তারুণ্য আর দলীয় প্রতীকের নির্বাচন, নৌকা না পেয়ে চাপে মাহী বি চৌধুরী

মেহেদী আল আমিন

ডিসেম্বর ৩০, ২০২৩, ০২:৫২ পিএম

তারুণ্য আর দলীয় প্রতীকের নির্বাচন, নৌকা না পেয়ে চাপে মাহী বি চৌধুরী

ছবি: দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ

শেখ হাসিনাকে আবার প্রধানমন্ত্রী বানাতে চাইলে নৌকা প্রতীকে ভোট দিতে হবে, এমনটি বলে ভোট চাইছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মহিউদ্দিন আহমেদ, অন্যদিকে চীনের প্রাচীর সামনে আসলেও তা ভেঙেচূড়ে সংসদে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন ট্রাক প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে থাকা স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম সারোয়ার কবীর।

এদিকে বর্তমান সংসদ সদস্য মাহী বদরুদ্দোজা চৌধুরীও নিয়মিত জনসংযোগে রয়েছেন। তাঁর বাবা বিকল্প ধারার প্রতিষ্ঠাতা, বিএনপির হয়ে বারবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও সাবেক রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। তাঁর সময় থেকেই এ আসনে তাদের একটা ভোট ব্যাংক রয়েছে।

তাই সরকারি দল সমর্থক ভোটার, যাদের মধ্যেই অধিকাংশই ভোটকেন্দ্রে যাবেন বলে মনে করা হচ্ছে, তাদের ভোট টানতে প্রতিযোগিতাটা অনেকটাই আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের মধ্যে হতে যাচ্ছে। বিএনপি সঙ্গ ত্যাগ করেছেন বহু আগে আর গত নির্বাচনের মতো আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট না হওয়ায় নৌকা প্রতীক পাননি মাহী চৌধুরী। এ দুই কারণে ছোট হয়ে আসা ভোটব্যাংকের সাথে নতুন ভোটার বাড়াতে কাজ করছেন মাহী চৌধুরী। এতেই এ আসনে এক অন্য ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। সকলেই কৌশলে আর ঠান্ডা মাথায় নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন, যাতে কোন ভুলে ভোট কমে না যায়।

মহিউদ্দিন সিরাজদিখান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আর গোলাম সারোয়ার কবীর ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি। আওয়ামী লীগের এ দুই নেতার মধ্যেই চূড়ান্ত নির্বাচনী লড়াই হবে বলে মনে করছেন স্থানীয় ভোটাররা। তবে জনগণের ওপরই আস্থা রাখার কথা জানালেন মাহী বি চৌধুরী।

দলীয় প্রতীক নৌকা পাওয়ার কারণে স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ দলীয় নেতা ও কর্মীদের সমর্থন পেয়েছেন মহিউদ্দিন। শ্রীনগর আর সিরাজদিখান উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা রয়েছেন তার নির্বাচনী প্রচারণায়। একই সঙ্গে যারা নৌকা মার্কার পক্ষে কাজ না করে অন্য প্রার্থীর সাথে আছেন তাদের নৌকায় ভিড়তে দলীয় মনোনয়নের কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন তিনি। অন্যদিকে তরুণ ও নতুন ভোটারদের অধিকাংশই কাজ করছেন গোলাম সারোয়ার কবীরের পক্ষে। প্রায় ৫ লাখ ৮ হাজার ভোটারের এ আসনে ৫৪ শতাংশ তরুণ ভোটাররাই হয়ে উঠেছেন দলীয় প্রতীকের বিপরীতে কবীরের শক্তির জায়গা।

২৮ ডিসেম্বর স্থানীয় এক প্রচারণা সভায় মহিউদ্দিন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে যদি আবার প্রধানমন্ত্রী বানাতে চাই তাহলে সারাদেশে তিনি যাদের নৌকা মার্কা দিয়েছেন তাদেরই ভোট দিতে হবে। আমি যদি নৌকা মার্কা না পেতাম তবে যাকেই নৌকা মার্কা দেয়া হতো তার পক্ষেই মাঠে নামতাম।’

আবারও প্রধানমন্ত্রীর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সবার ঘরে টিভি আছে। প্রধানমন্ত্রী কোন মার্কার জন্য ভোট চায়, এটা আপনারা দেখলেই বুঝতে পারবেন। নৌকায় চায়।’

ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য তিনি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান। নেতাকর্মীদের সমর্থন আর প্রধানমন্ত্রীর রেফারেন্স, এ দুটি বিষয় তাকে সুবিধাজনক স্থানেই রেখেছে বেলে মনে করছেন ভোটাররাও।

এদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম সারোয়ার কবীর মনে করেন দলীয় প্রার্থীর পাশাপাশি দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে দেয়া প্রধানমন্ত্রীরই একটি খেলা। এ পুরো বিষয়টি তিনি নিজেই পরিচালনা করছেন। এছাড়া স্বতন্ত্র হলেও তিনি প্রধানমন্ত্রীরই নির্বাচিত স্বতন্ত্র প্রার্থী বলেও দাবি করেন তিনি।

গোলাম সারোয়ার কবীর দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আমি মনে করি এটি একটি রাজনৈতিক খেলা। নির্বাচনী মাঠ সবার জন্য খোলা আছে। সিদ্ধান্ত নিবেন জনগণ। (এ খেলা) আয়োজন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, রেফারির দায়িত্বে আছেন সিইসি। এ নিরপেক্ষ ভোটের মাঠ যে জনপ্রিয়, যার কর্মী আছে, যিনি সজ্জন, যিনি সবসময় নেতাকর্মী ও জনগণের পাশে থাকেন তিনিই বিজয়ী হবেন। হেভিওয়েট বা দলীয় প্রতীক; এসব বিষয় এবার ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি না।

সরেজমিনে দেখা গেছে, অধিক সংখ্যক তরুণ কর্মী ও সমর্থক নিয়ে নির্বাচনী এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে আছেন গোলাম সারোয়ার কবীর। একই সঙ্গে প্রযুক্তি ও তারুণ্যের যুগে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী টিকবে না বলে মনে করেন তিনি।

‘তরুণের হৃদয়ে আমার ছোঁয়া লেগে আছে। এ তরুণরা যেদিকে যাবে ভোটের রেজাল্ট সেদিকেই যাবে। এ নতুন ভোটাররাই আমাকে ভোট দিয়ে সংসদে পাঠাবে।’ 

নৌকার প্রার্থী মহিউদ্দিন ৭৮ বছর বয়স অথচ এখানে ৫৩ শতাংশ ভোটার তরুণ। বর্তমানে ডিজিটাল যুগে, স্মার্ট বাংলাদেশের যুগে পা দিয়েছে দেশ। এ ধাপে ৫৩ শতাংশ ভোটারকে তিনি আকৃষ্ট করতে পারবেন না। কারণ আজকে টুইটারে, ফেসবুকের যুগ, গুগল ও ইউটিউবের যুগে সে প্রবেশ করেনি। সে এখনো স্মার্টফোন ব্যবহার করতে জানেন না। ফেসবুক, ইউটিউব ও গুগল সম্পর্কে তার ধারণা নেই। তারুণ্যের যে হৃদয়ের স্পন্দন তা তিনি বুঝবেন না, বলেন তিনি।

এদিকে চাপ কিছু আছে জানিয়ে তা পরোয়া করেন না বলেই জানান তিনি। কবীর বলেন, “চাপ আমি বলবো কেন? এটি একটা কৌশল। আওয়ামী লীগের কিছু কৌশল তো থাকেই। তোমারে কমিটিতে রাখবো না, বাদ দিবো, এসব কিছু চাপাচাপি তো আছেই। ভয়কে জয় করে চলার নামই রাজনীতি। এসব ভয়কে উপেক্ষা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার নামই হচ্ছে রাজনীতি।

তিনি বলেন, ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করেই আজকের এ পর্যায়ে এসেছি। এসব চাপাচাপি আর ভয়কে আমি কিছু মনেই করি না। ট্রাকের গতি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ট্রাক মহান সংসদে যাবে। চীনের প্রাচীর দিয়েও যদি কেউ ট্রাককে আটকানোর চেষ্টা করে ৭ তারিখ নেই প্রাচীর ভেঙে দলে চুরমার করে সংসদে চলে যাবে।

গতবারের মতো আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবন্ধ হয়ে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে জয়ী হয়েছিলেন বর্তমান সংসদ সদস্য বিকল্প ধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বদরুদ্দোজা চৌধুরী। তবে সেই জোট আর নৌকা প্রতীক না থাকায় তার সমর্থন কিছুটা করেছে বলে মনে করেন ভোটারা। তবে মাহী মনে করছেন সবসময় যেভাবে নির্বাচন করে তিনি জয়ী হয়েছেন, এবারও সেভাবেই নির্বাচন করছেন তিনি।

মাহী বলেন, ‘প্রার্থীরা নির্বাচন করে। জয়ের নিশ্চয়তা জনগণ দেয়, প্রার্থীরা দেয় না। যেই প্রার্থীরা বলে আমি জয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত আমি জানিনা তারা কিভাবে বলে, জয়ের নিশ্চয়তা শুধু জনগণ দিতে পারে, আমরা না।’

‘যে নির্বাচন হচ্ছে, এমন নির্বাচনই সারা জীবন করেছি। গতবারই প্রথম কোন রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমার দাদার নৌকা প্রতীক নিয়ে নিয়েছিলাম। এবার তো পরিস্থিতি ভিন্ন। সবসময় যে নির্বাচন হয় সে ধরনের একটি নির্বাচনই হচ্ছে। এমন নির্বাচনই করেছি। আমি আশা করছি নির্বাচনটি ভালো হবে সুষ্ঠু হবে। এটা প্রত্যাশা আছে। ৭ তারিখেই বোঝা যাবে নির্বাচনটি কতটা সুষ্ঠ হয়েছে।’

এদিকে ঠান্ডা অথচ প্রবল প্রতিযোগিতা থাকলেও নির্বাচনে এখনো কোন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। স্থানীয় পুলিশ ও ভোটাররাও মনে করছেন একটি সুষ্ঠু তবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হতে যাচ্ছে এবার।

স্থানীয় ভোটার মো. ওয়াহিদ উদ্দিন বলেন, “সব দল ভোটে শক্তিশালী। সবাই ভোট চাচ্ছে। গতবছর মাহী নৌকা পাওয়ায় মাহী পাশ করেছিল। এবার নৌকার কর্মীরা নৌকার জন্যই মাঠে নেমেছে। খুব সুন্দর জাঁকজমক নির্বাচন হবে। ভোটাররা কেন্দ্রে যাবে।

আরেক ভোটার আমীর হোসেন বলেন, এবার সুষ্ঠু করতে সরকারের আগ্রহ আছে। ভোটে কেউ কারো চেয়ে কম না। কি যে হয় বলা যাচ্ছে না। কারো সুযোগই কারো চেয়ে কম না। দেখছি এবার সুষ্ঠ্য নির্বাচনই হবে।

সবজি বিক্রেতা মো. জাহাঙ্গীর বলেন, ‘কোন গন্ডগোল নাই সুষ্ঠু হচ্ছে। একটা নৌকা একটা স্বতন্ত্র। মাহী চৌধুরীর কোন খবর নেই এদিকে। স্বতন্ত্র আর আওয়ামী লীগের মধ্যে কে পাশ করে বলা যায় না। সমর্থন এখনো পর্যন্ত সমান সমানই আছে।’

এদিকে নির্বাচন সুষ্ঠু আর প্রচারণা নির্বিঘ্ন রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের শ্রীনগর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল হোসেন সরকার। 

তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, “এ পর্যন্ত নির্বাচনে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো রয়েছে। এখনো কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এমনটি যাতে সামনের দিনগুলোতেও না ঘটে সে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আর নির্বাচনের দিন নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য প্রয়োজনীয় আরও ব্যবস্থা নেয়া হবে।

মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের বিভিন্ন দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মোট সাত জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তবে তিনজন ছাড়া অন্যদের জনসমর্থন চোখে পড়েনি। নির্বাচন কমিশন মাহী ও কবীরের প্রার্থীরা বাতিল ঘোষণা করলে দুজনেই আপিল করে তা ফিরে পান।

Link copied!