আবহমান বাংলার সংস্কৃতিকে বিশ্বমঞ্চে উপস্থাপনের লক্ষ্যে কিশোরগঞ্জের হাওরের মিঠামইনের অলওয়েদার সড়কে জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে যে আল্পনা আঁকা হয়েছে সেটা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। কতৃপক্ষ একে ‘বিশ্বের দীর্ঘতম আল্পনা অঙ্কন’ বলে দাবি করলেও হাওরের মতো সংবেদনশীল স্থানে এই ধরনের রঙের আল্পনায় ক্ষতির আশঙ্কা করছেন অনেকেই। তবে তবে তাদের এই ভাবনা পরিবেশ নিয়ে সতর্কতার ইঙ্গিত নাকি অন্যকিছু সেটা নিয়ে আরেকপক্ষের মধ্যে প্রশ্ন আছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, দেশে এত জায়গা থাকতে হাওরের বুকেই কেন ‘দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আল্পনা’ আঁকতে হলো? এর উদ্দেশ্য কি শুধু জনমনকে নববর্ষের রঙে রাঙিয়ে তোলা, নাকি আয়োজকদের ব্র্যান্ডিং?
আল্পনা নিয়ে সমালোচনার বিপরীতে যুক্তি দিয়ে আরেক দল আবার লিখেছেন, ‘হাওরের যে পরিমাণ ইঞ্জিন চালিত নৌকা-ট্রলার চলে তার ডিজেল-মবিল হাওরেই নিঃসৃত হয়। এছাড়া এক ধরনের চায়না জাল দিয়ে হাওরের দেশি মাছের প্রজাতি ধ্বংস করা হচ্ছে সেদিকে কারও নজর নেই। এছাড়া দুই মাস পরের ধর্মীয় উৎসবে কতগুণ বেশি রক্ত ও বর্জ্য ছড়িয়ে পড়বে সেটা নিয়ে ক’জন কথা বলে? কেন আমরা শুধু আল্পনা নিয়ে মেতে আছি? কারণ আমাদের সমস্যা পহেলা বৈশাখে।’
আরও পড়ুন: বৈশাখ-কথা: মঙ্গল শোভযাত্রা ও পান্তা-ইলিশের সমাহার
তবে কারও কারও পোস্টে পরিবেশ সচেতনতার চেয়ে ধর্মের গোঁড়ামির দিকটি লক্ষ্য করা গেছে। তাদের দাবি, ‘পহেলা বৈশাখের মুসলিমদের কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় উৎসব না। এই অনুষ্ঠানে আল্পনা এবং মূর্তির অবয়বে তৈরি পুতুল হিন্দুদের সংস্কৃতিকে লালন করে। মিঠামইন হাওরে ১৪ কিলোমিটার রাস্তায় আল্পনার রংয়ের ভারী কেমিক্যাল বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে গিয়ে পড়বে ধান ও মাছের অন্যতম উৎস বিস্তৃর্ণ হাওরে। এই ক্যামিকেলের কারণে প্রভাব পড়বে উৎপাদনে। যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে হাওরবাসী।’
ফলে বিশাল জায়গাজুড়ে এই আল্পনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে অনেকেই।
অলওয়েদার রোডে আল্পনার এই ছবির বিষয়ে এরই মধ্যে পরিবেশকর্মী ও বিশেষজ্ঞদের অনেকেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। পরিবেশ ও সামাজিক উন্নয়ন সংস্থার (ইএসডিও) সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, ‘এই রং মাছের পেটে যাবে, মানুষ আবার সেই মাছ খাবে। ফলে এভাবেই ফুড চেইনের (খাদ্য শৃঙ্খল) মাধ্যমে আবার মানুষের শরীরে এই রং প্রবেশ করবে যা অনেক ক্ষতির কারণ হবে বলে ধারণা করা যায়। এছাড়া এই আল্পনা করা জায়গায় যদি কেউ খালি পায়ে হাঁটে বা বসে, তবেও ত্বকের ক্ষতি করবে সেটা।’
তিনি আরও জানান, ‘এই আল্পনায় ব্যবহৃত রঙগুলোতে সাধারণত টক্সিক কেমিক্যাল ছাড়াও অ্যাক্রিলেট পলিমার, এক্সপিও পলিমারসহ নানা ধরনের ক্ষতিকর কেমিক্যাল থাকে। বিশাল হাওরে এই রঙ খুব সহজেই পানিতে ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকায় এই কেমিক্যাল (রাসায়নিক পদার্থ) যুক্ত পানি দিয়ে যদি কেউ হাতমুখ ধোয়া বা অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করে তবে ত্বকের লোমকূপের মাধ্যমে মাধ্যমে শরীরে ঢুকে বিভিন্ন রোগের বিস্তার ঘটাতে পারে। তাই এই রঙে ব্যবহৃত কেমিক্যাল শুধু বায়ু দূষণই নয়, পানিতে মিশে এটি পানি দূষণও করছে। এছাড়া এটি মাটির সঙ্গে মিশে একই সঙ্গে মাটি দূষণও করছে। যা নানাভাবে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে বিভিন্ন রোগব্যাধির বিস্তার করবে।’
দ্য রিপোর্ট.লাইভকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ডা. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, ‘এই রঙ বিভিন্ন ওয়েল বা ওয়াটার বেইস যেটাই হোক না কেন এর অর্গানিক দূষণ থাকবেই। ফলে হাওরের মানুষ বা যারা সেখানে ভ্রমণ করেছে তাদেরও এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নিশ্চিত। এই ধরনের দূষণ হৃদরোগ-লিভারের রোগের মতো জটিলতম রোগের সৃষ্টি করতে পারে। তবে সেখানকার লোকজন এটি এখন বুঝতে না পারলেও ধীরে ধীরে তারা বুঝতে পারবে। বিশেষ করে শিশু ও প্রবীণদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।’
পরিবেশ, জলবায়ু ও বায়ু মান নিয়ে গবেষণা করেন অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার। নিজের ফেসবুক আইডিতে তিনি লেখেন, ‘প্রকৃতপক্ষে হাওরের রাস্তায় এই রঙের খেলায় নববর্ষ উদযাপন প্রকৃতি হত্যার উৎসব ছাড়া আর কিছু নয়। পরিবেশ বিধ্বংসী এই ধরনের কাজ অনতিবিলম্বে বন্ধ করা উচিত।’
অন্যদিকে হাওরের এই আল্পনার সঙ্গে শুরু থেকেই যুক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলার সাবেক শিক্ষার্থী শিল্পী শেখ মনিরুজ্জামান লিটন বলেন, ‘আমরা কাজ করার সময় রঙ মুখে লাগে। কিন্তু কখনও কোনো ক্ষতি হয়নি। তাহলে অন্যদের ক্ষতি কীভাবে হবে? এই রঙ ওয়াটার বেইস কালার, ওয়েল বেইস না। যা শুকিয়ে গেলে উঠতে তিন-চার মাস সময় লাগবে।’
ঢাবির চারুকলার ওই শিক্ষার্থী আরও বলেন, ‘এই রঙে কেমিক্যালের পরিমাণ ১ শতাংশেরও কম ও মাটির পরিমাণ বেশি। মূলত এটি আমরা ঘরে যেই রঙ ব্যবহার করি সেটাই। আর এই রং যদি আমাদের ক্ষতি করে থাকে। তবে আমাদের ঘরে লাগানো রং আমাদের ক্ষতি করছে না কেন? সারা দেশের সব বিল্ডিংয়েই এই রং থাকার পরেও মানুষ কেন অসুস্থ হয়ে পড়ছে না? কেউ ভালো কিছু করলে বিতর্ক সৃষ্টির জন্য অনেকে অনেক ধরনের প্রশ্ন তোলে? এই কাজের পেছনেও ঠিক এমনটি হচ্ছে।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) চারুকলার শিক্ষক রাসেল রানা বলেন, ‘পরিবেশের কথা চিন্তা করেই আমরা শিল্প গড়ে তুলি। শিল্পের রং নিয়ে কাজ করে তবে রংয়ের মধ্যে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহৃত হবে সেই দায়িত্ব এই আল্পনার সঙ্গে যুক্ত কারও নয়। কারণ আমরা বেশির ভাগ সময় বাজারে যেসব কালার বাজারজাত হচ্ছে সেগুলো থেকেই কিনে থাকি। তবে সেগুলোতে যদি কেমিক্যাল থেকে থাকে তার দায়ভার কে নেবে?’
হাওরের এই আল্পনার সঙ্গে শুরু থেকেই সম্পৃক্ত শিল্পী শেখ মনিরুজ্জামান লিটন প্রশ্ন তুলেছেন, ‘আমরা কাজ করার সময় রঙ মুখে লাগে কিন্তু কখনও কোনো ক্ষতি হয় নি। তবে অন্যদের ক্ষতি কীভাবে হবে?’
দ্য রিপোর্ট.লাইভকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শিল্পী মনিরুজ্জামান লিটন বলেন, ‘এই রঙ ওয়াটার বেইস কালার, ওয়েল বেইস না। যা শুকিয়ে গেলে উঠতে তিন-চার মাস সময় লাগবে। এই রঙে কেমিক্যালের পরিমাণ এক শতাংশেরও কম ও মাটির পরিমাণ বেশি। আমরা ঘরে যে রঙ ব্যবহার করি, এটা সেটাই। আর এই রং যদি আমাদের ক্ষতি করে থাকে, তবে আমাদের ঘরে লাগানো রং আমাদের ক্ষতি করছে না কেন?’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশের সব বিল্ডিংয়েই এই রং থাকার পরেও মানুষ কেন অসুস্থ হয়ে পড়ছে না? কেউ ভালো কিছু করলে বিতর্ক সৃষ্টির জন্য অনেকেই অনেক ধরনের প্রশ্ন তোলে? এই কাজের পেছনেও ঠিক এমনটি হচ্ছে।’
হাওরে আল্পনা আঁকার সঙ্গে যুক্ত এই শিল্পী বলেন, ‘ঢাকার এত বাড়িঘর, এত রংয়ের ফলে কি পরিবেশ দূষিত হয়েছে? শুধুই একটা নেগেটিভ ইস্যু তৈরির জন্য মানুষ এমন আলোচনা সমালোচনা সৃষ্টি করছে। দেশের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে আমরা এমন একটা উদ্যোগ নিয়েছি। যার জন্য সবার গর্ব করা দরকার। কিন্তু আমরা সেটা না করে সমালোচনায় নেমে পড়েছি।’