দেশের গণমাধ্যমের জন্য অশনি সঙ্কেত

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

মে ৮, ২০২২, ১২:৩৬ এএম

দেশের গণমাধ্যমের জন্য অশনি সঙ্কেত

বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে আবারও আলোচনা উঠল। ঈদুল ফিতরের আনন্দের দিনই গণমাধ্যমের একটি দুঃসংবাদে এ প্রসঙ্গটি আবারও টক অব দ্য কান্ট্রি হল। দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের একটি খবর থেকে জানা যাচ্ছে যে, বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে এ বছর আরও ১০ ধাপ পিছিয়ে গেছে বাংলাদেশ।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা তথা এ দেশে গণমাধ্যমের বর্তমান গতিপ্রকৃতি নিয়ে আজ কথা বলব দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের সম্পাদক লুৎফর রহমান হিমেলের সাথে। স্বাগত জানাচ্ছি জনাব লুৎফর রহমান হিমেল...। বলা হয়ে থাকে, গণমাধ্যম একটি দেশের চতুর্থ স্তম্ভ। আমরা আপনাকে চারটি প্রশ্নই করবো গণমাধ্যম ও এর স্বাধীনতা প্রসঙ্গে।

আপনার কাছে প্রথম প্রশ্ন: সারাবিশ্ব জুরেই ফ্রিডম অব প্রেস বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলা হয়। এই স্বাধীনতাটা আসলে কেমন বা কি? বা এই স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হলে পরে কী কী সঙ্কট হয় রাষ্ট্রের বা সমাজের?

https://www.facebook.com/thereportdotlive/videos/983506369034567

লুৎফর রহমান হিমেল:

সাংবাদিকতার স্বাধীনতা বা ফ্রিডম অব প্রেস নিয়ে বিস্তর আলোচনা আমরা নানা সময়ে শুনি। নাগরিকের মতপ্রকাশ আর গণমাধ্যমের মত প্রকাশের স্বাধীনতা একই সূত্রে গাঁথা। যার অর্থ হচ্ছে, একটি দেশে নাগরিকের মতপ্রকাশের অধিকার যদি সংকুচিত হয়, তবে সেখানে গণমাধ্যম আলাদা করে স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে না।

সারা পৃথিবীতে মতপ্রকাশের অধিকার এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার ওপর নজর রাখা সব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের হিসাবে দেখা যাচ্ছে যে কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে সেই অধিকার সংকুচিত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা ফ্রান্সভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস এর করা এ বছরের ‘বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে’ বাংলাদেশ ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬২তম অবস্থানে রয়েছে। যা গত বছরের চেয়েও দশ ধাপ পেছনে চলে গেল!

গত বছর যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫২তম। এছাড়া ২০২০ সালে এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫১তম। আর ২০১৯ সালে ছিল ১৫০ তম। অর্থাৎ, ক্রমান্বয়ে দেশের গণমাধ্যম সূচক নিচের দিকে যাচ্ছে! এটি দেশের গণমাধ্যমের জন্য অশনি সঙ্কেত।

এ দেশে সরকার বদল হয়। নতুন সরকার আসে। কিন্তু গণমাধ্যমের টুটি চেপে ধরার পুরনো চর্চা থেকে কোনো সরকারই সরে আসে না। তবে সরকার দাবি করে, দেশের গণমাধ্যম স্বাধীন। কিন্তু গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমের ভোক্তা সাধারন জনগণ বারংবার অভিযোগ করেন, মত প্রকাশে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় কখনো কখনো স্বাধীনতার সীমা নিয়েও কথা হয় সরকারি তরফে। বলা হয়, গণমাধ্যম চাইলেই কি সব কিছু প্রকাশ করতে পারে? বা উচিৎ? এটা বা সেটা প্রকাশ করা যাবে না। অমুকটা বা তমুকটা প্রকাশ করা যাবে। ইত্যাদি।

আরও পড়তে পারেন:

মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১০ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ

আমরা সব সময়ই সব সরকারের আমলেই দেখেছি, গণমাধ্যমের স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে নানা বাধা আসছে। ফলে গণমাধ্যম তাদের কাঙ্খিত পারফর্ম করতে পারছে না। করোনার মধ্যেও বাংলাদেশে ৩ জন সাংবাদিক অপহৃত ও এক জন নির্যাতনের শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন। এছাড়া মোট ২৫৬ জন সাংবাদিক প্রভাবশালী পক্ষের আক্রমণের শিকার হয়েছেন। তিনটি অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করা হয়েছে বা তাদের তথ্য বা সংবাদ কোনো না কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। বিভিন্ন সংস্থা থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হচ্ছে, দেশে সাংবাদিক ও সামাজিক মাধ্যম কর্মীদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় মামলার ঊর্ধ্বগতি আশঙ্কাজনক।

দ্বিতীয় প্রশ্ন: গণমাধ্যমের এ সংকটের দায় কার বা কাদের? অর্থাৎ সব আমলেই তো গণমাধ্যমের ওপর বাধা এসেছে। তারপরও তো অতীতে গণামাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ পারফর্ম করেছে। যেমন: সরকারি সম্মাননার ক্রেস্টে সোনা কেলেঙ্কারি, রূপপুর আণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুর্নীতি, প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের স্খলণ, দেশের অর্থপাচার, কোভিডকালে স্বাস্থ্যখাতের অর্থ তছরুপ, সর্বশেষ তেঁতুলতলার মাঠের মতো নানা ইস্যুতে কিন্তু খবর প্রকাশিত হয়েছে...

লুৎফর রহমান হিমেল:

হ্যাঁ, কিছু কিছু সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে বটে। এসব সংবাদ হিমশৈলের চূড়া মাত্র। আরও শতসহস্র সংবাদ রয়ে যাচ্ছে অন্তরালেই। এসব প্রকাশ পাচ্ছে না নানাবিধ চাপের কারণে।

গণমাধ্যমগুলোর মালিক হচ্ছেন করপোরেট হাউস, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদেরা। এ কারণে সাংবাদিকেরা কথা বলা এবং লেখার স্বাধীনতা ভোগ করছেন না। সরকারের কোনো লিখিত ‘সেন্সরশিপ না থাকলেও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো তাঁদের নিয়ন্ত্রণেই। যেহেতু সাংবাদিকদের চাকরি হারানোর ঝুঁকি থাকে, তাই কেউ এই রিস্ক নিতে চায়ও না।

স্বাধীন সাংবাদিকতার বিপরীতে সরকারি চাপ, করপোরেট চাপ, বিজ্ঞাপন দাতাদের চাপ যেমন রয়েছে, তেমনি সাংবাদিক বা সম্পাদকদের সেল্ফ সেন্সরশীপের কারণেও সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সর্বকালেই এই চাপগুলো মিডিয়ার ওপর ছিল এবং থাকবে। আমাদের দেখতে হবে, এই চাপ কাটিয়ে উঠবার কতোটা চেষ্টা মিডিয়া কিংবা সম্পাদক-সাংবাদিক করেছেন। এটিই সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমার মতে। মিডিয়ার জন্য কেউ পুস্পবিছানো পথ করে দেবে না, কোনো কালে দেয়ওনি। তাদেরকে নিজেরাই সেই মসৃণ পথটি সৃষ্টি করে নিতে হবে।

এসব বিবেচনায় আমি বলব, সাংবাদিক ও মিডিয়ারও ব্যর্থতা আছে। এ দেশের বেশিরভাগ মিডিয়া কর্মীই রাজনৈতিক দলীয় কর্মীর ভূমিকায় নামেন। অনেকে সরাসরি রাজনীতিও করেন। ফলে পছন্দের নিজ দলের অপরাধগুলো তারা ‍কভার করেন না। করলেও ভাসাভাসা করে নিউজ করেন। এ ছাড়া অনেক কর্মীর যোগ্যতাও নেই। এই অযোগ্যতা হতে পারে তার দক্ষতার, হয়তো বা তার নৈতিকতার।

আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণে এমনও দেখেছি, অনেকের এ দুটো যোগ্যতার কোনোটিই নেই, কিন্তু তিনি বড় পত্রিকার সম্পাদক। সাংবাদিকতায় সাংবাদিককে দুটি গুন অবশ্যই থাকতে হবে: একটি দক্ষতা, অন্যটি নৈতিকতা। দক্ষতায় কিছুটা খাদ থাকলেও নৈতিকতায় একশতে একশ পেতে হবে সাংবাদিককে। নাহলে তিনি স্বাধীন সাংবাদিকতার সুফল সমাজ, দেশ বা রাষ্ট্রকে দিতে পারবেন না।

মনে রাখতে হবে, সুসাংবাদিকতা সরকার পরিচালনার অন্তরায় নয়। বরং সহায়ক। দেশের উন্নয়নে এই সাংবাদিকতার বিকল্প নেই।

তৃতীয় প্রশ্ন: সংবাদ মাধ্যম বা সাংবাদিকদের বিষয়ে কোনো আইন কি সত্যিই জরুরি? আমাদের দেশে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট যেমনটা করা হয়েছে...

লুৎফর রহমান হিমেল:

যে কোন আইন মানুষের স্বাভাবিক চলাফেরায় বা জীবন যাপনকে বাধাগ্রস্ত করে। নাগরিকের চলাফেরা, নাগরিকের কথা বলা, নাগরিকের যাপিত স্বাভাবিক জীবনকে বিঘ্ন করে। মানুষ মাত্রেই জন্মগতভাবে স্বাধীন। স্বতস্ফূর্ত। একটি মিডিয়া, মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি, গণমাধ্যম, তার জন্মটাই হচ্ছে স্বাধীনভাবে। এখন মিডিয়া, মিডিয়ার জন্য মিডিয়া নিজেই এক আইন। মিডিয়া সমাজকে শেখায়। সেই মিডিয়া যা দেখবে, তাই সে প্রচার করবে, প্রকাশ করবে। এখন সে কী প্রকাশ বা প্রচার করবে সেটি যদি কোনো দেশের রাষ্ট্র বা সরকার বেঁধে দেয়, বা দেওয়ার চেষ্টা করে; তাহলে সেটি হবে সত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা।

তবে এক্ষেত্রে মিডিয়ার নিজেদের কিছু নৈতিকতার মানদণ্ড থাকে। সেই মানদণ্ডের নিরিখেই মিডিয়া নিজের বিবেচনা কাজে লাগিয়ে দায়িত্ব পালন করে। কোন জিনিসটা সমাজের জন্য উপকার হবে, কোন বিষয়টা উপকারী হবে না, বা মানবজাতির জন্য উপকার হবে কিনা, সেটা কিন্তু একজন সাংবাদিকের যে রকম মাথায় থাকে, মিডিয়া হাউজেরও মাথায় থাকে। তাদের একটা এজেন্ডা সেটিংও করা থাকে যে তারা ওরকম সংবাদ করবে কিনা, বা করবে। এ ক্ষেত্রে আমি ব্যক্তিগতভাবে কোন আইনের পক্ষে না থাকার পক্ষে। সাংবাদিকতা চলবে তার মতো। বিবেক দিয়ে সে পরিচালিত হবে। এর চেয়ে বড় আর কোনো আইন হতে পারে না।

সাংবাদিকতা হল অবাধ তথ্য প্রবাহ। একটা নদী যে রকম চলতে থাকে, হিমালয় থেকে যাত্রা শুরু হয়ে নেপাল-ভারত হয়ে বাংলাদেশের উপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে। এখানে কেউ কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। সে স্বাধীনভাবে চলে। ঠিক সাংবাদিকতাও সেরকম। সে মানব কল্যাণে, সমাজের কল্যাণে, বিশ্ববাসীর কল্যাণে কাজ করবে। বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরবে। যা ঘটছে তা-ই সে তুলে ধরবে। এখানে তাকে কেউ খবরদারি করতে আসবে না।

তবে আইন যদি হতেই হয়, সেটি হতে হবে সাংবাদিকদের কল্যাণের জন্য, মিডিয়ার সুরক্ষার জন্য। যাতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা আরও নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে আইন হয় গণমাধ্যমকে চেপে রাখার জন্য, সাংবাদিকদের ওপর খবরদারি করার জন্য। আপনার সমালোচক আপনার বন্ধু- এ কথাটি সরকার ভুলে যায়। সরকার যদি মনে করে, দলীয় একপাল নেতাকর্মীর প্রশংসায় তার চলবে, সেটি মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। দেশ ও রাষ্ট্রের প্রকৃত চিত্র দেখতে হলে স্বাধীন গণমাধ্যমের পরিষ্কার আয়নাতেই তাকে দেখতে হবে।

চতুর্থ প্রশ্ন: দেশের গণমাধ্যমের এই ক্রমাবনতি কী মিন করে মানে কিসের ইঙ্গিত দেয়। এতে কী কী ক্ষতি হতে পারে বলে মনে করেন?

লুৎফর রহমান হিমেল:

দেশের গণমাধ্যমের এই ক্রমাবনতি অনেক কিছুরই ইঙ্গিত দেয়। নানা মহলের চাপ যেমন আছে, তেমনি সাংবাদিকদের দক্ষতা ও যোগ্যতার অভাবও স্পষ্ট। যেমনটা আমি একটু আগে বলেছি। এসব কারণে আমাদের পাঠকদের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতার একটি বড় সংকট এরইমধ্যে তৈরি হয়েছে। এটি হচ্ছে প্রথম ক্ষতি। খেয়াল করলে দেখবেন, মিডিয়ার প্রতি পাঠক-শ্রোতাদের বড় রকমের এক অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। অথচ একসময় পাঠক পত্রিকায় ছাপা যে কোনো তথ্যকে বাইবেলের মতো বিশ্বাস করতো। এই বিশ্বাস হারানোটা বড় ক্ষতির মুখে ফেলেছে আমাদের। এই ক্ষতি শুধু গণমাধ্যমেরই নয়, সরকার বা রাষ্ট্রের জন্যও বড় ক্ষতির। কারণ, একটি আদর্শ গণমাধ্যম জাতির জন্য বড় এক আশির্বাদ।

আমরা বিভিন্ন সরকারের আমলেই খেয়াল করে দেখেছি, কোনো সরকারই মিডিয়াকে বন্ধু হিসেবে দেখে না। উন্নয়ন সহযোগি হিসেবে দেখে না। আমি এই অপচর্চাকে ব্যাখ্যা করার জন্য অনেককেই এভাবে বলি: হয়তো আমাদের সরকাররা সবাই মালয়েশিয়ার মহাথির মোহাম্মদ বা সিঙ্গাপুরের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান হতে চান! এ দুজনই তাঁদের দুর্দান্ত নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে উন্নয়নের এক বিরাট উচ্চতায় তুলে দিয়েছেন। এ দুজনেরই একটি কমন কৌশল ছিল, মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা। হয়তো সেই ফর্মুলাতেই আমাদের সরকারগণও দেশকে শাসন করতে চান, মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান। কিন্তু একটি বিষয় তারা হয়ত খেয়াল করে দেখেন না যে, মাহাথির বা লি কুয়ান, তারা দুজনই দুর্নীতিবাজদের সামান্য ছাড়ও দেননি। ফলে আমাদের সরকার প্রধানরা মিডিয়া নিয়ন্ত্রণটাই শিখেছেন, সেটির চর্চাই সব সময় জারি রাখেন। দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক, আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর পদস্থ কর্তা, অসৎ ব্যবসায়ী ধনকুবের, সরকারি আমলা এদের বিরুদ্ধে সরব হন না। এ কারণে সঠিক উন্নয়নটা এ দেশে হয় না। যেমনটা হয় না সাংবাদিকতার মানেরও উন্নয়ন।

Link copied!