের ব্যবহার হতো বলে লিখেছেন জিয়াউল হক।

ইতিহাসের অলিগলি বইয়ে জিয়াউল হক টিপ প্রসঙ্গে পুরো একটি অধ্যায় লিখেছেন :

''কপালে টিপ বাঙালি তথা আধুনিক বাঙালি নারীর প্রাত্যহিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হচ্ছে। স্থান কাল আর পাত্র, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষ নারীরা পুরুষের তুলনায় সৌন্দর্য চর্চা করেন বেশি। বাঙালি নারীদের ক্ষেত্রে কপালে বড় একটি টিপ দেওয়া, তার সৌন্দর্য চর্চার অন্যতম এক অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। পাক-ভারত উপমহাদেশে এটা প্রায় প্রতিটি নারীর জন্যই একরকম বাধ্যতামূলক বিষয় যেন।''

সালসাবিল সাদিয়া মনে করেন, বাঙালি নারীর কপালে টিপ সৌন্দর্যের পরিপূর্ণতা এনে দেয়

সালসাবিল সাদিয়া মনে করেন, বাঙালি নারীর কপালে টিপ সৌন্দর্যের পরিপূর্ণতা এনে দেয়। ছবির উৎস,SALSABIL SADIA

তিনি লিখেছেন, ''আমাদের সমাজে এ প্রথাটা এলো কোথা হতে? এর উৎস খুঁজতে হলে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে ইতিহাসের পাতায়, বাল্মীকি যুগে।''

এর বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, এই রীতি চালু হয়েছে প্রায় ৯৫০০ থেকে ১১৫০০ বছর আগে থেকে, যাকে বাল্মীকি যুগ বলে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। সেখানে তিনি লিখেছেন, সেই সময় তৎকালীন হিন্দু সমাজে জাতিভেদ বা শ্রেণিভেদ প্রবল ছিল।

''ব্রাহ্মণরা উচ্চ শ্রেণির, তারা ঈশ্বরের অতি নিকটজন, পূত-পবিত্র। পবিত্রতার প্রতীক হিসাবে তারা কপালে সাদা তিলক (চন্দন তিলক) দিতেন। এখনও দেন।''

ক্ষৈত্রিয় হলো যোদ্ধা শ্রেণি, তাদেরকে বীর হিসাবে গণ্য করা হতো। ক্ষিপ্ততা, হিংস্রতা ও সাহসের প্রতীক হিসাবে তারা কপালে লাল টিপ দিতো।

বৈশ্যয় শ্রেণির লোকজন হলো ব্যবসায়ী, পেশাই হলো ব্যবসা। এরা কপালে হলুদ রঙের টিপ ব্যবহার করতো। আর সমাজে সবচেয়ে নিচু লোকজন হলো শূদ্ররা। ....তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল কালো রঙের টিপ। তারা কপালে কালো টিপ ব্যবহার করতে বাধ্য হতো।''

''নারীদের মধ্যেও ভিন্ন মাত্রার শ্রেণিভেদ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। শ্রেণিভেদ অনুসারে তাদের বেলাতেও এই টিপ ব্যবহারে একটু ভিন্নতা ছিল।

তিনি আরও লিখেছেন, সেই সময় যেসব নারীদের মন্দিরে উৎসর্গ করা হতো, তাদের চিহ্নিত করার জন্যও টিপ দেয়ার রীতি চালু হয়েছিল। আবার উচ্চ বর্ণের বিবাহিত নারীরাও বিয়ের চিহ্নস্বরূপ কপালে সিঁদুরের টিপ পড়তেন।

তবে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বলছেন, ''আঠারো বা উনিশ শতকের আগে অনেক সময় টিপ নারীদের শ্রেণি, মর্যাদা ইত্যাদির প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এরপর থেকে টিপ সবার কাছে সাধারণ সৌন্দর্য চর্চার একটি উপাদানে পরিণত হয়েছে।''

বাংলাদেশ ও ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশে নারীদের মধ্যে সাজগোজের অংশ হিসেবে কপালে টিপ পরার চল আছে (প্রতীকী চিত্র)

বাংলাদেশ ও ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশে নারীদের মধ্যে সাজগোজের অংশ হিসেবে কপালে টিপ পরার চল আছে (প্রতীকী চিত্র)। ছবির উৎস, GETTY IMAGES

বাঙালি সংস্কৃতিতে টিপের ব্যবহার নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৌমিত্র শেখর দে বলছেন, ''টিপকে এখন মানুষ সৌন্দর্য হিসাবে ব্যবহার করে। কিন্তু এই টিপের একটা প্রতীকী ব্যাপার আছে। সেটা হচ্ছে, ব্যক্তির 'থার্ড আই' হিসাবে এটাকে চিহ্নিত করা হয়। এটা হচ্ছে দূরদৃষ্টি প্রকাশক। এটা সিম্বোলিক হয়ে ধীরে ধীরে টিপ-এ পরিণত হয়েছে।'' তিনি বলেন, "তৃতীয় চক্ষুর এই ব্যাপারটিকে সমাজ ধীরে ধীরে সৌন্দর্য হিসাবে সমাজ গ্রহণ করেছে এবং আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে। সেটা হয়েছে বহু আগে থেকে। বলা যায়, প্রাচীন, মধ্যযুগ অতিক্রম করে এটা সাম্প্রতিক কালে এসে পৌঁছেছে।''

ইসলামে টিপ পরার বিষয়ে কী বলা হয়েছে?

ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির ইসলামিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মুখতার আহমেদ এ বিষয়ে বলেছেন, টিপ নিয়ে যে বিতর্কটি আমরা দেখছি, এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক। শরীয়া দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলতে গেলে, একজন মুসলমান নারী টিপ পরতে পারবেন কি পারবেন না, এ ব্যাপারে স্পষ্ট কোন দিক নির্দেশনা কোরান বা হাদিসে নেই।

''একজন নারী তার সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য অবশ্যই বিভিন্ন ধরনের অলংকার পরতে পারবেন। টিপও তার অলংকরণ বা সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য একটি উপকরণ হিসাবে তিনি ব্যবহার করতে পারবেন। টিপ পরা নিষিদ্ধ, এরকম কোন বক্তব্য কোরান বা হাদিসে নেই।''

বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর দে বলেছেন, ''টিপের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক আবহমান কাল থেকে বাঙালিদের মধ্যে ছিল না। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষ বাঙালিরা টিপ ব্যবহার করতো। সৌন্দর্য চর্চার ইতিহাসের সঙ্গে টিপের বিবর্তন যুক্ত, বাঙালির জন্য অন্তত ধর্ম-বর্ণের কোন সম্পর্ক নেই।''

তবে এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন ইসলামিক শিক্ষার অধ্যাপক মুখতার আহমেদ।

তিনি বলছেন, ''তবে ইসলামের শরীয়া বা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে, একজন মুসলিম নারী নিজস্ব অঙ্গনে, ঘরের মধ্যে, মাহরাম পুরুষদের (যে পুরুষদের সামনে দেখা দেয়া বাধা নেই) তাদের সামনে বা নারীদের সামনে পরতে পারবেন। কিন্তু এটা যেহেতু একটা সৌন্দর্যের ইস্যু, তিনি অন্য কোন পুরুষের সামনে ডিসপ্লে করতে পারবেন না।''

তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা ও উইকিপিডিয়া

Link copied!