চিনুয়া আচেবে। তথাকথিত ‘অন্ধকার মহাদেশ’ খ্যাত আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়ার একজন প্রখ্যাত সাহিত্যিক। বলা ভাল কথা সাহিত্যিক। যার কাছে সাহিত্য কেবল বিনোদন নয়, অন্যকিছু। যেমনটা মনে করতেন ফরাসি দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্রে। আচেবের মতে সাহিত্য হলো সমাজ বদলের হাতিয়ার। আসলেই কি সাহিত্য সমাজ বদলে ভূমিকা রাখতে পারে? পারে। তবে সমাজের সেই পরিবর্তনটা এতটা ধীর এবং বিমূর্ত যে, তা সহজে সবার চোখে ধরা পড়ে না।
আফ্রিকায় বর্তমান ‘সভ্য জগতে’র আলো পৌঁছেছে অনেক দেরীতে। ফলে ‘সভ্য জগতে’র চিন্তা বা ভাব প্রকাশের অন্যতম প্রধান বাহন ভাষার লৈখিক রূপ আফ্রিকায় পৌঁছেছে তুলনামূলক অনেক পরে। তাই অন্যান্য ভাষা যখন বিশ্ব সাহিত্যের অঙ্গেনে প্রতিযোগিতায় অনেকটা পথ এগিয়ে গিয়েছে তখন আফ্রিকান সাহিত্য প্রতিযোগিতায় আসতে অনেক দেরী করেছে। আফ্রিকান সাহিত্যের লিখিত রূপ আসার আগে এর কতকগুলো বৈশিষ্ট্য ছিলো, এগুলো লৈখিক নয়, মৌখিক। ছোট গোত্র ভিত্তিক এবং প্রায়শই আলাদা আলাদা সাংস্কৃতিক রূপ বিশিষ্ট।
চিনুয়া আচেবের সাহিত্য এবং চিন্তার মূল্যায়ন করতে গিয়ে রাজু আলাউদ্দিন লিখছেন, ‘চিনুয়া আচেবে যে সংস্কৃতি থেকে এসেছিলেন, সেখানে শিল্প বা সাহিত্য ওরাল ফর্মের ওপর ভিত্তি করে গোত্রদের বিনোদনের উপায় হিসেবে বিরাজ করে আসছে বহুদিন থেকে এবং এখনো পর্যন্ত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রধান বিনোদন মাধ্যম হিসেবে তা বর্তমান। কিন্তু আফ্রিকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই বিনোদন একই সঙ্গে শিক্ষারও এক মাধ্যম। ঔপনিবেশিক শাসন আফ্রিকার জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যকে মুছে দিতে পেরেছে খুব কমই। আচেবে তার সংস্কৃতির এই ধর্ম ও মর্মকে তিনি বর্ণমালাভিত্তিক সংস্কৃতির মধ্যে এনেছিলেন এবং নিজ দেশে যেমন, তেমনি বহির্বিশ্বেও তার জানান দিয়েছিলেন’।
আচেবে সাহিত্যকে মনে করতেন সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালনের মাধ্যম যা ইউরোপ বা আধুনিক সাহিত্যের অনেক দিকপাল এবং রথী মহারথীরা মনে করতেন না। আচেবে তার সাহিত্যকে মনে করতেন, তার জনগোষ্ঠীর পরিবর্তনের হাতিয়ার। বিশ্ব মঞ্চে তাদের অস্তিত্ব এবং অধিকার জানান দেবার প্লাটফর্ম। তিনি ঔপনিবেশিক মানসিকতার সাহিত্য এবং নন্দনতত্ত্বকে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেছেন। এ নিয়ে রাজু আলাউদ্দিন তার একটি আলোচনায় লিখেছেন, ‘সাহিত্যের নন্দনতাত্তি্বক বিশ্বাসকেও তিনি সামাজিক গুরুত্বের বাইরে বিবেচনা করতেন না। প্রায় অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে এবং তীব্র ভাষায় কলাকৈবল্যবাদকে তিনি ঘৃণাভরে আখ্যা দিয়েছিলেন 'ডিওডোরান্ট ডগশিট' বলে। নিজের জাতির অপমানে ও জাতিবিদ্বেষের দায়ে অভিযুক্ত করে তিনি ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রবল ব্যক্তিত্ব জোসেফ কনরাড এবং জয়েস ক্যারিকে তুলোধুনো করে ছেড়েছেন। 'হার্ট অব ডার্কনেস' উপন্যাসের পাতায় পাতায় কনরাডের জাতিবিদ্বেষের নমুনাকে তিনি তুলে ধরেছেন তার অসামান্য প্রবন্ধ "অ্যান ইমেজ অব আফ্রিকা: রেসিজম ইন কনরাডস 'হার্ট অব ডার্কনেস'” -এ।
আচেবে তার সাহিত্যকে সবার সামনে আফ্রিকান জনগোষ্ঠীর রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি বিশেষ করে তিনি নিজের জাতির সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য ও গৌরব সম্পর্কে সজাগ করে তুলতে ব্যবহার করেছেন।
চিনুয়া আচেবের পাঁচটি উপন্যাসের প্রথমটি Things Fall Apart, প্রকাশিত হয় নাইজেরিয়ার স্বাধীনতার দুই পূর্বে ১৯৫৮ সালে। অন্যান্য উপন্যাসগুলোর মধ্যে No Longer at Ease, ১৯৬০ সালে, Arrow of God ১৯৬৪ সালে এবং A Man of the People উপন্যাসটি লিখিত হয় ১৯৬৬ সালে। এছাড়া Anthills of the Savannah প্রকাশ পায় ১৯৮৭ সালে। উপন্যাসগুলোতে আচেবে তার সমকালীন সমাজ-রাজনৈতিক জীবনের ঘটনা বিশ্লেষণ করেছেন, সাক্ষী হয়েছেন দেশের ক্ষমতার পালাবদলের, সরকারের উত্থান-পতনের, জনগণের ব্যর্থতা ও হতাশার এবং ইতিহাসের প্রতি বিশ্বস্তথেকেই, তা তার উপন্যাসগুলোর পরতে পরতে গেঁথে দিয়েছেন।
এপ্রসঙ্গে, ‘অ্যারো অব গড’-উপন্যাসের বাংলা অনুবাদক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস প্রথম আলোয় লেখা একটি প্রবন্ধে জানাচ্ছেন, ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট, নো লংগার অ্যাট ইজ এবং অ্যারো অব গড-এই তিন উপন্যাসকে এদের একই ঔপনিবেশিক পটভূমি এবং একই ধরনের বক্তব্যের জন্য বলা হয় ‘আফ্রিকান ট্রিলজি’। তো এই উপন্যাসত্রয়ীর শেষটিতে আচেবে তার শ্রেষ্ঠ শৈল্পিক দক্ষতায় ইগবো সমাজের জটিল মনস্তত্ত্ব, ইংরেজি সংস্কৃতি ও সনাতন ইগবো সংস্কৃতি সংঘাত এবং তার চেয়েও বেশি ইগবো সমাজের অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েনের কথাই নিরাসক্ত, নির্মোহ ভঙ্গিতে বয়ান করেছেন’।
একজন সময় সচেতন লেখক হিসেবে আচেবে দেখেছেন, আফ্রিকার নেতৃবৃন্দ সংগ্রাম করেছেন স্পষ্টভাবেই ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে। কিন্তু আফ্রিাকান নেতারা ঔপনিবেশিকদের তাড়িয়ে দেওয়ার পর সেই শূন্যস্থান পূরণ করবেন কিভাবে সেবিষয়ে সবিশেষ অবগত ছিলেন না। ফলে ঔপনিবেশিক শক্তির চলে যাওয়ার পর আফ্রিকার দেশগুলোর লব্ধ স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়, গোত্র বিবাদ উসকে যায়, অর্থনৈতিক অগ্রগতি বলে কিছু ঘটে না, সামাজিক ন্যায়বিচার অরণ্যে রোদন করে আর রাজনৈতিকভাবে অসচেতন বা কম সচেতন সাধারণ জনতার আশা-আকাঙক্ষা নিমজ্জিত হয় নৈরাশ্যের অমানিশায় এবং তাদের দুর্বল প্রতিরোধ-প্রচেষ্টা উসকানি দেয় সীমাহীন দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিকে। অস্থিরতা গ্রাস করে আধুনিক আফ্রিকাকে। আর আচেবে তার লেখায় মুনশিয়ানার সঙ্গে এই অস্থির সময়কে ধারণ করেন।
আচেবে তার উপন্যাসে গোটা সমাজের চিত্রটা খুঁটিনাটিসহ তুলে ধরেন। তার উপন্যাসের সমাজতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক মূল্যের পাশাপাশি শৈল্পিক মূল্যও কোনো অংশে কম নয়। এর র প্রমাণ পাওয়া যায় তার প্রকাশিত উপন্যাসগুলো সম্পর্কে পশ্চিমা লেখকদের আলোচনা থেকে। শিল্পী হিসেবে তার মিতব্যয়িতার প্রশংসা করেছেন মার্কিন লেখক জন আপডাইক। ইংরেজ না হয়েও তিনি যে দক্ষতায় ইংরেজিকে সৃষ্টিশীলতার মাধ্যম করে নিয়েছিলেন, তা ছিল বিস্ময়কর।
আফ্রিকার লেখকরা কোন ভাষায় লিখবেন তা নিয়ে একটা তর্ক চলছিল দীর্ঘদিন থেকেই। আচেবে কেন নাইজেরিয়ার ঔপনিবেশিক প্রভুদের ভাষা ইংরেজিকে তার সাহিত্যের মাধ্যম হিসেব বেছে নিলেন তার পক্ষে যুক্তি হিসেবে আচেবে তার 'আফ্রিকান ইংলিশ' শীর্ষক এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, "সৃষ্টিশীল লেখায় কার্যকরভাবে ব্যবহারে সক্ষম হওয়ার জন্য একজন আফ্রিকান কি ইংরেজি ভাষাটি যথেষ্ট ভালোভাবে শিখতে পারে? নিশ্চিতভাবেই হ্যাঁ। যদি অন্যভাবে জানতে চান: একজন ইংরেজিভাষীর মতোই কি সে তা ব্যবহার করতে পারে? আমি বলব, মনে হয় না,...। ইংরেজি ভাষাটা আফ্রিকান লেখকরা এমনভাবে ব্যবহার করবেন, যাতে ভাষার পরিবর্তন না ঘটিয়েই তার বক্তব্যকে সবচেয়ে স্পষ্ট করে তুলতে পারেন।"
চিনুয়া আচেবে তার সময়ের চেয়ে এগিয়ে থেকে তার সমাজকে ধরতে পেরেছিলেন।ঔপনিবেশিক শাসন পরবর্তী আফ্রিকান সমাজের জন্য একজন শিক্ষক দরকার ছিল যিনি আফ্রিকার ‘দ্য ডার্ক কন্টিনেন্ট’ তকমা ঘুঁচিয়ে দেওয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধটা চালু করে করবেন। চিনুয়া আচেবে সেই দায়িত্ব পালন করেছেন দারুণভাবে।
আচেবের নিজের কাজ এবং দায়িত্ব সম্পর্কে নিজের মূল্যায়ন নিজেই করেছেন। তিনি তার প্রবন্ধ 'দ্য নভেলিস্ট অ্যাজ টিচার'-এ লিখেছিলেন যে 'আমি যে ধরনের লেখা লিখি, তা আমাদের অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত নতুন এবং পাঠক ও আমাদের মধ্যকার জটিলতাগুলো বর্ণনা এবং তা চেষ্টা করার সময় আসেনি... জনগণকে সচল ও শিক্ষিত করার আবশ্যিক কর্তব্য থেকে নিস্তার পাওয়ার আশা একজন লেখক করতে পারেন না। আসলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। ...শিল্প গুরুত্বপূর্ণ, তবে যে ধরনের শিক্ষার কথা আমি ভাবি, তাও গুরুত্বপূর্ণ এবং আমি এ দুটিকে পারস্পরিক বিচ্ছিন্নভাবে দেখি না।'
আচেবে ‘Things Fall Apart’ রচনার মধ্য দিয়ে আফ্রিকান সাহিত্যে বি-উপনিবেশায়ণের (decolonialism) সূচনা করেন। এবং তার এই অবদানই আফ্রিকান মানস হতে পাশ্চাত্যায়ণের বিকৃতি সারাতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। আচেবের আত্নপরিচয়ের হিনমন্যতা সংকট তাদের জর্জরিত করে না। অলিম্পিক গেমসের উদ্ভোধনী পর্বে স্যুট পরে ভদ্দরলোক সাজতে হয় না তাদের। “আমি খুবই আনন্দিত হব যদি আমার উপন্যাসগুলো (বিশেষ করে যেগুলো আমি অতীত প্রেক্ষাপটে স্থাপন করেছি) আমার পাঠকদের এতটুকু পাঠ দিতে পারে যে তাদের অতীত সব অপূর্ণতা সত্ত্বেও বর্বরতার একটা দীর্ঘ আন্ধকার রজনি ছিল না,বরং ‘খোদার প্রতিনিধি’ প্রথম ইওরোপীয়রাই অমানিশার আঁধারি নিবেদন করেছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের।” আচেবের এ আশাবাদ আফ্রিকানরা ব্যর্থ হতে দেয় নি। কারণ ইগবো প্রবাদেই আছে: “Where one thing falls, another stands in its place” এবং “When the moon is shining, the cripple becomes hungry for a walk”।
চিনুয়া আচেবে কেবল কাঠখোট্টা সমাজ দায়িত্বশীল সাহিত্যিক ছিলেন না। তার রসবোধ ছিল দারুণ। তাই তো তিনি ‘Things Fall Apart’-এ নারীর পাণি প্রার্থনা করতে গিয়ে ভীরুতা নয় সাহসিকতা প্রয়োজন এমন উল্লেখ করে লিখেছিলেন,
‘আমি তার হাত ধরলে সে বলে, খবরদার আমাকে ছুঁবে না!
তার পা ছুঁতে গেলে সে বলে, খবরদার আমাকে ছুঁবে না!
কিন্তু তার কোমরের বিছা ধরে টান দিলে,
সে এমন ভাব করে যেন, এটা তেমন কিছু না।’
চিনুয়া আচেবে প্রেমে-দ্রোহে সমান। সবকিছু ভেঙে পড়লেও (Things Fall Apart) চিনুয়া আচেবেরা থেকে যান। থেকে যান আফ্রিকা থেকে শুরু করে সারা বিশ্বের মানুষের মনে অন্ধকারের মাঝে অন্ধকার তাড়ানো এক সুতীব্র আলোকচ্ছটা হয়ে।