মে ৮, ২০২৩, ০৯:৩৪ এএম
রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধ করা মাধ্যমে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার যেন সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিয়েছিল। শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত নয় বরং বাংলাভাষা সংস্কারের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল ষাটের দশকে। আর এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরব ভূমিকা রাখেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। তিনি বেশ কয়েকবার রবীন্দ্রসঙ্গীত বন্ধের বিরুদ্ধে কথা বলেন।
বঙ্গবন্ধু ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এক ভাষণে বলেন, "জ্ঞান আহরণের পথে এই সরকার যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিয়াছেন যার নজির বিশ্বে বিরল। আমরা মির্জা গালিব, সক্রেটিস, শেকসপিয়ার, এরিস্টটল, ডান্তে, লেনিন, মাওসেতুং পড়ি জ্ঞান আহরণের জন্য আর দেউলিয়া সরকার আমাদের পাঠ নিষিদ্ধ করিয়া দিয়াছেন রবীন্দ্রনাথের লেখা, যিনি একজন বাঙ্গালি কবি এবং বাংলায় কবিতা লিখিয়া যিনি বিশ্বকবি হইয়াছেন। আমরা এই ব্যবস্থা মানি না আমরা রবীন্দ্রনাথ পড়িবই, আমরা রবীন্দ্র সঙ্গীত গাহিবই এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত এই দেশে পাওয়া হইবেই। আমি রেডিও এবং টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীতের উপর হইতে সর্বপ্রকার বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করিয়া অবিলম্বে পর্যাপ্ত পরিমাণে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচারের দাবি জানাই।”
১৯৭১ সালের পহেলা জানুয়ারি আরেকটি ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, “বাংলা ভাষা ও বঙ্গ সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার জন্যে জাতীয় পুনর্গঠন ব্যুরো স্থাপন করা হয়েছে। পাকিস্তান বেতার এবং টেলিভিশনও এই ষড়যন্ত্রের দোসর। তারা রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধ করে দিয়েছিল এবং আজও এ ব্যাপারে উঁচু মহলে জোর আপত্তি রয়েছে। জনগণ তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এই চক্রান্ত সহা করবে না। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে যেসব বাঙালি সরকারি সমর্থন পেয়েছেন, তাঁদের দিন আজ শেষ।"
৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, "অতীতে বাংলাদেশের গৌরবময় ইতিহাসকে বিকৃত করার সুপরিকল্পিত চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমার মুখের ভাষাকে কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, আরবি হরফে বাংলা লেখার চেষ্টা করা হয়েছে, হরফ সংস্কার, ভাষা-সংস্কার, বানানসংস্কারের চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা আন্দোলন করে তা রুখেছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুলকে বাদ দিয়ে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের কথা ভাবা যায় না। কিন্তু এর উপর বারবার হামলা এসেছে। ভেবে অবাক হতে হয়, কাজী নজরুলের কবিতার শব্দ পরিবর্তন কম হয়েছে? গানের শব্দ বদল করে রেডিওতে গাওয়া হয়েছে। তারা মুসলমান করিয়েছেন। এ অধিকার তাদের কে দিল?
২৪ জানুয়ারি ১৯৭১ তারিখে ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, "কোন ৪০ জন ব্যক্তি রবীন্দ্রসংগীতের বিরুদ্ধে বিবৃতি প্রদান করেছিলেন? কোন বিশেষ মহল তথাকথিত ইসলামের নামে নজরুলের গান ও কবিতার শব্দ বদলেছে? রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে বাদ দিলে বাংলা সাহিত্যের অস্তিত্বটা থাকে কোথায়? যে মৌলিক গণতন্ত্র ও ডিক্টোরি শাসনের পতন ঘটাবার জন্যে বাংলার বীর ছাত্র-জনতা- শ্রমিক বুকের রক্ত দিয়েছে, তাদেরই গুণকীর্তন করে, প্রবন্ধ লিখে, বেতার কথিকা প্রচার করে এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদ পয়সা রোজগার করেছেন। বিএনআর-এর অর্থানুকূল্যে বই প্রকাশ করেছেন। ৪৭ সাল থেকে বাঙালিদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা হতো কিন্তু এখন অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এখন যে কেউ স্বাধীনভাবে বাংলাভাষায় কথা বলতে এবং নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চা করতে পারেন।"
উল্লেখ্য ১৯৬৭ সালের জুন মাসে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গীত নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ইতিপূর্বে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পাকিস্তান রেডিও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ থাকে। বাজেট অধিবেশনে রাজশাহী থেকে নির্বাচিত বিরোধীদলীয় সদস্য মজিবর রহমান চৌধুরীর এক প্রশ্নের উত্তরে তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন মন্তব্য করেন যে, পাকিস্তানি আদর্শের সাথে না মিললে রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হবে।