গাভীর প্রেমে ভিসি, অধ্যাপক রাজ্জাকের কাছে ছফা

হাসনাত আসিফ কুশল

আগস্ট ৩০, ২০২৪, ০৯:৩৯ এএম

গাভীর প্রেমে ভিসি, অধ্যাপক রাজ্জাকের কাছে ছফা

আধুনিক সময়ের বাংলা ভাষার প্রথিতযশা লেখকদের মধ্যে একজন হলেন এই আহমদ ছফা। সমসাময়িক বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও শীর্ষস্থানীয় তিনি। একটি লেখায় তিনি ‘সৎসাহস’ সম্পর্কে পর্যবেক্ষণদৃষ্ট মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেছেন: সৎসাহসকে অনেকে জ্যাঠামি এবং হঠকারিতা বলে মনে করে থাকেন, কিন্তু আমি মনে করি সৎসাহস হলো অনেক দূরবর্তী সম্ভাবনা যথাযথভাবে দেখতে পারার ক্ষমতা।

সাম্প্রতিক সময়ে বুদ্ধিজীবীদের লেজুড়বৃত্তিক ও সাংবাদিকদের দলান্ধ মনোভাব সম্পর্কে অকপট বিশ্লেষণ করেছেন আহমদ ছফা। তার কলমে উঠে এসেছে সেই ‘সৎসাহস’। ‘গাভী বিত্তান্ত’ উপন্যাসে তিনি দেখিয়েছেন একজন ভিসির জীবনযাপন। যিনি অন্য এক সুহৃদের পরামর্শে কিনে আনেন একটি গাভী। গাভীটিকে দেখাশোনার জন্য একজন লোকও ঠিক করে ফেলেন তিনি। পরবর্তীতে সেখানেই নিজের কাজের জায়গা তৈরি করে ফেলেন। এখানে আহমদ ছফা দেখাতে চেয়েছেন উপাচার্যকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মনোভাব। নিরপেক্ষভাবে সমাজের নিকষ কালো অন্ধকার তুলে ধরেছেন উপন্যাসে।

আমরা যারা পড়াশুনা করি, ডিস্টোপিয়া শব্দটির সঙ্গে নিশ্চয়ই পরিচিত থাকবো। ‘গাভী বিত্তান্ত’ উপন্যাসটি পাঠ করে আমার মনে হয়েছে, এখানে আহমদ ছফা ডিস্টোপিয়া নিয়ে আলোচনা করেছেন। ডিস্টোপিয়া হলো ইউটোপিয়ার সম্পূর্ণ বিপরীত ধারণা। ইউটোপিয়া যেমন একটা কল্পিত পৃথিবী, যেখানে সবকিছুই ভালো, বৈষম্যহীন ও সমতার ভিত্তিতে হয়ে থাকে, বিপরীতার্থকভাবে ডিস্টোপিয়া হলো কলুষিত পৃথিবী, যেখানে সবকিছুই খারাপ। আলদৌজ হাক্সলের ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’ ও জর্জ অরওয়েলের ‘নাইনটিন এইটি ফোর’ এই দুটো উপন্যাসে ডিস্টোপিয়া সম্পর্কে ভালো ধারণা পাওয়া যাবে। বিশেষ করে ‘নাইনটিন এইটি ফোর’ উপন্যাস উইভগেনি জ্যামইয়াতিনের লেখা ‘WE’ উপন্যাসের পটভূমিতে লেখা হয়েছে বলেও অনেকে মনে করেন। ‘WE’ উপন্যাসে সবকিছু গাণিতিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। খাঁটি ডিস্টোপিয়ার উদাহরণ এসব বইয়ে পাওয়া যাবে।

আহমদ ছফার ‘গাভী বিত্তান্ত’ উপন্যাসেও একইভাবে ডিস্টোপিয়ার কথা বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে উপাচার্যদের নৈতিক অবস্থান নিয়েও তুলেছেন প্রশ্ন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের রাজনীতি, শিক্ষার্থীদের মনোভাব ও উপাচার্যের অবস্থার পরিবর্তন এবং কিছু মানুষের দ্বিমুখী মনোভাব এই উপন্যাসের আলোচ্য বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা দুর্নীতি, এর ভেতরের মানুষগুলোর ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা ও দলাদলি, কিছু মানুষের দ্বিমুখী মনোভাব দেখানোর মধ্য দিয়ে তদানীন্তন সমাজব্যবস্থাকেই ব্যঙ্গ করেছেন আহমদ ছফা।

বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে জ্ঞানতাপস শিক্ষকরা রয়েছেন, সেই শিক্ষকদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব, রাজনীতি ও স্বার্থপরতার নোংরা বলয়ের অভ্যন্তরে অবস্থান করেও স্রেফ নিষ্ক্রীয় জীবনযাপনকারী একজন শিক্ষক হিসেবে উপন্যাসটিতে আবর্তিত হয়েছেন রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মিয়া মোহাম্মদ আবু জুনায়েদ। সহজ-সরল ও সাধারণ জীবনযাপন করেন তিনি। তার চিন্তা বা স্বপ্নও গ্রামের সহজ-সরল রাখালের মতো। দীর্ঘ দিন ধরে গাভী পুষবেন বলে মনে মনে ইচ্ছা তার। উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে, পরিবেশ-পরিস্থিতি আর অতিরাজনীতির ঘেরাটোপে আকস্মিকভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত করা হয় তাকে। এই উপাচার্যের পদে আসীন হওয়াটাই তার নিজস্ব জীবনযাপন ও দৃষ্টিভঙ্গিতে নিয়ে আসে এক আমূল পরিবর্তন।

‘গাভী বিত্তান্ত’ উপন্যাসে অসৎ মনোভাবাপন্ন একটি সমাজের চারিত্রিক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আহমদ ছফা দেখিয়েছেন, সহজ-সরল প্রকৃতির একজন অধ্যাপক কীভাবে পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বনে যান। অন্যদিকে একই লেখকের লেখা ‘যদ্যপি আমার গুরু’ একটি স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে আড্ডা ও দার্শনিক আলাপকে কেন্দ্রবিন্দু করেই গ্রন্থটি লিখেছেন আহমদ ছফা। মেন্টর হিসেবে আহমদ ছফা কেন আব্দুর রাজ্জাককে বেছে নিয়েছিলেন- তার সুক্ষ্ম বর্ণনা দিয়েছেন ‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইয়ে।

১৯৯৫ সালে ‘গাভী বিত্তান্ত’ ও ১৯৯৮ সালে ‘যদ্যপি আমার গুরু’ গ্রন্থ দুটি প্রথম প্রকাশ হয়। ‘গাভীবিত্তান্ত’ স্যাটায়ারধর্মী উপন্যাস। অন্যদিকে ‘যদ্যপি আমার গুরু’ স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ। গ্রন্থ দুটি সব শ্রেণির পাঠকের জন্য পড়া জরুরি। বিশেষ করে যারা রাজনৈতিক ও ধর্মীয়ভাবে অপরিপক্ক এবং দলাদলি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেন তাদের জন্য গ্রন্থ দুটি অবশ্যপাঠ্য বিবেচিত হওয়া উচিত।

Link copied!