মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আবারও বিকৃত করলো জামায়াতে ইসলামী

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ডিসেম্বর ১৬, ২০২২, ১১:৩৬ পিএম

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আবারও বিকৃত করলো জামায়াতে ইসলামী

বুধবার (১৪ ডিসেম্বর) ছিল শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালের এদিনে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। দিবসটি উপলক্ষে একটি ভার্চ্যুয়াল আলোচনার সভার আয়োজন করে জামায়াতে ইসলামীও।

এই আলোচনা সভাকে দলটি আরও একবার ইতিহাস বিকৃতিতে ব্যবহার করেছে। সভায় দলটির নেতারা বলেন, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল যাতে বাংলাদেশ একটি প্রতিবেশি দেশের সাহায্য ও সহযোগিতা ছাড়া মাথা তুলে না দাঁড়াতে পারে।

জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক দুইদিন আগে। এমনকি ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা দিবসের পরও অনেককে হত্যা করা হয়। তখন দেশে কোনো পাকিস্তানি সেনা ছিল না। তাহলে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারা জড়িত ছিল? এসব হত্যার জন্য আমরা কি পাকিস্তানি সেনাদের দোষারোপ করতে পারি?’

এ জামায়াত নেতার মতে, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পেছনে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাত ছিল। তিনি বলেন, ‘এজন্য ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাও দায়ী থাকতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কারা ছিল, তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব ছিল তাদের, যারা স্বাধীনতার পর ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু তারা সেটা করেনি। তারা এটা জেনেশুনেই করেনি।

আলোচনা সভার সভাপতির জামায়াত নেতা নুরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার দুদিন আগেই রাজধানী ঢাকা শহর ঘিরে ফেলা হয়েছিল। পুরো শহর তখন মুক্তিযোদ্ধারা নিয়ন্ত্রণ করছিলেন।

বহু আগে থেকেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ষড়যন্ত্র ও ইতিহাস বিকৃতি করে আসছে জামায়াত। সবশেষ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরি করে নির্লজ্জভাবে দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি করেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার।

মুক্তির মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকেই ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেয়ার চেষ্টা করেছিল বিএনপি। এরপর দেশে জঙ্গি-সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল স্বাধীনতাবিরোধী এই অপশক্তি। কিন্তু দেশের মানুষ বেশিদিন এই অপশক্তিকে সহ্য করেনি।

২০০৮ সালেই জনগণ ক্ষমতায় নিয়ে আসে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে। এরপর বিকৃত ইতিহাসকে আবার আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দেশ যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভর করে উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে চলেছে ঠিক সেসময় আবার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির ষড়যন্ত্র শুরু করেছে বিএনপি।

দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পলাতক আসামি তারেক রহমানকে ‘শিশু মুক্তিযোদ্ধা’ এবং দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে ‘প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা’ বলেও দাবি করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

দল হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি জামায়াতে ইসলামী। আর তাই তারা মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপক বিরোধিতা করেছিল। শুধু বিরোধিতাই নয়, যুদ্ধকালে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে পাক সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছে।

পরাজয় নিশ্চিত জেনে মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শেষ সময়ে এসে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার ঘৃণ্য চক্রান্ত করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। শিক্ষক, বিজ্ঞানী, চিন্তক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, ক্রীড়াবিদ, সরকারি কর্মকর্তাসহ বহু মানুষকে হত্যা করে।

বিশেষ করে ১৪ ডিসেম্বর তারা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। আর এ হত্যাযজ্ঞে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল বদর ও আল শামসের মতো তাদের এ দেশীয় দোসর। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের পর রাজধানীর রায়েরবাজার ইটখোলা ও মিরপুরের বধ্যভূমিসহ ঢাকা এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের চোখ-হাত বাঁধা ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া যায়।

আল বদরের সাহায্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও বিভিন্ন স্থান থেকে শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, সংস্কৃতিকর্মীসহ বিভিন্ন পেশার বরেণ্য ব্যক্তিদের অপহরণ করা হয়। পরে নিদারুণ যন্ত্রণা দিয়ে রায়েরবাজার ও মিরপুরে তাদের হত্যা করা হয়। এ দুটি স্থান এখন বধ্যভূমি হিসেবে সংরক্ষিত।

মুক্তিযুদ্ধের শেষ লগ্নে ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে আলবদর বাহিনী আরও অনেক বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে স্থাপিত আলবদর ঘাঁটিতে নির্যাতনের পর রায়েরবাজার বধ্যভূমি ও মিরপুর কবরস্থানে নিয়ে হত্যা করে।

শহিদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছেন—অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ডা. আলিম চৌধুরী, অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান, ড. ফজলে রাব্বী, সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, অধ্যাপক জি সি দেব, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক রশীদুল হাসান, ড. আবুল খায়ের, ড. মুর্তজা, সাংবাদিক খন্দকার আবু তাহের, নিজামউদ্দিন আহমেদ, এস এ মান্নান (লাডু ভাই), এ এন এম গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ নাজমুল হক, সেলিনা পারভিনসহ আরও অনেকে।

বেছে বেছে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ঘটনা বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। তারা শহিদ হন এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী তাদের পরাজয় আসন্ন জেনে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে বুদ্ধিজীবী নিধনের এই পরিকল্পনা করে।

একাত্তরের সেই যুদ্ধাপরাধী ও বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকের বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। এর মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত অনেকের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় ঘোষিত হয়েছে। মানবতাবিরোধী হত্যা মামলায় দণ্ডিত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছে।

জামায়াতের অপর নেতা মো. কামারুজ্জামান ও বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম হোতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। ২০১৬ সালের ১১ মে মুক্তিযুদ্ধকালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নীলনকশা বাস্তবায়নকারী গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর প্রধান ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়। 

Link copied!