এক.
সাংবাদিকতার আবার রঙ কিসের? প্রশ্ন আসতে পারে। হ্যাঁ, সাংবাদিকতার রঙ নেই। সাংবাদিকতা হলো স্বচ্ছ জীবাণুমুক্ত পানির মত। একেবারে ক্রিস্টাল ক্লিয়ার রঙ হতে হয় সাংবাদিকতার। কিন্তু সাংবাদিকতা কি এ রঙহীনতা ধরে রাখতে পেরেছে কোনোকালে? পারেনি। আর তাই যোগ হয়েছে রঙিন সাংবাদিকতার। সেটা হলুদ দিয়েই বোধ করি শুরু হয়েছে।
হলুদ সাংবাদিকতার জন্ম হয়েছিল সাংবাদিকতা জগতের অন্যতম দুই ব্যক্তিত্ব যুক্তরাষ্ট্রের জোসেফ পুলিৎজার আর উইলিয়াম রুডলফ হার্স্টের মধ্যে পেশাগত প্রতিযোগিতার ফল হিসেবে। এই দুই সম্পাদক তাঁদের নিজ নিজ পত্রিকার ব্যবসায়িক স্বার্থে একে অপরের দিকে যেভাবে কাদা ছোড়াছুড়ি করেছিলেন, বিশ্বমিডিয়া আজও তা দুঃস্বপ্নের মতো মনে রেখেছে। পুলিৎজারের নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ড ও হার্স্টের নিউ ইয়র্ক জার্নালের মধ্যে পরস্পর প্রতিযোগিতা এমন এক অরুচিকর পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতার পরিবর্তে পত্রিকার বাহ্যিক চাকচিক্য আর পাঠকদের উত্তেজনাদানই তাদের কাছে এক সময় মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
কিন্তু সময় বদলেছে। সাংবাদিকতার রঙ হলুদ থেকে লালের মধ্য দিয়ে ভয়াবহ রঙ কালোর দিকে যাত্রা করেছে। সংবাদে জনস্বার্থ, দেশস্বার্থ, পরিবেশ স্বার্থ বলে কিছু থাকছে না। রগরগে ''নেতিবাচক'' সংবাদে ভরে উঠছে পত্রিকার কলামের পর কলাম। দু-একটি পত্রিকা শনিবার বা শুক্রবার কিছু ইতিবাচক সংবাদ ছাপছে। সেটাও তাদের প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে, ট্রাস্ট-ব্যবসার প্রসারে দেশি-বিদেশী সাহায্যপ্রাপ্তির জন্য। অন্যদিকে ভুয়া সাক্ষাৎকার, ভুল ধারণার জন্ম দিতে পারে এমন শিরোনাম, ভুয়া বিজ্ঞানমূলক আবিস্কারের খবর, আর তথাকথিত বিশেষজ্ঞ কর্তৃক ভুল শিক্ষামূলক রচনার ব্যবহার ভয়াবহ রকমের বেড়েছে। আজ গবেষকদের বরাতে বলা হচ্ছে ''গাজা ক্ষতিকর'', কাল বলা হচ্ছে ''গাজা মানুষের মেধা বাড়ায়''। আজ এক পত্রিকা লিখছে, ''রাত জাগলে বুদ্ধি বাড়ে'' তো কাল অন্য পত্রিকা লিখছে, ''রাত জাগলে জটিল রোগ হয়।'' পাঠক কোন দিকে যাবেন? হলুদ, লাল বা কালো সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ হিসেবে তাই আরো একটি রঙের সাংবাদিকতার প্রয়োজন পড়েছে এখন। রঙ কে রঙ দিয়েই মোকাবিলা করতে হবে। এই রঙ হবে সবুজ। যাকে পশ্চিমা বিশ্ব ডাকতে শুরু করেছে গ্রিন জার্নালিজম নামে।
পরিবেশ ও প্রতিবেশকে তারা অতিব গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। অথচ সবচেয়ে ভালনারেবল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মিডিয়ার এ দায়িত্ব সর্বাগ্রে নেওয়া দরকার ছিল।কারণ, এ দেশ ঝুকিপূর্ণ। দেশ ভালো নেই, ভালো নেই পৃথিবীও। ভালো নেই মানুষ। বাসযোগ্য পৃথিবী আজো মানুষ গড়ে তুলতে পারেনি। মানুষ হিসেবে বড় ব্যর্থতা আমাদের রয়েই গেল। মানব-সৃষ্ট কারণেই প্রকৃতি আজ বিরূপ হয়ে উঠছে। আমরা টের পাচ্ছি। বিশ্বের উষ্ণতা যে হারে বাড়ছে তাতে আগামী দিনে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতি বছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি যেভাবে বাড়ছে তাতে প্রতি সাতজনে একজন উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। এরা হচ্ছে জলবায়ু উদ্বাস্তু। আগামীতে বাংলাদেশের ১৭ ভাগ এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। কিন্তু এসব নিয়ে মিডিয়ায় লেখা কই? সামাজিক সচেতনতার ব্যাপারে দায়িত্ব পালন না করলে, ''সেসব মিডিয়া লইয়া আমরা কী করিব?''
আমি নিজেও সামাজিক সাংবাদিকতা নামে একটি ধারণা সাংবাদিক-পাঠক সবার মাঝে ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করছি দীর্ঘদিন ধরে। গ্রিন জার্নালিজমও সেই সামাজিক সাংবাদিকতারই একটি রূপ। দিন-কাল-সময় বদলেছে, সাংবাদিকতাও তার স্বরূপ না বদলালে এর থেকে কল্যাণ আসবে না। আর তাই পরিবেশ-প্রতিবেশ সাংবাদিকতা তথা সবুজ সাংবাদিকতার জন্য একটু বেশি করে স্পেস ছেড়ে দিতে হবে। মিডিয়াম্যানদের বুঝতে হবে, নিজে বাঁচলে পেশা বাঁচবে, পরিবার বাঁচবে, সমাজ ও দেশ বাঁচবে। সর্বোপরি সাংবাদিকতা থেকে কল্যাণ বের করে আনতে হবে। এই কল্যাণকর সাংবাদিকতাই গ্রিন জার্নালিজম।
দুই.
একটা গোলাপ ফুলকে হয়তো সকলেই পছন্দ করে, কিন্তু খুব কম মানুষই সেই গোলাপ গাছটির সবুজ পাতাগুলোকে আলাদাভাবে পছন্দ করেন। অথচ সেই সবুজ পাতাগুলোর জন্যই গোলাপ ফুলটিকে এতটা সুন্দর দেখায়। কল্পনা করুন একটি গোলাপ গাছ, যেটাতে একটিও পাতা নেই, কন্টকের মাঝে শুধু কিছু গোলাপ ফুল। এটিকে কি আগের মতোই সুন্দর লাগবে? কখনোই না। এ পৃথিবী সুন্দর এই সবুজের কারণেই।
এক সময় বৃক্ষ সুশোভিত অঞ্চলগুলো আমাদের চাহিদা পূরণ করে জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আনত। দুঃখজনক হলেও সত্যি, আজ আর সেই দিন নেই। বাংলাদেশের আম, কাঁঠাল, সুপারি, নারকেল বাগানের সারি হারিয়ে যাচ্ছে।
ইট, কাঠের আমাদের এই শহরের বৃক্ষের জন্য কোন স্থান নেই। সবাই শুধু অট্টালিকা বানাতে ব্যস্ত। তথাকথিত এই উন্নয়ন আমাদের জীবন ধারানের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান অক্সিজেনের যোগানদাতা গাছের স্থান নেই।
অন্যদিকে, সরকারের ৮০ ভাগ বনায়ন হচ্ছে ভুলনীতিতে। বনায়নের নামে লাগানো হচ্ছে দেশে অনুপ্রবেশকারী হাইব্রিড বিদেশী গাছ। এর মাধ্যমে জীববৈচিত্র রক্ষা করা যাবে না। ৯৭ ভাগ পাখি বাসা বাধে এবং খাবার খায় দেশি গাছেই। মনে করে দেখুন, আপনি এই শহরে আসার আগে বৈশাখের তপ্ত রোধে বিশ্রাম নিয়েছেন হিজল-তমালের ছায়ায়, বটতলীর মেলার প্রাকৃতিক এয়ারকন্ডিশনড বাজারে গেছেন সাপ্তাহিক সওদা করতে। কিন্তু সেই গাছগুলো এখন নিখোঁজ। তাদের স্থানে দখলদারি করছে এমন অনেক এমন প্রজাতির ভীনদেশি গাছ যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ও এসব গাছ বাতাসে নাইট্রোজেনও ছেড়ে দেয়। বিদেশি ইউক্যালিপটাস গাছে মশা-মাছিসহ কোনো কীটপতঙ্গ বসে না। যার ফলে এসব গাছ পাখির খাদ্য ও প্রাণীকুলের আবাসের ওপর খারাপ ফল বয়ে আনে।
দেশীয় জাতের পরিবেশসম্মত বিভিন্ন প্রজাতির গাছের সৃজিত বনায়নে যেমন দেশীয় পক্ষীকুল ও প্রাণীকুল রক্ষা পাবে, তেমনি হারিয়ে যাওয়ার তালিকা থেকে রক্ষা করা যাবে আমাদের দেশীয় গাছকে। পাখীরা তখন গাইবে গান, তৃষ্ণার্ত পথিকবর পাবে সুশীতল ছায়ার পরশ।
সাংবাদিকতা সমালোচনা তুলে ধরবে, সমালোচনা করবে; তবে কোনোক্রমেই বিষোদগার নয়। সমালোচনায় থাকে যুক্তি। বিষোদগারে থাকে প্রতিহিংসা। দেশের তথা পৃথিবীর মঙ্গলের জন্য যৌক্তিক সাংবাদিকতার দরকার। কল্যাণকর সাংবাদিকতার দরকার। এগুলোই সবুজ সাংবাদিকতার অন্তর্ভুক্ত। একাডেমিকভাবে বলতে গেলে এই সাংবাদিকতার পরিসর অনেক বড়। সংক্ষিপ্তাকারে বললে, গ্রিন জার্নালিজম একটি বিপ্লব। ইতিবাচক ও গঠনমূলক সাংবাদিকতার সমন্বয়ে নতুন এক কলম বিপ্লব। এখানে থাকবে না রাজনৈতিক বা করপোরেট কোনো এজেন্ডা। এই ধারার সাংবাদিকতার এজেন্ডা থাকবে একটাই— ইতিবাচকতা এবং একইসাথে গঠনমূলক সমালোচনা। এই সবুজ রঙের সাংবাদিকতার বিপ্লব যতো বেশি করে করা যাবে, ততোই মঙ্গল আমাদের জন্য, আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যও। আর এ চর্চায় উৎসাহী করতে অগ্রণী হতে হবে মিডিয়াকেই। কারণ সাংবাদিক বা গণমাধ্যম হচ্ছে অডিয়েন্সের মাইক। মাইকে প্রচার না করলে সেটা সাধারণ্যে পৌঁছুবে কেমন করে?
এ যুগে গণমাধ্যম ও এর অডিয়েন্সেরও তাই স্লোগান হতে হবে এ রকম—
হলুদ ঠেকাও/ সবুজ বাঁচাও।