১.
একজন নারী সহকর্মী যখন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে যায় তখন অনেক জায়গাতেই অনেক মানুষ বিষয়টা নেগেটিভভাবে দেখে। মনে করে মেয়েটা ছুটি কাটাতে যাচ্ছে। যদিও তার ছুটিটা একটা মানুষ পৃথিবীতে আনার জন্য, যে সময়টাতে তার শরীরের কষ্টের চেয়ে বড় কষ্ট কোথাও নেই। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ এমন আচরণ করে যেন সে মালদ্বীপে ভ্যাকেশনে যাচ্ছে। এই মানুষগুলোকে তাদের মা একইভাবে জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু এদের কাছে নিজের মা ছাড়া অন্য সব নারীই খারাপ।
২.
একজন নারী সহকর্মী কাজে খারাপ করলে বা ফাঁকি দিলে বা অযাচিত সুবিধা নিলে বেশিরভাগ মানুষ সেটার সমালোচনা করে এভাবে "মেয়েরা এরকম সুযোগ সুবিধা নেয়" বা "এজন্যই মেয়েদের কাজে নিলে ঝামেলা"। কিন্তু একই ফাঁকি একজন পুরুষ সহকর্মী দিলে তখন বলা হয় "ওই অফিসার কাজে ফাঁকি দেয়"। তখন সমগ্র পুরুষ জাতি নিয়ে কথা উঠেনা। এটা সবক্ষেত্রেই হয়ে আসছে। "মেয়েরা অংকে ভালো না", "মেয়েরা বায়োলজি পড়লে ভালো" ইত্যাদি ওই একই ধারণার বহিঃপ্রকাশ। একজন নারী কোন কিছুতে খারাপ করলে সেটা সমগ্র নারীজাতির উপর চাপিয়ে দেয়া খুবই কমন।
৩.
এমনকি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও, সবচেয়ে বড় অফিসেও এখনো নারীর পোশাক একটা রসালো আলোচনার বিষয়। এমন অনেক পুরুষ এবং নারী দেখেছি যারা তাদের অন্য একজন নারী সহকর্মী কি গায়ে দেয়, কার সাথে কথা বলে, কোথায় যায়, ফেসবুকে কি স্ট্যাটাস দেয় সেসব নিয়ে ছোঁক ছোঁক করে। এসব মানুষের নিজের জীবনে বেশিরভাগ সময় কোন কাজ করেনা, তাদের জীবনে বেশিরভাগ সময় আনন্দের কোন কিছু ঘটেনা, দিনের পর দিন বাসায় গিয়ে পার্টনারের সাথে ঝগড়া করে, ব্যাংকে টাকা জমিয়ে, ফ্ল্যাট কিনে তাদের জীবন শেষ হয়। তাই অন্য মানুষের বিষয়ে এদের বিশাল আগ্রহ থাকে।
৪.
এখনো বেশিরভাগ মানুষ কোন নারী নিজের ক্ষমতায় সুখে আছে বিষয়টা মানতে পারে না। আমি আর মাসুদ দুইজনেই একই জায়গায় কাজ করলেও মানুষ "সকালে নাস্তা বানায় না? রান্না করে না?"— এই কথাটা আমাকে জিজ্ঞেস করে। আবার একই মানুষ মনে করে আমি ঘরের কাজে কোন টাকা খরচ করি না। বলে "তোমার এত টাকা দিয়ে কি কর?" যেখানে আমি গত অনেক বছর ধরে আমার পরিবারের অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালন করে আসছি। কারণ এদের কাছে মেয়েদের কাজ ঘরের দায়িত্ব পালন, টাকা পয়সা দেয়া নয়। একই কনসিকোয়েন্সে আমার কাপড় ও কখনো ধুয়ে দিলেন কিংবা আমার শ্বাশুড়ি নাস্তা বানালেও এদের গায়ে লাগে। যদিও তাদের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নাই, তাদের আমাদের জন্য কিছু করতেও হয় না। তাও তারা এসব সহ্য করতে পারেনা। হয়ত নিজের জীবনের অপ্রাপ্তি ঢাকতেই তাদের এত সমস্যা।
৫.
বাচ্চা হওয়ার পর এখনো অবধারিতভাবে সবাই মনে করে বাচ্চা লালন পালন মোটাদাগে মেয়েদের কাজ। বাবা মাঝে মাঝে সাহায্য করবে। কিন্তু বেশিরভাগ কাজ মায়ের। পিতৃত্বকালীন ছুটি বিশ্বের বেশিরভাগ উন্নত দেশে থাকলেও আমাদের দেশে এখনো অদ্ভুত একটা কনসেপ্ট।
৬.
"মেয়েটা ভালো কিন্তু বেশি ওপেন মাইন্ডেড, মেয়েটা ভালো কিন্তু সংসারী না মনে হয়" এই কথাগুলো আমার বিষয়ে অনেকেই বলেছে। যাদের বলেছে তাদের আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, সংসারী না বলতে আসলে কি বুঝায়? আর ওপেন মাইন্ডেড বিষয়টাতো ভালো তাইনা? না, আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে এই দুইটা জিনিস বেশিরভাগ এর কাছে ভালো না। এখানের প্রেক্ষিতে মেয়েদের হতে হবে ছোট মনমানসিকতার যেন তাদের নিয়ে পরবর্তীতে ট্রল করা যায়, মেয়েদের হতে হবে সম্পূর্ণরূপে হাসবেন্ড এর উপর নির্ভরশীল, আর্থিক, মানসিক শারীরিকভাবে। এখানের পরিপ্রেক্ষিতে মেয়েদের কাজে ফাঁকি দিতে হবে যাতে সেটা নিয়ে কথা বলা যায়, এখানের পরিপ্রেক্ষিতে সংসারী বলতে যে সবসময় মাথা নিচু করে চলে, সুযোগ পেলেই কুটনামি করে, ২৪ ঘন্টা ঘরের কাজ আর ঘরের জিনিস নিয়ে খুটখাট করতে থাকে। কোন মেয়ে তাঁর কাজে ফাঁকি দেয় না, কোন মেয়ে তাঁর হাজব্যান্ড এর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলে, কোন মেয়ে ঘর আর ঘরের জিনিস নিয়ে অবসেসড না, চব্বিশ ঘন্টা রান্না নিয়ে চিন্তা করে না,কোন মেয়ের মানসিক দৈন্য নেই, কোন মেয়ে কুটনামি করে না বরং সরাসরি কথা বলার সৎ সাহস রাখে এসব বিশাল দোষ। কারণ একই মেয়েদের নিয়ে কি কথা বলবে মানুষ সেটা বুঝে না। তাই "ওপেন মাইন্ডেড, সংসারী না" এসব তার দোষ।
৭.
একইসাথে কিছু মেয়ে নিজে মেয়ে এই ঘটনার সুবিধা নিতে চায়। ঠিকমত কাজ করে না, আজ এটা কাল ওটা বলে অফিস থেকে আগে চলে যায়। আপারা, আপনার বাসায় মেহমান, আপনার হাজব্যান্ড এর সুটকেস গোছানো, এইসব অফিস একদিন দেখবে। প্রতিদিন দেখবে না। কাজ করতে না পারলে ছেড়ে দেন। কিন্তু দিনের পর দিন কাজে ফাঁকি দিয়ে দুই নাম্বারি করবেন না প্লিজ। যেসব নারী সবসময় নিজে নারী এই ট্রাম্পকার্ড ব্যবহার করে অযাচিত সুবিধা নিচ্ছে, ঠিকমতো কাজ করছে না, সব দায়িত্ব তাদের হাজব্যান্ড এর উপর চাপিয়ে দিচ্ছে, তাদের জন্য নারী দিবস না।
নারী দিবসে সব নারী, যারা প্রতিনিয়ত এইসব নিয়ে যুদ্ধ করে নিজের জীবন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তাদের জন্য ভালোবাসা। পৃথিবীতে সমতা আসুক, কর্মক্ষেত্রে নারীকেন্দ্রিক বৈষম্য দূর হোক।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।