ইউনাইটেডে শিশু আয়ানের মৃত্যু: তদন্ত হচ্ছে চার বিষয়ে

মেহেদী আল আমিন

জানুয়ারি ১৭, ২০২৪, ০৮:৩১ পিএম

ইউনাইটেডে শিশু আয়ানের মৃত্যু: তদন্ত হচ্ছে চার বিষয়ে

শিশু আয়ান।

খতনা করাতে রাজধানীর সাতারকূলে অবস্থিত ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালে এসে লাশ হয়ে বের হয় পাঁচ বছরের শিশু আয়ান। এ ঘটনার তদন্তে চারটি বিষয় নিশ্চিত হতে চায় পুলিশ।  

জানা গেছে, গত ৩১ ডিসেম্বর তাকে অজ্ঞান করার ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। তারপর আর জ্ঞান ফেরেনি। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই কর্তৃপক্ষ গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে স্থানান্তর করে লাইফ সাপোর্টে রাখে।

এক সপ্তাহ পর, ৭ জানুয়ারি লাইফ সাপোর্ট তুলে নিয়ে তাকে মৃত ঘোষণা করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

এ ঘটনায় গত ৯ জানুয়ারি রাজধানীর বাড্ডা থানায় আয়ানের বাবা শামীম আহমেদ বাদী হয়ে ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের দুই চিকিৎসক; অ্যানেস্থেসিয়া বিশেষজ্ঞ সাইদ সাব্বির আহমেদ ‍ও সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক তাসনুভা মাহজাবিন, অজ্ঞাতনামা কর্মকর্তা-কর্মচারী ও একজন পরিচালককে আসামি করে মামলা করেন।

এদিকে বাড্ডা থানা পুলিশ এ সংক্রান্ত ৪টি প্রশ্নের উত্তর পেতে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে চিঠি দিয়েছে যেখানে বলা হয়েছে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে দল গঠন করে তদন্ত করে পুলিশের কাছে মতামত প্রেরণ করতে।  

বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো ইয়াছিন গাজী দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, আমরা চারটি বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে বিশেষজ্ঞ মতামত চেয়েছি।

প্রথমত জানতে চাওয়া হয়েছে মৃত্যুর কারন কী, দ্বিতীয়ত ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছে কি না, তৃতীয়ত অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে কি না  এবং চতুর্থ বিষয়টি হচ্ছে চিকিৎসা প্রদানকারী ডাক্তাররা প্রকৃতপক্ষে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদানে অনুমোদিত কি না। আসলে তাদের সনদ রয়েছে কি না।

‘তাদের কাছ থেকে মতামত পেলে আমরা আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করবো। এটা সম্পূর্ণই বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের বিষয়। কী কারনে মারা গেছে, বা চিকিৎসায় ত্রুটি ছিলো কি না এগুলো তো আমরা বলতে পারবো না’ বলেন তিনি।  

আয়ানের বাবার করা মামলায় ভুল চিকিৎসা ও অবহেলায় মৃত্যুর অভিযোগ এনে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩০৪এ/১০৯ ধারায় মামলাটি করা হয়।

৩০৪এ ধারায় অপরাধে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দন্ডিত হওয়ার বিধান আছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্তে এ চারটির কোনোটি প্রমানিত হলে আইন অনুযায়ী আসামিদের জেল-জরিমানা হতে পারে যদি আদালত এমন আদেশ দেয়া উপযুক্ত মনে করেন।

এছাড়া দণ্ডবিধি ১০৯ ধারা অনুযায়ী অপরাধটি খুন বলে বিবেচিত হবে যদি উদ্দ্যেশ্যমূলকভাবে কিছু করা হয়। এক্ষেত্রে শাস্তিও হবে খুনের অপরাধে।

থানায় নিয়মিত মামলা হলেও বিষয়টি গড়ায় হাইকোর্ট পর্যন্ত। এক আইনজীবীর জনস্বার্থে দায়ের করা মামলায় ১৫ জানুয়ারি সোমবার হাইকোর্ট রুল জারি করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্টদের কাছে জানতে চেয়েছেন কেন আয়ানের পরিবারকে ৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরন দেয়ার নির্দেশ দেয়া হবে না।

তবে সন্তানের মৃত্যুতে যে ক্ষতি তা পূরণ হবার নয় বলে গণমাধ্যমকে জানান আয়ানের বাবা শামীম আহমেদ।

তিনি বলেন, ‘আমার একমাত্র ছেলে মারা গেছে। এই ক্ষতি কীভাবে পূরণ করবে তারা? আমার চাওয়া একটাই। এ ধরনের হাসপাতালগুলো বন্ধ হোক। আমার মতো আর যেন কেউ সন্তান না হারায়।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে ঘটনার তদন্ত করে ৭ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয় হাইকোর্টের ওই আদেশে।

একই সাথে মহাপরিচালককে বলা হয় দেশে অনুমোদনহীন কতগুলো হাসপাতাল রয়েছে, সেই তালিকা এক মাসের মধ্যে আদালতে দাখিল করতে।

৯ জানুয়ারির ঘটনার জানাজানি হলে একই দিনে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে হাসপাতালটি পরিদর্শন করে দেখতে পান এ হাসপাতালটির কোন ধরণের অনুমোদন বা নিবন্ধন নেই। অবৈধভাবেই এতোদিন চলছিলো হাসপাতালটি।

রোববার হাসপাতালটি বন্ধ করার নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। তবে মেডিকেল কলেজের কার্যক্রম চালু রয়েছে বলে জানা গেছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এটা খুবই দু:খজনক। এমন ঘটনা মোটেও মেনে নেওয়া যায় না। দোষীদেরকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া হবে। নিবন্ধন ও অনুমোদন ছাড়া কীভাবে হাসপাতালটি রোগীদের সেবা দিয়ে আসছিল, সেটাও খতিয়ে দেখা হবে।’

সুচিকিৎসার কথা ভেবে অপেক্ষকৃত ব্যয়বহুল হাসপাতালটিতে একমাত্র সন্তানকে নিয়ে আসেন বাবা শামীম আহমেদ।

ঘটনার কারন ও দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজতে বিভিন্ন তদন্ত কমিটি করা হলেও পিতা হারালেন তার একমাত্র সন্তানকে।

আয়ানের বাবা শামীম আহমেদ বলেছেন ‘নামি-দামি অনেকেই ইউনাইটেড মেডিকেলে স্বাস্থ্যসেবা নেয়। সেজন্য কিছু টাকা বেশি গেলেও ছেলেটার খতনা নিরাপদে হবে, এই বিশ্বাস থেকেই ওখানে গিয়েছিলাম। অথচ ছেলেটা আমার লাশ হয়ে ফিরলো।’

খতনা চলাকালে ৩০ থেকে ৪০ জন মেডিকেল শিক্ষার্থীকে ওটিতে ঢুকানোর কথাও জানান তিনি।

এদিকে এ ঘটনার পর আবার ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষই বিশাল অংকের, প্রায় ৬ লাখ টাকার বিল ধরিয়ে দেয় তার পরিবারকে।

ইউনাইটেড হাসপাতালের পাবলিক রিলেশন্স ম্যানেজার আরিফুল হক গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমরা শুরু থেকেই বাচ্চার পরিবারের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে আসছি। আর সে কারণেই বিল পরিশোধ না করার সত্ত্বেও বাচ্চার মরদেহ আমরা রিলিজ করে দিয়েছি।’

ঘটনাটা আসলে কী ঘটেছে, সেটাই আমরা বের করার চেষ্টা করছি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। তদন্তে কারও দোষ প্রমাণিত হলে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান আরিফুল হক।

এদিকে হাইকোর্টে জনস্বার্থে যে মামলাটি করা হয়েছে তাতে রাষ্ট্রপক্ষের কৌশুলি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায় বুধবার দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ‘আমাদের জানিয়েছেন, প্রমাণগুলো আদালতে এলে, প্রতিবেদন জমা হলে, সেগুলো পর্যালোচনা করে পরবর্তী আদেশ দেবেন আদালত।’

‘এখনো তো কিছু বলতে পারবো না। তদন্তে বেরিয়ে আসবে। হাইকোর্টের কোন আদেশ হলে আপনাদের জানাতে পারবো’, বলেন তিনি।

Link copied!