অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে দেশের উত্তরবঙ্গে সারের জন্য কৃষকের হাহাকার শুরু হয়ে গেছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে।
এসব প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, শীতের সবজি আর আলু চাষ করতে গিয়ে বাড়তি দামে সার কিনতে হচ্ছে কৃষকদের। বোরো মৌসুমে যখন সারের চাহিদা আরও বাড়বে, তখন কী হবে, তা ভেবেই কূল কিনারা পাচ্ছে না তারা।
তবে কৃষি বিভাগ বা সার বিপণনের দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থাগুলো সংকট অস্বীকার করছে। আর সরকারও বিষয়টি নিয়ে কথা বলছে না, যেন কোথাও কোনো সংকট নেই।
রাজশাহীতে চাহিদার ১০ ভাগের এক ভাগ সরবরাহ
বাংলা নিউয নেটওয়ার্ক-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উত্তরবঙ্গের বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে ডিসেম্বরেই জেলায় যেখানে ১১ হাজার ১২৬ টন ইউরিয়া সার সরবরাহ করার কথা, পাঠানো হয় মাত্র ১ হাজার ১৩২ টন। কৃষকেরা বলছেন, সরবরাহ কম থাকার কারণ দেখিয়ে ডিলারের তাদের কাছে বাড়তি দাম নিচ্ছেন। ইউরিয়ার মত অন্য সারেরও একই ধরনের সংকট।
বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প করপোরেশন বা বিসিআইসি ইউরিয়া সার সরবরাহ করে। আর এমওপি, ডিএপি ও টিএসপি সার সরবরাহ করে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন বা বিএডিসি।
বিএডিসির গুদামে ডিসেম্বরে ১ হাজার ৮৩৭ টন টিএসপি, ৩ হাজার ৫৭১ টন এমওপি এবং ৫ হাজার ১২৪ টন ডিএপি আসার কথা। কিন্তু এই পরিমাণ সার আসেনি।
জেলার চারঘাট উপজেলার নন্দনগাছী বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী ভূগোল আলী বলেন, ‘সারের জন্য গেলে সরবরাহ নেই বলে ডিলার নজরুল ইসলাম কয়েকদিন ধরে ঘোরাচ্ছেন। সার না পাওয়ায় কলা ও পেঁয়াজের আবাদ বন্ধ হয়ে আছে।’
ডিলার নজরুল ইসলামের দাবি, বরাদ্দ থাকলেও বিএডিসি সময়মতো সার সরবরাহ করেনি। এ জন্য তিনি কৃষকদের যথাসময়ে সার দিতে পারছেন না।
রাজশাহীতে সারের সংকট শুরু মূলত নভেম্বরের মাঝামাঝিতে এসে। তখন জেলায় আলুর আবাদ শুরু হয়। আলুর আবাদের শুরুতেই প্রচুর সারের প্রয়োজন হয়। ওই সময় সংকট দেখা দেয়।
চারঘাটের পাইটখালী গ্রামের কৃষক রায়হান আলী বলেন, পেয়ারা বাগান, রসুন ও পেঁয়াজের জন্য তার টিএসপি সার প্রয়োজন। সারের জন্য ডিলারের কাছে গেলে সরবরাহ নেই বলে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘অন্য আরেক ডিলারের কাছে গেলে তিনি জানান যে সার আছে, কিন্তু বেশি টাকা লাগবে। পরে ৩৬ টাকা কেজি দরে সার কিনেছি। ডিলার রসিদ দেননি। কেজিতে ৯টাকা বেশি দিয়ে সার কিনে জমিতে দিয়েছি। এখন সত্যিই সার সংকট কি না তা আমি জানি না।’
রাজশাহীর গোদাগাড়ীর বিএডিসির সার ডিলার মেসার্স হাসান ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী হাসান আলী বলেন, ‘সার নিয়ে বড় একটা সিন্ডিকেট কাজ করে। এরা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়াতে। আবার কখনও কখনও এমনিতেও বাজারে চাহিদার তুলনায় সারের সরবরাহ কম থাকে।’
বিএডিসির রাজশাহী অঞ্চলের যুগ্মপরিচালক (সার) মো. জুলফিকার আলী দাবি করেন, ডিসেম্বর মাসে তাদের যে সারের বরাদ্দ তার সিংহভাগই চলে এসেছে। তবে এই সারের পরিমাণ কত তা তিনি জানাতে চাননি।
ডিসেম্বরে গুদামে ১১ হাজার ১২৬ টন ইউরিয়া সার সরবরাহ করার কথা থাকলেও ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ১৩২ টন সার আসার কথা জানালেও বিসিআইসির রাজশাহীর সার গুদামের সহকারী ব্যবস্থাপক সাজেদুর রহমান দাবি করেছেন, সারের কোনো সংকট নেই।
কিন্তু এই সংকট কেন হলো? জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক উম্মে সালমা যা বলছেন, তাতে মাঠ কর্মকর্তাদের কোনো দায় নেই।
তিনি বলেন, ‘কোন মাসে জেলায় কী সার কতটা প্রয়োজন হবে সে বিষয়টি আমরাই নির্ধারণ করে মন্ত্রণালয়কে দিই। মন্ত্রণালয় সে অনুযায়ী সার বরাদ্দ করে। এটা প্রতিমাসে হয় না, বছরের শুরুতেই আমরা জানিয়ে দিই।’
রংপুরে বস্তা প্রতি দাম বেড়েছে ২০০ থেকে পৌনে দুই হাজার টাকা
প্রতিবেদনে বলা হয়, রংপুর বিভাগে রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামে চাষিরা বস্তাপ্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পৌনে দুই হাজার টাকা বেশি দিতে বাধ্য হচ্ছেন। তাও সার পাওয়া যাচ্ছে না।
বিএডিসির রংপুর কার্যালয় বলছে, চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা ৩০ হাজার ৩৯৪ টন ইউরিয়া, ১০ হাজার ৮০৭ টন টিএসপি, ৩১ হাজার ৮৮৮ টন ডিএপি, ১৭ হাজার ৪৮৮ টন এমওপি সার সরবরাহ করা হয়েছে।
কৃষকরা বলছেন, ৫০ কেজির টিএসপির বস্তা ২৮০০ থেকে ৩০০০ টাকা, ডিএপি ১৩০০ থেকে ১৩৫০ টাকায় ও এমওপি বিক্রি হচ্ছে ১২০০ থেকে ১২৫০ টাকায়। অথচ এগুলো যা বিক্রি হওয়ার কথা যথাক্রমে ১৩৫০ টাকা, ১০৫০ টাকা ও ১০০০ টাকায়। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার আগমনী এলাকার বাসিন্দা মো.মোমিনুল ইসলাম এবার বাঁধাকপি, আলু, মরিচসহ একাধিক ফসলের আবাদ করেছেন।
তিনি বলেন, ‘আলুতে পটাশ, টিএসপি, ইউরিয়া লাগে কিন্তু হামরা সার পাই না। দোকানত গেলে কয় সার নাই।’
এই কৃষক অক্টোবরে টিএসপি কিনেছেন ৩০ টাকা কেজিতে, ডিসেম্বরে কিনতে হয়েছে ৩৫ টাকায়।
তিনি বলেন, ‘এত্তি (এখানে) সার পাই না সার আনছি চিলমারী, নাগেশ্বরী (পাশের উপজেলা) থাকি। বস্তা প্রতি বেশি দাম নিবার নাকছে (লেগেছে) ২০০ থাকি ৩০০ টাকা।’
কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার চরভূরুঙ্গামারী ইউনিয়নের কৃষক শফিয়ার রহমান বলেন, ‘সারের কারণে আমার আলু চাষে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থা চরতে থাকলে কৃষকদের অনেক ক্ষতি হবে।’
উপজেলার বঙ্গ সোনাহাট ইউনিয়নে বিএডিসির ডিলার মেসার্স আফি সার ঘরের স্বত্বাধিকারী আমজাদ হোসেন বলেন, ‘খুচরা বিক্রেতারা সংকট দেখিয়ে বেশি দাম নিচ্ছেন- এই বিষয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ আসছে।’
কেন সংকট- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘লালমনিরহাটের মহেন্দ্রনগরের বিএডিসির গুদামে পর্যাপ্ত সার মজুদ না থাকায় ও পরিবহন সমস্যায় আমরা গত নভেম্বর মাসের বরাদ্দের সার চলতি ডিসেম্বরে উত্তোলন করতে হয়েছে।’
লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার দূর্গাপুর গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি বেগুন, আলু আবাদ করেছি। কিন্তু টিএমপি, পটাশ সার না পেয়ে আমি হতাশ। এবার মনে হয় ভালো ফলন করতে পারব না।’
কৃষক ও ডিলাররা সংকটের কথা জানালেও বিএডিসির রংপুর বিভাগীয় অতিরিক্ত পরিচালক (সার) নির্মালায়া কুমার দাশ তা অস্বীকার করছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের হিসাব মতে সারের ঘাটতি নেই। তবে কেউ কৃত্রিম সংকট করলে সেটা আলাদা বিষয়।’