‘পুরুষের কাঁদতে নেই। ভয়-লজ্জা এসব তো নারীদের ব্যাপার। পুরুষ হবে শক্তিশালী, পরিশ্রমী, আবেগহীন। পুরুষকে রোজগার করে পরিবারের হাল ধরতে হবে, নিজের শখ আহ্লাদ বাদ দিয়ে পরিবারের কথা ভাবতে হবে।’
পুরুষ সম্পর্কে এই ধারণাগুলো আমাদের সমাজে প্রচলিত। দুঃখ-কষ্ট, রাগ-হতাশা, অভিমান-হাহাকারের মত অতি সাধারণ মানবীয় প্রতিক্রিয়াগুলো আড়াল করতে হয় পুরুষকে। ছেলে হয়ে জন্ম নিয়ে স্বাভাবিক মানবিক আবেগ কাউকে টের পেতে দেওয়া যেন মস্ত অন্যায়!
কোনো পুরুষ আবেগপ্রবণ হলেই কিছু কথা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি-
‘ফ্যাচ ফ্যাচ কইরা কান্তাছস ক্যা, তুই কি মাইয়া নাকি?’
‘হালায় মাইয়াগো মত অভিমান করে’
‘পুরুষমানুষ হইয়া ভয়/লজ্জা পাস ক্যামনে? এর চেয়ে মাইয়াগো মত দুই হাতে চুড়ি পইরা ঘরে গিয়া বইসা থাক’
‘অ্যাই, তুমি না ব্যাডা? এইগুলা কী বল? আর কাউরে কইওনা, মাইনসে হাসব!’
এই সমাজই দায়ী
যুগ যুগ ধরে সমাজে যে পুরুষতান্ত্রিকতা বিদ্যমান তার ফলেই নির্ধারণ হয়েছে পুরুষ ও নারীর অবস্থান। পুরুষ মানেই পরিবার ও সমাজের কর্তা। আর পুরুষের কর্তৃত্ব, প্রভুত্বকে মান্য করে নারী। সামাজিক রীতি অনুসারে, মেয়ে বিয়ে করে অন্য একটি পরিবারে চলে যায়। সমাজের সকল অসঙ্গতি মেনে নিয়ে সংসার করে। আর ছেলে সন্তান পরিবারের হাল ধরে। সম্পত্তির উত্তরাধিকার হয়। বৃদ্ধ বাবা মাকে দেখে। ফলে পুরুষকে হতে হবে কঠোর ও সিদ্ধান্ত প্রণেতা।
পুরুষেরও আছে কষ্ট, আছে বেদনা-গ্লানি। অথচ পুরুষ কাঁদলে সেটাকে ধরা হয় কাপুরুষতা হিসেবে। যে পুরুষ কাঁদে তাকে কমজোরি ভাবা হয়, যেখানে নারীর কান্না স্বাভাবিক দেখা হয়। তার অর্থ কি এই দাঁড়ায় না নারীরা তো দুর্বলই তারা তো কাঁদবেই। পুরুষের কাঁদতে নেই এই পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাটি মোটা দাগে নারীকে দুর্বল হিসেবেই প্রমাণ করে।
‘প্যারালেল ওয়ার্ল্ডস’ নামের এক তথ্যচিত্রে দেখা গিয়েছে জুভেন্টাসের তারকা ফরোয়ার্ড ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে। বক্সার গেনাডি গোলোভকিনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় নিজের অজানা দিকই তুলে ধরেছেন সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই ক্রীড়া তারকা।
সেই তথ্যচিত্রে তিনি বলেছেন, ‘আমার মতে, একজন মানুষের আবেগ-অনুভূতি থাকা ভালো। আমি মানুষ হিসেবে কেমন, সেটা আমি দেখাই না। মানুষ বলে, পুরুষ কখনো কাঁদে না। কিন্তু কে বলেছে পুরুষেরা কাঁদে না? আমাদেরও আবেগ আছে। আমাদেরও অনুভূতি আছে। আমরাও সেগুলো প্রকাশ করতে পছন্দ করি!’
পরিবারও দায়ী যেভাবে
বেশিরভাগ বাবা-মা ছেলের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য বলেন, ‘তোমাকে পারতে হবে বা তুমি পারবে।’ অন্যদিকে মেয়েকে বলেন, ‘সহ্য করো, মেনে নাও’। পরিবারে ছেলেদের মতামতের অনেক দাম। অনেক সময় পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে মায়ের চেয়ে ছেলের কথায় গুরুত্ব দেওয়া হয় বেশি। এভাবে ছোটবেলা থেকে ছেলে পরিবারে নিজের গুরুত্ব বুঝতে পারে। বড় হলেও চিন্তার ধরন আর পাল্টায় না।
পুরুষের মনের খোঁজ কে রাখে
মেয়েরা যত সহজে তাঁদের কষ্ট প্রকাশ করতে পারেন; পারিবারিক, সামাজিক, সংস্কৃতিক কারণে ছেলেরা সেটা পারেন না। নানান গৎবাঁধা গণ্ডির মধ্যে আটকে থেকে, নিজেদের ‘পুরুষ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে অনুভূতি প্রকাশে আর স্বচ্ছন্দ থাকেন না ছেলেরা। ফলে একধরনের যোগাযোগহীনতার ভেতর ভেঙে পড়ে পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্য।
শারীরিক সুস্থতা নিয়ে সবাই যতটুকু সচেতন, মানসিক স্বাস্থ্য ততটাই অবহেলিত। আর পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্য আরও বেশি করে অবহেলিত।
কষ্ট আর হাহাকার কারো সাথে শেয়ার করতে না পারার এই প্রবল মানসিক যন্ত্রণা অথবা বুকের ভেতর জমতে থাকা কান্নাগুলোয় তাকে ক্রমাগত গ্রাস করে নিতে থাকে ডিপ্রেশন নামের এক ভয়াবহ হা মেলে থাকা দানব।
এসব কারণে অনেক ছেলেই মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত, নেশাগ্রস্ত হয়ে ওঠে কিংবা আত্মহত্যার দিকেও ঝুঁকে পড়েন। মানসিকভাবে অসুস্থ একজন যেমন নিজেকে শেষ করে দেন, তেমনি শেষ করে দিতে পারেন তাঁর পরিবার আর কাছের মানুষকেও।
আজকের দিনটি পুরুষের
আজ ১৯ নভেম্বর। বিশ্ব পুরুষ দিবস। বিশ্বব্যাপী লিঙ্গভিত্তিক সমতা, বালক ও পুরুষদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা এবং পুরুষের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরার প্রধান উপলক্ষ হিসেবে প্রতিবছর দিবসটি পালন করা হয়।
এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে “জিরো মেল সুইসাইড” এর উপর ভিত্তি করে। অর্থাৎ পুরুষদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা থাকে এবং সেটা শূন্যে নামিয়ে আনাই লক্ষ্য।
প্রতিবছর ১৯ নভেম্বর বিশ্বজুড়ে পালিত হয় আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস। ১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টমাস ওস্টার ধারণাটির জন্ম দেন এবং সে বছর ফেব্রুয়ারিতে এটি পালিত হয়। এরপর ১৯৯৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইতিহাসের অধ্যাপক জেরোম তিলক সিংয়ের প্রস্তাবে আনুষ্ঠানিকভাবে এটির দিন ধার্য হয় ১৯ নভেম্বর।
আজকের দিনটি বিশেষভাবে পালন করতে পারেন। পুরুষ সঙ্গীকে পছন্দের জিনিস উপহার দিতে পারেন। লৈঙ্গিক, সামাজিক, আর্থিক পরিচয় আর অবস্থান নির্বিশেষে সমাজে প্রত্যেক নারী-পুরুষের অবস্থান সমান হোক- এটাই কাম্য।