হিন্দু ও জৈন ধর্মের বিশেষ একটি তাৎপর্যপূর্ণ তিথি অক্ষয় তৃতীয়া। বৈশাখের শুক্লপক্ষের তৃতীয়া তিথিকে বলা হয় অক্ষয় তিথি। অক্ষয়তীজ্ বা পরশুরাম জয়ন্তী নামেও এই তিথি পরিচিত।
অক্ষয় তৃতীয়া হলো বছরের সবচেয়ে মাহাত্ম্যপূর্ণ দিন। তার ওপর সেদিন সোমবার এবং রোহিণী নক্ষত্র সমাসীন হলে আরও তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে। বৈশাখের এই বিশেষ দিন নানাবিধ মহতী কাজের পরম্পরা শুরু হয়েছিল।
ভারতবর্ষের প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই দিন ঘটেছিল।
সেই কারণে অক্ষয় তৃতীয়ায় শুভ কর্মানুষ্ঠানে পুণ্যফল অক্ষয় হিসেবে ধরা হয়। এই তিথি কেন এত মাহাত্ম্যপূর্ণ? প্রশ্নের অবকাশ আছে। সনাতন পণ্ডিতরা মনে করেন, এই তিথিতে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। তাই এই তিথিতে কোনো শুভ কর্মানুষ্ঠান করলে বা কারও শুভযোগ থাকলে তার পুণ্যফল দীর্ঘস্থায়ী হয়। এখন এই তিথিতে যেসব ঘটনার পরম্পরা শুরু হয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে জেনে আসি:
সত্যযুগের শুরু: হিন্দুদের যুগপরম্পরার প্রথমটি হলো সত্যযুগ। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, অক্ষয় তৃতীয়ায় এই যুগের শুরু হয়েছিল। এই যুগেই বিষ্ণু যথাক্রমে মৎস্য, কূর্ম বা কচ্ছপ, বরাহ বা শূকর, বামন এবং পরশুরামের অবতার নিয়ে মর্ত্যে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
পরশুরাম আবির্ভূত: এই তিথিতেই ভগবান বিষ্ণুর অন্যতম অবতার পরশুরাম মর্ত্যে আবির্ভূত হন। চিরঞ্জীব, অমর ও অক্ষয় আয়ু নিয়ে তিনি এখনও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বিচরণ করছেন। পরশুরাম আবির্ভূত হওয়ায় এই তিথি পরশুরাম জয়ন্তী নামেও সমধিক পরিচিত।
মহাভারত রচনা শুরু: অক্ষয় তৃতীয়ায় মহাভারত রচনার কাজে হাত দেন ব্যাসদেব। এই মহাভারতের অন্যতম চরিত্র অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণ যে উপদেশ দিয়েছিলেন, তা আমাদের পার্থিব ও পারমার্থিক উন্নতির জন্য নির্দেশিকাস্বরূপ। জাতি-সম্প্রদায় নির্বিশেষে শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বাণী আমাদের সবার জন্যই আশীর্বাদস্বরূপ।
মা অন্নপূর্ণার আবির্ভাব: দেবী পার্বতীর আরেক রূপ মা অন্নপূর্ণা আবির্ভূতা হন এই তিথিতেই। অক্ষয় তৃতীয়ায় আবির্ভূতা হয়ে মহাদেবকে অন্নভিক্ষা দেন তিনি।
শ্রীকৃষ্ণের পরম সখার আগমন: অক্ষয় তৃতীয়ায় দ্বারকা নগরীতে শ্রীকৃষ্ণের প্রাসাদে তার পরম সখা সুদামা বিপ্র দারিদ্র্যাবস্থার কথা বর্ণনা করতে আসেন। কিন্তু ‘অতিথি দেবঃ ভবঃ’ এবং ‘ব্রাহ্মণ নিত্য পূজ্য’-এই জ্ঞানে শ্রীকৃষ্ণ বিপ্র সুদামাকে যে আতিথেয়তা করেন, তাতে মুগ্ধ হয়ে সুদামা আর সে কথা বর্ণনা করতে পারেননি।
দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ: দুর্যোধনের নির্দেশে এই তিথিতেই দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করেন দুঃশাসন। পরবর্তীতে শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করে নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করেন পাণ্ডব-পত্নী।
পাণ্ডবদের অক্ষয়পাত্র দান: পাণ্ডবরা যখন বনবাসে ছিলেন, তখন সূর্যদেব তাদের অক্ষয়পাত্র দান করেছিলেন। তাদেরকে যে তিথিতে এটা দান করা হয়েছিল, তা অক্ষয় তৃতীয়া ছিল। এই পাত্রের বৈশিষ্ট্য হলো: এক থালা অন্ন দ্রৌপদীর আহার গ্রহণের আগে পর্যন্ত যতজন উপস্থিত থাকতো তাদেরকে খাওয়ানো সম্ভব ছিল।
কুবেরের স্বর্গের ধনসম্পদ লাভ: দীর্ঘকাল তপস্যা করে এই তিথিতেই মহাদেবের প্রসন্নতায় স্বর্গের ধনসম্পদ লাভ করেন কুবের।
শ্রীজগন্নাথদেবের রথের নির্মাণ শুরু: অক্ষয় তৃতীয়ায় শ্রীজগন্নাথদেবের রথের নির্মাণকাজের শুভ সূচনা হয়। ভক্তবৎসল জগন্নাথদেব ভক্ত দর্শনের জন্য রথযাত্রা করেন। আর ভক্তদের প্রতিও তার অক্ষয় কৃপা এই যে, স্বয়ং ভগবান মন্দির থেকে পথে তাদের দর্শনসুখ দিতে আসেন।