নতুন ড্যাপ বাস্তবায়নের সক্ষমতা নেই রাজউকের

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

আগস্ট ৩১, ২০২২, ০৬:০২ এএম

নতুন ড্যাপ বাস্তবায়নের সক্ষমতা নেই রাজউকের

রাজউকের ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) অমান্য করে ঢাকায় হাজারো ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। সংস্থাটির অনুমোদিত নকশা-বিল্ডিং কোড না মেনে হাউজিং কোম্পানি ও বাড়ির মালিকেরা অবৈধভাবে ভবনের বর্ধিতাংশ নির্মাণ করেছে। তবে নতুন গেজেট প্রকাশ হলেও বাস্তবায়নে শঙ্কায় রয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদেরা।

গত ২৪ আগস্ট সংশোধিত ড্যাপের গেজেট প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৫৩-এর সেকশন ৭৩-এর ক্ষমতাবলে রাজউকের এখতিয়ারাধীন এলাকা ১৫২৮ বর্গকিলোমিটার। সর্বসাধারণের আপত্তি বা সুপারিশ বিবেচনায় সরকার মাস্টার প্ল্যানটি অনুমোদন দিয়েছে। এই মাস্টারপ্ল্যান ২০১৬ থেকে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকবে।

নগর-পরিকল্পনাবিদদের মতে, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও বিভিন্ন মহলের চাপে পুরনো ড্যাপ বাস্তবায়ন করতে পারেনি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক)। নতুন ড্যাপে বেশকিছু নিয়ম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়নে ঢাকায় শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। কিন্তু রাজনৈতিক, প্রশাসনিক চাপের পাশাপাশি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের যোগসাজস্য সামলানোর ক্ষমতা রাজউকের নেই। নতুন নতুন নিয়ম করলেই হবে না, বাস্তবায়নের সক্ষমতা থাকতে হবে রাজউকের।

রাজউকের সংশ্লিষ্টরা জানায়, দীর্ঘ দিন যাচাই-বাছাইয়ের পর নতুন ড্যাপ সরকারের অনুমোদন পেয়েছে। ঢাকার কোন এলাকায় কী ধরনের বিল্ডিং হতে পারে সেটিও সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত থেকে শুরু নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের সাশ্রয়ী আবাসনের ব্যবস্থার পরিকল্পনা করা হয়েছে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ড্যাপে নতুনত্ব আনা হয়েছে। নগরবাসীর চলাচলে গণপরিবহন, ঢাকার চারপাশে ওয়ার্কওয়ে, রেলপথ, নৌপথ, মেট্রো স্টেশনভিত্তিক ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট (টিওডি) ও সেবা বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়টি উঠে এসেছে ড্যাপে। ওয়ার্ডভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা এবং মানসম্পন্ন সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিনোদন কেন্দ্র নগর জীবনকে সহজ করবে।

ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর জেলার ১৫২৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে আধুনিক, কার্যকর, দৃষ্টিনন্দন ও বাসযোগ্য মহানগরী হিসেবে গড়ে তুলতে নতুন ড্যাপ করা হয়েছে। প্রকল্প এলাকাকে ৬টি স্বতন্ত্র প্রধান অঞ্চল এবং ৭৫টি উপ-অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। এতে জনসংখ্যার ঘনত্ব গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

নগর-পরিকল্পনাবিদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি আকতার মাহমুদ দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ঢাকা ও আশপাশে ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার ড্যাপের আওতাভুক্ত। যেখানে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর সিটি করপোরেশন ছাড়াও ৬৯টি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা নেই রাজউকের। সেজন্য রাজউকের আঞ্চলিক অফিস বাড়ানোর পাশাপাশি স্থানীয় সরকারের সহযোগিতা নিতে পারে।

আকতার মাহমুদ আরও বলেন, রাজউকের বোর্ডে সদস্যদের পরিবর্তন আনতে হবে। কারণ রাজউকের বোর্ডে জনপ্রতিনিধি ছাড়াও আমলা রয়েছেন। দেখা যায়- আমলারা কিছুদিন দায়িত্ব পালনের পর বদলি হয়ে যাচ্ছেন। যার ফলে রাজউকের পরিকল্পনার অভাব থেকেই যাচ্ছে। সেজন্য রাজউকের বোর্ডে জনপ্রতিনিধিদের পাশাপাশি পেশাজীবীদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এছাড়াও পরিকল্পনাবিদ, উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন সেক্টরে জনবল বাড়াতে হবে।

বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ভবন ভেঙে দেওয়া হয়েছে। পাড় দখলমুক্ত করতে সরকারের শীর্ষপর্যায়ের নির্দেশনা ছিল। সর্বোপরি রাজউকের ড্যাপ বাস্তবায়নেও সরকারের শীর্ষপর্যায়ের সদিচ্ছা থাকতে হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া ড্যাপ কখনই বাস্তবায়ন হবে না বলে মনে করেন এই পরিকল্পনাবিদ।

ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, সংশোধিত ড্যাপ-এ নতুনত্ব বেশকিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আধুনিক নগর পরিকল্পনার কৌশল এটি। জনঘনত্ব, ভূমি পুনর্বিন্যাস থেকে শুরু করে ভূমি পুনঃউন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ড্যাপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু ড্যাপ বাস্তবায়নে রাজউকের জনবল সংকট রয়েছে। ঢাকার ১৫২৮ বর্গ কিলোমিটার পরিকল্পনার জন্য রাজউকে ১০-১২ জন নগরপরিকল্পনাবিদ রয়েছে, যা নগন্য। নগরপরিকল্পনাবিদ বাড়াতে হবে।

তিনি আরও বলেন, বহু রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের লোকজন রাজউকের নিয়ম-নীতি তোয়াক্কা না করে ভবন নির্মাণ করছেন। সেখানে নতুন ড্যাপ সফলতা কিংবা ব্যর্থতা নির্ভর করছে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রাষ্ট্র ও সরকারের সংশ্লিষ্ট সকলের সক্ষমতার ওপর। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আন্তরিক সদিচ্ছা, যথাযথ প্রয়োগ, প্রয়োজনীয় অর্থায়ন, উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ, আইনের শাসন ও জনস্বার্থে রাজউকে কঠোর হতে হবে। কিন্তু রাজউকের সেই সক্ষমতা নেই বললেই চলে।

রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, নতুন ড্যাপে মাঠ পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি, সাধারণ মানুষের মতামত নেওয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে পুরনো ঢাকাসহ ঢাকার আশেপাশের এলাকায় বেশ পরিবর্তন আসবে। নতুন ড্যাপ সরকারের অনুমোদন পাওয়ায় অনেক হাউজিং কোম্পানি নাখোশ হয়েছে। যেকোনো নিয়মে সব মানুষকে সমানভাবে খুশি করা যায় না। ড্যাপের গেজেট আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে যাবে।

প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ড্যাপ ও ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসারে ভবন তৈরি করেছিল হাউজিং কোম্পানি ও বাড়ির মালিকরা। তবে সংশোধিত নতুন ড্যাপের গেজেট প্রকাশ পাওয়ায় পুরনো ড্যাপের সব কার্যক্রম বাতিল হয়েছে।

Link copied!