এপ্রিল ৩০, ২০২৫, ০৬:৪৪ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
দেশে সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে হুমকি ও হামলা তথা সাংবাদিকতা এবং মত প্রকাশের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার প্রয়োগের পথ রুদ্ধ করার মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
বুধবার, ৩০ এপ্রিল মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) পাঠানো এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
বিভিন্ন পত্রিকার তথ্য বিশ্লেষণ করে এমএসএফের পক্ষ থেকে প্রতি মাসে মানবাধিকার পরিস্থিতির এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। আজ এপ্রিল মাসের প্রতিবেদনটি গণমাধ্যমে পাঠান এমএসএফের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। এতে সাংবাদিকদের ইস্যু ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, নারীনির্যাতন, ধর্ষণ ইত্যাদি পরিস্থিতির মূল্যায়ন করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে যুক্ত সারণীতে বিগত দুই মাসের মানবাধিকার লংঘনের তুলনামূলক পরিসংখ্যানও তুলে ধরা হয়েছে। এতে সাংবাদিকদের প্রতি সহিংসতা বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, গত মার্চ মাসে ১৮টি ঘটনায় সাংবাদিক নির্যাতন, হামলা, আহত, হুমকি ও হয়রানির ঘটনা ঘটেছে ৩৪টি। এপ্রিল মাসে ২৪টি ঘটনায় এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৪–তে। মার্চ মাসে মামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনা ছিল ১টি, তা এপ্রিলে বেড়ে দাঁড়িয়েছে চারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে বেশ কিছু ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের যেভাবে শারীরিক, মানসিক এবং আইনি হয়রানি, আক্রমণ, হুমকি ও লাঞ্ছিত করা হয়েছে– তা শুধু অনাকাঙ্খিতই নয়, বরং সৎ সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধ করে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশে বাধা দেওয়া হচ্ছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ঢালাও মামলা দায়ের স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য হুমকি। পেশাদার সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এভাবে অব্যাহতভাবে মামলা দায়ের চলতে থাকলে এ পেশা থেকে কখনোই ভয়ের সংস্কৃতি দূর করা যাবে না।
আরও বলা হয়, যদিও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার তাদের বক্তব্যে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়ার কথা ব্যক্ত করেছে। গত মাসের চেয়ে এ মাসে সাংবাদিকতার চিত্র বেশ উদ্বেগজনক।
দেশে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল মাসে ২৪টি ঘটনায় ৬২ জন সাংবাদিক দেশের বিভিন্ন জেলায় পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় নানাভাবে হামলা, আইনি হয়রানি, গ্রেপ্তার, হুমকি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এছাড়াও ১ জন নারী সাংবাদিক রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় হেনস্তার শিকার হয়েছেন।
আক্রান্ত সাংবাদিকদের মধ্যে ৮ জন সাংবাদিক তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় আহত ও হামলার শিকার হয়েছে। লাঞ্ছিত ও হুমকির শিকার হয়েছে ৯ জন, হয়রানির শিকার হয়েছে ৩ জন, ৪টি মামলা ও ১টি জিডিতে আইনি হয়রানির শিকার হয়েছে ৪১ জন এবং ২জন সাংবাদিককে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে।
এ মাসে দায়েরকৃত ৪টি মামলার মধ্যে ২টি হত্যা, ১টি মানহানি এবং ১টি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে করা হয়েছে। আর অনলাইনে একজন টিকটকারের জুয়ার প্রচারণার বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দেওয়ার জন্য চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থানায় ৪ জন সাংবাদিকসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে জিডি করেছেন জনৈক টিকটকার
এ মাসের ২৪টি সাংবাদিক নির্যাতন সংক্রান্ত ঘটনার ৬টিতে বিএনপি, ২টিতে জামাত, ১টিতে বিএনপি-আওয়ামী লীগ, ১টিতে কিশোরগ্যাং, ১ টিতে ব্যবসায়ী, ১টিতে জুলাই আন্দোলনে নিহতের পরিবার, ১টিতে সাবেক চেয়ারম্যান, ১টিতে বিএনপি নামধারী, ১টিতে জুলাই আন্দোলনকারী নামধারী, ১টিতে ভূমিদস্যু, ১টিতে সরকারি কর্মকর্তা, ১টিতে দীপ্ত টিভি ২জন চাকরিচ্যুত ও এটিএন বাংলা টিভি ১জনকে অব্যহতি দিয়েছে, ১টিতে টিকটকার এবং ৫টি ঘটনায় দুষ্কৃতিকারীদের সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে জানা যায়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২ এপ্রিল পটুয়াখালী সদর উপজেলার বদরপুর ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও লুটপাটের অভিযোগে মামলার বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় সাংবাদিক মো. মোস্তাফিজুর রহমানকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।
৬ এপ্রিল বগুড়ায় জলেশ্বরীতলা এলাকার লাবাম্বার মোড়ে দুপুরে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় দুই সাংবাদিক মাছরাঙা টেলিভিশনের জেলা প্রতিনিধি খোরশেদ আলম ও স্থানীয় একটি অনলাইন পোর্টালের প্রতিবেদক আসাউদ্দৌলা নিয়ন আহত হন।
৬ এপ্রিল নাটোরের লালপুরে ফেসবুকে চাঁদাবাজি বন্ধের দাবিতে পোস্ট দেওয়াকে কেন্দ্র করে এনটিভির অনলাইন করেসপন্ডেন্ট (লালপুর-বাগাতিপাড়া) সজিবুল হৃদয়কে (২৬) জুলাইযোদ্ধা পরিচয়ে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছেন মনজুর (৪২) নামে এক ব্যক্তি।
৭ এপ্রিল মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে সাংবাদিক মানবেন্দ্র চক্রবর্তীকে মারধরের হুমকি দেওয়া হয়।
২২ এপ্রিল সাতক্ষীরার তালায় উপজেলা কমপ্লেক্স ভবন তৈরির তথ্য সংগ্রহ করার সময় বাক-বিতণ্ডার জেরে সাংবাদিক কামরুজ্জামানকে সরকারি কাজে বাধা প্রদান এবং একজন উপসহকারী প্রকৌশলীকে মারধর করার অভিযোগে ১০ দিনের বিনাশ্রম দণ্ডাদেশ দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
১৭ এপ্রিল খুলনার কয়রা উপজেলায় ২০১৩ সালের জামায়াতে ইসলামীর কর্মী জাহিদুল ইসলাম হত্যার ঘটনায় আওয়ামী নেতাকর্মীদেরসহ ছয় সাংবাদিকের নামে মামলা করেছেন নিহতের স্ত্রী ছবিরন নেছা। ৬ সাংবাদিক ছিলেন, দৈনিক ভোরের কাগজের কয়রা প্রতিনিধি শেখ সিরাজুদ্দৌলা লিংকন, কয়রা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেন, দৈনিক যায় যায় দিনের মাস্টার হাবিবুল্লাহ, দৈনিক কালের কণ্ঠ ও পূর্বাঞ্চলের ওবায়দুল কবির সম্রাট, দৈনিক খুলনা অঞ্চলের শাহাজান সিরাজ, আজকের দর্পণের তারিক লিটু। মামলায় সাংবাদিকদের নাম থাকার বিষয়ে বাদী ছবিরুন নেছা জানান, স্থানীয় রাজনৈতিক ও জনপ্রতিনিধিদের পরামর্শে মামলা করেছেন। তিনি মামলার আসামিদের চেনেন না। মামলার ৩৯ নম্বর আসামি কালের কণ্ঠের সাংবাদিক ওবায়দুল কবির সম্রাট জানান, মামলার সময় তার বয়স ছিল ১৬ বছর।
২০ এপ্রিল ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. হাসিবুজ্জামানের আদালতে গুলিতে প্রাণ হারানো মাহফুজ আলম শ্রাবণের ভাই মোস্তাফিজুর রহমান বাপ্পী হত্যা মামলার আবেদন করেন। এ মামলায় ২৪ জন সাংবাদিকসহ ৪০৮ জনকে আসামি করা হয়েছে।
২৩ এপ্রিল ফুলগাজীর মাদককারবারি রহিম উল্ল্যাহকে নিয়ে সংবাদ করায় দৈনিক ফেনীর ৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অভিযুক্ত ব্যক্তিটি মানহানির মামলা করেছেন।
২৩ এপ্রিল সংবাদ সংগ্রহের জেরে চুয়াডাঙ্গা দামুড়হুদার দৈনিক যুগান্তর প্রতিনিধি ও দর্শনা প্রেসক্লাবের সভাপতি ইকরামুল হক পিপুলকে প্রাণনাশ ও তুলে নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন বিএনপির নেতা নাহারুল ইসলাম মাস্টার।
২৮ এপ্রিল প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত ঈদ শুভেচ্ছা কার্টুনে ‘ঈদ মোবারক’ লেখার পাশে কুকুরের ছবি ব্যবহার করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে পত্রিকাটির সম্পাদক, প্রকাশক ও গ্রাফিকস ডিজাইনারকে আসামি করে মামলার অনুমতি চেয়েছেন নজরুল ইসলাম নামের একজন ব্যবসায়ী।