শাহজালালে লাগামহীন লাগেজ লাপাত্তার ঘটনা: দিশেহারা যাত্রীরা

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জুন ২০, ২০২২, ০২:০১ এএম

শাহজালালে লাগামহীন লাগেজ লাপাত্তার ঘটনা: দিশেহারা যাত্রীরা

দীর্ঘ সাত বছর পর মো. আলী আজম দুবাই থেকে গত ১৬ জুন সন্ধ্যায় দেশে ফিরে এখন পড়েছেন বিপাকে। সকল নিয়ম কানুন মেনে লাগেজে ৮১ গ্রাম স্বর্ণ এনে শাহজালাল (রা.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সেদিন বাসায় ফিরেছিলেন তিনি। বাসায় এসে দেখেন তাঁর হ্যান্ড লাগেজ থেকে সেই সোনা গায়েব! সাথে সাথে তিনি বিমানবন্দরে ফিরে আসেন। সারা রাত সংশ্লিষ্ট সবার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু এখনও সেই সোনার হদিস পাননি তিনি।

আলী আজম ১৬ জুন সন্ধ্যা ছয়টায় শাহজালালে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের সাথে আলাপকালে আলী আজম বলেন, দুবাই এয়ারপোর্ট  থেকে বাংলাদেশে নেমে তিনি সোনা আছে কিনা ব্যাগে চেকও করেছেন এবং ব্যাগ হালকা করার জন্য কিছু জিনিসপত্র ফেলেও দেন। কিন্তু বাংলাদেশ কাস্টমস চেকিংয়ের পর ব্যাগের চেন খোলা দেখে কিছুটা সন্দেহও হয় তাঁর। কিন্তু এত বছর পর দেশে ফেরার আনন্দ আবেগে তখন আর ব্যাগ ভাল করে চেক করার কথা মনে আসেনি তাঁর। কিন্তু বাসায় ফিরে আর আনন্দ তাঁর থাকেনি।

প্রতিদিনই এমন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। শুধুমাত্র প্রবাসী নয় বরং অনেক বিদেশী পর্যটকও এমন পরিস্থিতির স্বীকার হচ্ছেন। লাগেজ হারানো থেকে শুরু করে লাগেজের মালামাল হারানো, লাগেজ পাল্টে যাওয়া যেন বিমানবন্দরের নিত্য ঘটনা এখন।

মামলা নিয়ে বিভ্রান্তি

আলী আজম দ্য রিপোর্ট ডটলাইভকে আরও বলেন, প্রায় দশ ভরি স্বর্ণের উপরে কিনেছিলাম শ্যালিকার বিয়ের জন্য। কিন্তু সেগুলো এখন পাচ্ছি না।। সন্ধ্যা ৬ টার ফ্লাইটে বিমানবন্দরে নেমে বাসায় গিয়ে স্বর্ণ না পেয়ে সাথে সাথে আবার চলে আসি বিমানবন্দরে। সব খুলে বলি কাস্টমসে। দুইদিন পার হয়ে গেলেও কেউ সাহায্য করছে না। উল্টো হয়রানির শিকার হচ্ছি। কাস্টমস থেকে বলছে মামলা করতে। এদিকে মামলার জন্যে থানায় গেলেও তারাও খারাপ ব্যবহার করছে। মামলা নিচ্ছে না তারা।

এ বিষয়ে এয়ারপোর্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি তদন্ত) আসলাম উদ্দিন মোল্লা বলেন, আমাদের কাজই মানুষের সাহায্য করা। কেউ মামলা কিংবা জিডি করতে আসলে আমরা নেবো না কেনো? অবশ্যই কোথাও ভুল বুঝাবুঝি হচ্ছে।

শাহজালাল বিমানবন্দরের কাস্টমসে মালামাল হারানোর ঘটনায় কয়টা জিডি কিংবা মামলা হয় মাসে এমন প্রশ্নের জবাবও তিনি সুস্পষ্টভাবে দিতে পারেননি। তবে তিনি বলেন, সেটার সঠিক পরিসংখ্যান আমার কাছে নেই। তবে প্রায়ই আসে লাগেজ কিংবা মালামাল চুরির ঘটনার কেস। আর কেউ আসলে আমরা যথাযথভাবে সাহায্যের চেষ্টা করি।

এই দুবাই প্রবাসীর স্ত্রী জানান, একবার কাস্টমস, একবার থানা— করতে করতে দুইদিন হয়ে গেল। কিন্তু কেউ কোনো সাহায্য করছে না। আমরা কি আমাদের জিনিস আর ফেরত পাবো না?

গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট ফরিদার পাড়ার বাসিন্দা আবুল কালাম। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তার দুটি লাগেজ খোয়া যায়। লাগেজের খোঁজে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে যান তিনি।

গত ১৫ জুন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দুটি লাগেজ হারানোর বর্ননা দিয়ে কাতার প্রবাসী আবদুল মান্নান বলেন, ‘কাতার থেকে ফিরে বিমানবন্দরে নেমে কনভেয়র বেল্টে এক ঘণ্টা খোঁজাখুঁজি করেও দুটি লাগেজের হদিস পাইনি আমি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা লস্ট ব্যাগেজ সেকশনে লিখিত অভিযোগ দিতে বলেন। আমি অভিযোগ দিয়ে বাড়িতে চলে এলাম। পরদিন ‘লস্ট এন্ড ফাউন্ড’বিভাগে ফোন করলাম। কিন্তু সদুত্তর নেই। ওপাশ থেকে বলা হয়, “লাগেজ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।” এভাবে ১৪ দিন পার হয়ে যায়। লাগেজ আর পাইনি।

ভুক্তভোগী দুবাই প্রবাসী সোনালি বেগম বলেন, ‘গত ১৭ জুন রাতে দুবাই থেকে এই বিমানবন্দরে অবতরণ করি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে আমার একটি লাগেজ পাইনি। সেদিন হতাশ হয়ে বাড়ি চলে আসি। তিনদিন পরে ‘লস্ট এন্ড ফাউন্ড’বিভাগে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি, ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে ছোট বড় মাঝারি সাইজের শতাধিক লাগেজ। বিমানের এক কর্মকর্তা সেখান থেকে আমার লাগেজটি খুঁজে নিতে বললেন। প্রায় এক ঘণ্টা তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম, কিন্তু লাগেজ পেলাম না। এ সময় বিমানের স্টেশন ম্যানেজার আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। কিন্তু তিনিও আমার লাগেজের খোঁজ দিতে পারেননি।’

শুধু চঞ্চলা, এবাদুর, রাকিব বা করিম নন, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রীদের লাগেজ লাপাত্তার ঘটনা এবং কাটা ছেড়া লাগেজ পাওয়া কিম্বা লাগেজ থেকে জিনিসপত্র খোয়া যাওয়ার অভিযোগ বিমানবন্দরে এখন নিত্যদিনের ঘটনা।

প্রতিদিন হারাচ্ছে লাগেজ

অনুসন্ধানে জানা গেছে, হজরত শাহজালাল (রা.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লাগেজ হয়রানি চরমে পৌঁছেছে এখন। এ থেকে বাদ যাচ্ছেন না সাধারণ যাত্রী থেকে ভিআইপিরাও।

গত ২৩ মে নেপাল থেকে শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ধর্ম বিষয়ক উপ-কমিটি সদস্য তৌহিদ হোসেন। এরপর বিমানবন্দর থেকে বাসায় গিয়ে দেখেন তাঁর লাগেজে থাকা লাখ টাকা গায়েব। এ বিষয়ে বাংলাদেশ বিমানসহ বিমানবন্দরের বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ দিয়েও কোন নিজের লাপাত্তা হওয়া টাকা পাননি এই আওয়ামী লীগ নেতা।

এ বিষয়ে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস’এর ‘লস্ট এন্ড ফাউন্ড’ বিভাগের কর্মকর্তা সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রতিদিন যাত্রীদের ১০০ থেকে ১৫০ লাগেজ খোয়ার ঘটনা ঘটছে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লাগেজ প্রতিনিয়ত মিসহ্যান্ডেল হচ্ছে। কারণ এই বিমানবন্দরে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ উড়োজাহাজ ল্যান্ড করে। যাত্রীও হাজার হাজার। কে কোন দিকে কারা কী করছে, তা বোঝা মুশকিল।’

Link copied!