জুলাই ১৫, ২০২৪, ১২:৩৫ পিএম
চীন সফর পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ সংক্রান্ত মন্তব্যের জের ধরে সংক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে ছাত্রসমাজ। উত্তাল হয়ে উঠেছে ক্যাম্পাস। মধ্যরাতে হঠাৎই শ্লোগানমুখর হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা এ সময় শ্লোগানমুখর হয়ে উঠলেও একপর্যায়ে ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ শ্লোগান ওঠায় ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা তীর্যক মন্তব্য করেছেন। এ ছাড়া সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনের জোয়ার উঠেছে জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম ও সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছেন। তাদের আন্দোলনে রাতভর চলতে থাকে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। উত্তাল ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা যখন কোটা বাতিলের দাবি তুলছেন, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শোডাউন করেছেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। তাদের সঙ্গে সংহতিও জানান তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, নৌ-প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ সুজনসহ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আরও অনেক নেতাকর্মী। ক্যাম্পাসগুলোতে কোটা বাতিলের দাবিতে রাতভর আন্দোলন নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে মধ্যরাতে হঠাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাস উত্তাল হয়ে উঠেছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের প্রতিবাদ মিছিলের খবর এসেছে।
আরও পড়ুন: মধ্যরাতে হঠাৎ উত্তাল শিক্ষার্থীরা, ছাত্রলীগের শোডাউন
রোববার (১৪ জুলাই) রাত ১১টার দিকে কয়েক শ’ শিক্ষার্থী কোটা বাতিলের দাবিতে হল থেকে বেরিয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হন। পরবর্তীতে রাত দেড়টার দিকে ধীরে ধীরে নিজ নিজ হলের দিকে ফিরে যেতে থাকেন শিক্ষার্থীরা।
কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনার পর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদার পদত্যাগ করেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল শাখা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ ওঠে।
সোমবার (১৫ জুলাই) ভোররাত তিনটার দিকে হামলার ঘটনা ঘটে। এর আগে চীন সফর পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে কেন্দ্র করে গতকাল রোববার রাত ১০টার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) বিভিন্ন আবাসিক হলের শিক্ষার্থীরা শ্লোগানমুখর হয়ে ওঠেন। এরপর রাত সাড়ে ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা এলাকায় জড়ো হতে থাকেন আবাসিক শিক্ষার্থীরা।
একপর্যায়ে অভিযোগ ওঠে, সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত দুজনকে অবরুদ্ধ রেখে ফোন তল্লাশি শুরু করে ছাত্রলীগ। ক্যাম্পাসে এই খবর জানাজানি হলে রাত রাত সাড়ে ১২টার দিকে বটতলা এলাকা থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে হলের সামনে অবস্থান গ্রহণ করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় ফোন তল্লাশির ঘটনায় জড়িতদের ক্লোজড সার্কিট টিভি (সিসিটিভি) ফুটেজ দেখে চিহ্নিতের দাবি জানাতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। হলের প্রাধ্যক্ষকেও এই অনুরোধ জানাতে থাকেন তারা। শিক্ষার্থীদের পীড়াপীড়িতে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মীকে নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদার। এই বৈঠক চলাকালীনও শিক্ষার্থীরা হলের সামনে ও ক্যাম্পাসের অন্যান্য স্থানে শ্লোগানমুখর হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছিলেন।
রাত দেড়টার দিকে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়কে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি রাত সোয়া দুইটার দিকে আবারও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের সামনে অবস্থান নিতে উদ্যত হলে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা বাধা দেন ও মুখোমুখি অবস্থান নেন। এ সময় দু’পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এরপর রাত পৌনে তিনটার দিকে বাধা উপেক্ষা করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের পাল্টা ধাওয়া করেন শিক্ষার্থীরা। পরে তারা হলের সামনে পৌঁছালে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।
এরই মধ্যে হামলার একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল ছাত্রলীগ সভাপতি পদপ্রত্যাশী ৪৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী প্রাচুর্যসহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করতে দেখা গেছে।
ছাত্রলীগের হামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী আহসান লাবিব এবং নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী সোহাগী সামিহাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তাও আহত হয়েছেন। তাদেরকে প্রাথমিকভাব বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া হয়েছে। কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, হলের প্রাধ্যক্ষের উসকানিতেই এই ঘটনা ঘটেছে। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ছাত্রলীগের হামলার ঘটনায় অন্তত ৬-৯ জন আহতের খবর এসেছে।
রোববার (১৪ জুলাই) বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে আসা এক বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় মধ্যরাতে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মিছিল ও সমাবেশ করেন। বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, “যদি মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিরা কোটা সুবিধা না পায়, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-নাতনিরা এই সুবিধা পাবে?”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরতদের দাবি, কথিত ছাত্রলীগ সদস্যরা মধ্যরাতে প্রতিবাদ সভায় উপস্থিত হয়ে তাদের ওপর হামলা চালায় এতে অন্তত চারজন আহত হয়েছেন।
রাত ১১টার দিকে বিভিন্ন হল থেকে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে জিরোপয়েন্টে উপস্থিত হন। তারা প্রধানমন্ত্রীর ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ মন্তব্যের সমালোচনা করে শ্লোগান দিতে থাকেন। কর্মসূচির আধাঘণ্টা পর ছাত্রলীগ নেতারা বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে তাদের ওপর হামলা চালায় বলে অভিযোগ এসেছে।
চবিতে কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনের অন্যতম সমন্বায়ক রাসেল বলেন, “আমাদের কর্মসূচি চলাকালীন অতর্কিত হামলা করা হয়। কারা আমাদের ওপর হামলা করেছে সেটা আমি জানি না। আমাদের চারজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন; তাদের মধ্যে একজন মেয়েও রয়েছেন। ঘটনাস্থলে ক্রুড বোমা বিস্ফোরন করা হয়েছে।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক পার্থ প্রতিম বড়ুয়া বলেন, “আমি মারামারির পর এখানে এসেছি। কিন্তু আমি শুনেছি যে আন্দোলনকারীরা আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে শ্লোগান দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত আমরা তাদের আন্দোলন থামানোর চেষ্টা করিনি। আমরাও চেয়েছিলাম কোটা ইস্যুতে একটা মীমাংসা হোক। কিন্তু স্বাধীন দেশে রাজাকার শ্লোগান দেওয়া ঠিক নয়।”
এদিকে সোমবার রাত একটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরতদের ওপর ছাত্রলীগ সদস্যরা হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন শাবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী দেলোয়ার হোসেন শিশির আহত হয়েছেন।