আজ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক অনন্য দিন আজ।জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের এই দিনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দান) বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন।
এ দিন লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষের উপস্থিতিতে মহান নেতা বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বিভিন্ন ব্যক্তি ও গণমাধ্যম বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণকে বিভিন্নভাবে মূল্যায়ন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ক্ষমতাবান সরকারসমূহ ও বিশ্বসম্প্রদায় গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিল। ১৯৭৪ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী শন ভ্যাকব্রাইড বলেছেন, “শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন, কেবল ভৌগোলিক স্বাধীনতাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন মানুষের মুক্তি, বেঁচে থাকার স্বাধীনতা। সাম্য ও সম্পদের বৈষম্য দূর করাই স্বাধীনতার সমার্থ। আর এ সত্যের প্রকাশ ঘটে ৭ই মার্চের ভাষণে।”
ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ Jacob F. Field, We shall Fight on The Beaches : The Speeches That Inspired History শিরোনামে যে গ্রন্থ রচনা করেছেন (লন্ডন, ২০১৩), তাতে অন্যান্য শ্রেষ্ঠ ভাষণের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩১ সালে গ্রিক নগররাষ্ট্র এথেন্সের রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিস থেকে শুরু করে আলেকজান্ডার, হ্যানিবল, জুলিয়াস সিজার, সালাদিন, নেপোলিয়ন, গ্যারিবল্ডি, আব্রাহাম লিঙ্কন, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন, এডলফ হিটলার, চার্চিল, মাও, রুজভেল্ট, স্টালিন, হো চি মিন হয়ে ১৯৮৭ সাল বার্লিন ওয়ালের সম্মুখে মার্কিন রোনাল্ড রিগানের ভাষণসহ ৪১ জন সামরিক বেসামরিক জাতীয় বীরের বিখ্যাত ভাষণ নিয়ে ওই গ্রন্থটি রচিত হয়।
মার্কিন গণমাধ্যম নিউজউইক তার ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল সংখ্যায় ভাষণটির জন্য বঙ্গবন্ধুকে পোয়েট অব পলিটিক্স (রাজনীতির কবি) আখ্যায়িত করে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছেন, “৭ই মার্চের ভাষণ একটি অনন্য দলিল। এতে একদিকে আছে মুক্তির প্রেরণা। অন্যদিকে আছে স্বাধীনতার পরবর্তী কর্ম পরিকল্পনা।”
যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ বলেছেন, “পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চির জাগরুক থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা।”
রয়টার্স-এর মতে “বিশ্বের ইতিহাসে এ রকম আর একটি পরিকল্পিত এবং বিন্যস্ত ভাষণ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে একই সঙ্গে বিপ্লবের রূপরেখা দেওয়া হয়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গে দেশ পরিচালনার দিকনির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।”
ফরাসি বার্তা সংস্থা্ এএফপি বলেছে, “৭ই মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব আসলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বাঙালিদের যুদ্ধের নির্দেশনাও দিয়ে যান। ওই দিনই আসলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।’
দ্যা ওয়াশিংটন পোস্ট ১৯৭১-এর এক ভাষ্যে বলা হয়, ‘শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণই হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক ঘোষণা। পরবর্তীতে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে ঐ ভাষণেরই আলোকে।’
ʻআনন্দবাজার পত্রিকা’ ১৯৭২ এক নিবন্ধে বলা হয়, ‘উত্তাল জনস্রোতের মাঝে, এ রকম একটি ভারসাম্যপূর্ণ, দিকনির্দেশনামূলক ভাষণই শেখ মুজিবকে অনন্য এক ভাবমূর্তি দিয়েছে। দিয়েছে অনন্য মহান নেতার মর্যাদা।’
সম্প্রতি ইউনেস্কো মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে ʻমেমোরি অফ দা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারে’ যুক্ত করেছে। বিশ্বের প্রামাণ্য ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হল ভাষণটি বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ভাষণ। পৃথিবীর আর কোনো ভাষণ সারা পৃথিবীতে এতবার প্রচারিত ও শ্রুত হয়নি। ভাষণটি ১২টি ভাষায় অনুবাদ করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বিশ্বের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ২২ ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। যে ২২টি ভাষায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অনুবাদ হয়েছে, সেগুলো হলো বম, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি, চাকমা, গারো, হাজং, খাসি, খিয়াং, কোচ, কোল, লুসাই, মাহালে, মেইতে মণিপুরি, ম্রো, মুন্ডা, ওঁরাও কুরুখ, ওঁরাও সাদ্রি, পাহাড়ি, পাংখোয়া, সাঁওতাল, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা ও কোডা। সংখ্যায় বেশি বা পরিচিত চাকমা, গারো, সাঁওতাল ভাষার পাশাপাশি সংখ্যা একেবারে কম পাংখোয় এবং কোডাদের ভাষায় এ ভাষণ অনুবাদ হয়েছে।
আব্রাহাম লিঙ্কনের গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস বিশ্বের সেরা ভাষণ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। জনসভার জন্য লিংকন আগের দিন একটি লিখিত বক্তব্য তৈরি করেন যেটি তিনি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। এই ভাষণের পাঁচটি খসড়া ছিল। পরে সেগুলো বারবার এডিট করে ভাষণটি চূড়ান্ত করা হয়। মাত্র দুই মিনিটে সমাপ্ত ভাষণে মোট ১০টি বাক্য এবং ২৭২টি শব্দ ছিল। মজার কথা, সে দিনের সেই সভায় আব্রাহাম লিংকনের বক্তৃতা দেয়ার কথা ছিল না। সভার মূল বক্তা ছিলেন আমেরিকার বিখ্যাত ও সবচেয়ে জনপ্রিয় বক্তা এ্যাডওয়ার্ড এভারেস্ট। লিংকনের পূর্বে তিনি দুই ঘণ্টা বক্তৃতা করেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তার এই বক্তৃতা ইতিহাসের পাতায় স্থান পায়নি।
এদিক দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়,ভাষণের মোট সময়কাল ১৮ মিনিট, শব্দ ১১০৫ (এক হাজার একশত পাঁচ)। অপরদিকে, মার্টিন লুথার কিং-এর ‘I have a dream’ Address-এর সময় ছিল ১৭ মিনিট, শব্দ সংখ্যা ১৬৬৭।
কিন্তু বিশ্বের কোনো নেতার ভাষণ এমন সংগ্রামমুখর ১০ লক্ষাধিক মুক্তিকামী নিরস্ত্র মানুষের সামনে হয়নি।আব্রাহাম লিংকন মঞ্চে উঠে প্রায় ১৫ হাজার মানুষের সামনে ওই ভাষণ দিয়েছিলেন। বিশ্বের বিখ্যাত ভাষণগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণই ছিল অলিখিত।
পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণটি প্রদান করে মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে, নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এখানেই নেতার বিচক্ষণতা। এখানেই অনন্য শেখ মুজিব-পোয়েট অব পলিটিক্স।