সূর্যোদয়ের দেশ জাপান বা হিমালয়কন্যা নেপাল সম্পর্কে আমরা জানি সেখানে প্রচুর কাঠের ভবন। ভূমিকম্পপ্রবণ দেশগুলোতে কাঠ দিয়ে ভবন বানানো হয় মূলত ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি একইসাথে এড়াতে এবং কমিয়ে আনতে। কংক্রিটের ভবন ভূমিকম্প বিধ্বস্ত হলে তাতে হতাহতের পরিমাণ যেমন বেশি হয় ঠিক তেমনি বারবার পুনঃনির্মাণের খরচ বিবেচনা করেই মূলত কাঠের বাড়ি বানানো হয়।
তবে প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কাঠের ভবন বানাতে দেখেছেন কখনো? এবার সিঙ্গাপুরের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বানিয়েছে একটি কাঠের ভবন। মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন বলছে এটি এশিয়ার সবচেয়ে বড় কাঠের ভবন। প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ছয়তলা একটি ভবন... ব্যপারটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি।
নানিয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির (এনটিইউ) এ ভবনটির সবকিছুই কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। ভবনটির মেঝের আয়তন বা ব্যবহারযোগ্য ফ্লোরের পরিমাণ ৪৩ হাজার ৫০০ বর্গমিটার)। এই আয়তনের জন্যেই এশিয়ার বৃহত্তর হয়ে উঠেছে ভবনটি।
পৌরাণিক গ্রিক দেবি গাইয়ার নামের ভবনটি গত মে মাসে উন্মুক্ত করা হয়। গাইয়া ছিলেন ধরিত্রির দেবী যাকে Mother Earth উপাধি দেওয়া হয়।
এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছেন জাপানের স্থপতি তোয়ো ইতো যার মতে নকশার সঙ্গে প্রাকৃতিক উপাদান যেমন পানি, গাছ ইত্যাদি যুক্ত করার চেষ্টা করেছেন তিনি।
ইতো ২০১৩ সালে স্থাপত্যে নোবেলখ্যাত প্রিতজ-কার আর্কিটেকচার পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯০ সিটের অডিটরিয়াম ও ১ ডজনের বেশি শ্রেণিকক্ষ, গবেষণাগার, অফিস ও পড়াশোনার জায়গা রয়েছে এই কাঠের ভবনটিতে। যেটি তৈরিতে খরচ হয়েছে বাংলাদেশি মুদ্রায় এক হাজার সাত কোটি টাকা।
নতুন প্রজন্মের প্রকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত কাঠ দিয়ে এই ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। কয়েকটি স্তরে কাঠ ও আঠা বসিয়ে কাঠামোগুলো দাঁড় করানো হয়েছে। এতে আলাদা কোনো রং ব্যবহার করা হয়নি। এর নকশা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে দর্শনার্থীরা কোনো বনে হাঁটার মতোই অনুভূতি পান।
অস্ট্রিয়া, সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের স্প্রুস কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে ভবনটি নির্মানে। নির্মাণকাজ ও এসেম্বলিং যাতে সহজ হয় সে কারণে এসব দেশ থেকে সংগৃহীত কাঠগুলোকে ইউরোপে টেকসই প্যানেল এবং শক্তিশালী বিমের আকৃতি দান করে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়েছে।
স্থানীয় প্রবিধানের কারণে কিছু অংশে যেমন শৌচাগার, বহিঃসিঁড়ি ও নিচের মেঝের স্ল্যাব বাদে সবকিছুতেই কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে।
সিঙ্গাপুরের বিল্ডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন অথরিটি (বিসিএ) দাবি করেছে, কাঠের ব্যবহারে নির্মাণ এলাকায় ধুলা ও শব্দদূষণ কম হয়। এ ছাড়া দ্রুত নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা যায়।
এ ধরনের ভবন নিরাপদ। আগুন লাগলেও সহজে ধসে পড়ে না। কারণ, বিশেষজ্ঞরা এই কাঠের বিমের ওপর একধরনের কাঠের স্তর যোগ করেছেন, যাতে আগুন লাগলেও মূল কাঠামোর কোনো ক্ষতি হবে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই কাঠের ভবনের সবচেয়ে বড় উপকারিতা হলো এটি পরিবেশবান্ধব।
স্কাইস্ক্র্যাপার বুর্জ খলিফার নাম তো অনেকেই জানেন। তেমনি কাঠ নির্মিত সুউচ্চভবনগুলোকে প্লাইস্ক্র্যাপার বলা হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বিশ্বজুড়ে কাঠের কাঠামোর বিপ্লব শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের Wisconsin অঙ্গরাজ্যের মিলওয়াকি শহরে, ২৫ তলা বিশিষ্ট ভবনের নাম অ্যাসেন্ট MKE ২৮৪ ফুট উচ্চতার ভবনটি বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা কাঠ/টিম্বারের ভবন।
বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ এনার্জি খরচ হয় ভবন নির্মাণ এবং পরিচালনার জন্য। কংক্রিটের ভবন হতে কার্বণ নিঃসরণের ঝুঁকি থাকলেও টিম্বারের ভবনে সেই ঝুঁকি অনেকাংশেই কম।
বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টিনাতেও দেখা যায় এমন কাঠের ভবন। বাংলাদেশের বণ্যা ও ঘূর্ণিঝড় প্রবণ এলাকাগুলোতে একসময় দেখা যেত কাঠের বাড়ি। এখন অবশ্য আর্থিক অবস্থার উন্নতির সাথে সাথে শক্ত পোক্ত কনক্রিটের দালান-ই পছন্দ করেন জনগণ।
তীব্র গরম ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যখন আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো হিমসিম খাচ্ছে, তখন কার্বন নিঃসরণ কমাতে এমন প্রাকৃতিক বাড়ি নির্মাণ চমৎকার উদ্যোগ হতে পারে।
তাপ কমাতে হীট অফিসার নিয়োগ সহ নানা উদ্যোগ যেভাবে নেওয়া হচ্ছে সেভাবেই প্রাকৃতিক উপায়ে স্থাপনা বানানো যেতেই পারে।