বাংলা সাহিত্যে ‘বাসা পেলুম কাবুল থেকে আড়াই মাইল দূরে‘ এবং হরফুন মৌলা আব্দুর রহমানের সঙ্গে পরিচিতি নেই এমন মানুষের সংখ্যা কম। হ্যাঁ সেই কাবুলের কথাই বলছি গত ১৫ আগস্ট যে কাবুলের দখলে নিয়েছে তালেবান। আফগানিস্তানের ইাতহাস মোটামুটি অস্থিরতা এবং সংঘর্ষের ইতিহাস।
তাই সৈয়দ মুজতবা আলী যখন তার প্রথম কর্মজীবনে ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত কাবুলে কাটান তখনো আমরা দেখতে পাই যে, ডাকাত বাচ্চায়ে সকাওয়ের আক্রমণে কাবুলের বাদশা আমানুল্লাহর পতন হয়। তারপর নানা দেশ নানাভাবে আফগানিস্তানতে কব্জা করতে চেয়েছে, কিন্তু পারেনি। ব্রিটেন, রাশিয়া এবং আমেরিকা বহুবার কব্জা করতে চেয়েছে কিন্তু পারেনি। যাই হোক ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত গাওয়া ঠিক হচ্ছে না। প্রসঙ্গে ফিরে যাই।
১৯০৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর বর্তমান ভারতের আসামের করিমগঞ্জ জেলায় জন্ম নেওয়া সৈয়দ মুজতবা আলী বাংলা ভাষার একজন প্রথিতযশা সাহিত্যিক। কেবল রম্যলেখক হিসেবে তাকে বিবেচনা করে এই একটিমাত্র শব্দে তার পরিচয় দিতে গেলে তার প্রতি অন্যায় করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আঠারোটি ভাষা যার দখলে, যিনি রাশিয়ান উপন্যাস অনুবাদ করেছেন বাংলায়, জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট, বিশ্বভারতী থেকে স্নাতক এবং মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে যার পড়াশোনা, তাকে কেবল একটি শব্দ দিয়ে বিচার করা ভয়াবহ অন্যায় বৈ কি!
সৈয়দ মুজতবা কেবল রম্য লিখেছেন এমন দাবী যারা করেন তাদের হয় মুজতবাকে পড়া নেই আর নাহয় তাকে ছোট করে দেখতেই এমন দাবী করেন। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘শবন’, ‘শহরইয়ার’ পড়লে বুঝা যায় কতোটা যত্ন আর কতোটা দরদ নিয়ে তিনি মানুষের জীবনের ব্যবচ্ছেদ করতে পারতেন আর তা কতো সহজে শব্দের মাধ্যমে তুলে ধরতে পারতেন। মুজতবা আলীর মুন্সিয়ানা এই শব্দের ব্যবহারেই।
একাধিক শব্দকে যতো পারঙ্গমতার সঙ্গে যুক্ত করা যায় তা ততো দৃঢ়ভাবে ভাব বহন ও প্রকাশ করতে পারে। আর এক্ষেত্রে সৈয়দ মুজতবা আলী অতুলনীয়। হাস্যকর ঘটনার চেয়ে শব্দের যোজনায় কোন কিছুকে হাস্যকরভাবে উপস্থাপনার যে অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছেন সৈয়দ মুজতবা আলী তাকে নির্দেশ করেই সৈয়দ আলী আহসান বলেছিলেন, ‘বাংলা শব্দ ব্যবহারের বিচিত্র দ্যোতনায় মুজতবা আলী নিঃসন্দেহে এক অনন্য সমৃদ্ধামান ব্যক্তি’।
মুজতবা আলী কতোটা শব্দ রসিক ছিলেন তার কতিপয় উদহরণ দেওয়া যেতেই পারে। মুজতবা আলী মজা করে সরকারী লাঞ্চকে বলতেন লাঞ্ছনা এবং রাতের সাপারকে বলেতেন সাফার। এছাড়াও বিদেশী শব্দগুলো তিনি উচ্চারণ করতেন নিজস্ব ভঙ্গিতে। যেমন জার্মানি তার কাছেন হয়ে যেত জার্মেনি। মোটিফ হয়ে যেত মোতিফ। মুজতবা আলীর কাছে বাংলা প্রাচীন এবং আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার এতো মসৃণ যে বারবার পড়ার পরও মনে হবে না আপনি কোন প্রাচীণ এবং আঞ্চলিক শব্দ পড়েছেন। এক অদৃশ্য টান আপনাকে মুচকি হাসাতে হাসাতে এগিয়ে নিয়ে যাবে পুরো লেখা জুড়ে। আবার কখনো কখনো হাসি কান্নার দ্বৈরথ থাকবে পাশাপাশি। আর এটাই বোধহয় মুজতবা আলীর অনন্য বৈশিষ্ট্য।
১৯৭৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মারা যাওয়ারর আগ পর্যন্ত মুজতবা আলী যা লিখেছেন তা নিতান্ত অল্প নয়। বেশ বেশি। ‘শবনম’, ‘শহরইয়ার’, ‘তুলনাহীনা’ এবং ‘অবিশ্বাস্য’ উপন্যাসের পাশাপাশি লিখেছেন ‘দেশে বিদেশে’, ‘চাচা কাহিনী’ এবং জলে ডাঙ্গায়’ এর মতো অসাধারণ সব ভ্রমণ কাহিনী। লিখেছেন জীবন ঋদ্ধ করা কাহিনীতে ‘টুনি মেম’ ‘দু হারা’, ‘রাজা উজির’, ‘পঞ্চতন্ত্র’, ‘ময়ূরকন্ঠী’, ‘ধূপছায়া’র মতো ভ্রমণ এবং গল্প গ্রন্থগুলোও।
‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয়না’ এই উক্তিটা আমাদের বাঙালি সমাজে বহুল প্রচলিত। এই উক্তির জনক আর কেউ নন, আমাদের মুজতবা আলী। তিনি যেমন বই লিখে এবং পড়ে ধনী হয়েছেন, তেমনি আমরা অন্তত তার জন্মদিনে এই শপথ নিতে পারি যে, বই না লিখেতে পারলেও যেন বই পড়ায় আমাদের কোন কমতি না থাকে।
শুভ জন্মদিন বাংলা সাহিত্যের রসরাজ, সৈয়দ মুজতবা আলী।