জার্মান কবি ইয়োহান ভল্ফগাং ফন গ্যোটে ও ইংরেজ কবি পার্শি বিশি শেলির পরে ম্যাক্সিম গোর্কি বা শেক্সপিয়রের পাশে যদি বায়রন বা উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসকে ধরা হয়, তবে বাংলা সাহিত্যে রবীন্ত্রনাথ ঠাকুরের পাশে তেমনই কাজী নজরুল। বাংলা ভাষার ভিজে স্যাঁতসেঁতে দেহের ভেতরে যে তেজোদীপ্ত লাভা থাকতে পারে, ভাষা যে ডিনামাইটের মতো বিধ্বংসী হতে পারে নজরুলের জন্ম না হলে তা অজানাই থেকে যেতো। বিশ্বসাহিত্যে সার্বজনীন কবি ও তার অবিস্মরণীয় প্রভাব নিয়ে স্বল্প সময় রাজত্ব করে নির্বাক হয়ে যাওয়া প্রেম ও দ্রোহের এই কবির মৃত্যুবার্ষিকী আজ (২৭ আগস্ট)।
শোষিত মানুষের পক্ষে কলম ধরায় যুগবাণী, বিশের বাঁশিসহ তার পাঁচটি গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করে ব্রিটিশ সরকার। কোনা কবির এতগুলো গ্রন্থ একসাথে বাজেয়াপ্ত করার রেকর্ড নেই। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার জন্য রাজদ্রোহের মামলায় জেলে পাঠানো হয় কবি নজরুলকে। সেখানেও নজরুলের কলম থেমে থাকেনি।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের কিংবদন্তি নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসু একবার আজাদ হিন্দ ফৌজকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “যুদ্ধের সময় নজরুলের গান গাওয়া হবে, গান গাওয়া হবে জেলে যাওয়ার সময়ও।”
জেলে থাকার সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুরোধে আমরণ অনশন ভাঙেন কাজী নজরুল। কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে থাকা নজরুলকে উদ্দেশ্য করে কবিগুরু টেলিগ্রামে বলেন, “ গিভ আপ ইউর হাঙ্গার স্ট্রাইক। আওয়ার লিটারেচর ক্লেইমস ইউ।”
বয়সে ৩৮ বছরের ব্যবধান হলেও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দারুন খুনসুটি করতেন কাজী নজরুল। নজরুলকে একবার উদ্দেশ্য করে কবিগুরু বলেছিলেন, “কাজী নজরুল তুমি করিয়াছ ভুল/ দাড়ি না রাখিয়া রাখিয়াছ চুল।” নজরুলও কম যাননি। এর জবাবে প্রেম ও দ্রোহের কবি লিখলেন, “পূর্বে যদি না উদিত রবি/আমি হতাম বিশ্বকবি।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে কাজী নজরুলই সবচেয়ে বেশি কবিতা লিখেছেন। কবিগুরুর ‘১৪০০ সাল’ কবিতার জবাবে বিদ্রোহী কবি লিখেছেন, ‘ আজি হ’তে শত বর্ষ আগে/ কে কবি, স্মরণ তুমি ক’রেছিলে আমাদের/ আহি হ’তে শত বর্ষ আগে।’
গুরুদেবের কয়েক শ’ গান মুখস্ত করায় রবীন্দ্রসঙ্গীত পাগল নজরুলকে বলা হতো ‘রবীন্দ্র সংগীতে হাফিজ’। বিপ্লবী ও ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের পথিকৃৎ কমরেড মুজফ্ফর আহমদ এ বিষয়ে বলেছিলেন, “নজরুল এত বেশি রবীন্দ্রসঙ্গীত কি করে মুখস্ত করেছিল তা ভেবে আমরা আশ্চর্য হয়ে যেতাম। সমস্ত কোরআন যারা মুখস্ত করেন তাদের হাফিজ বলা হয়। নজরুলকে আমরা ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতে হাফিজ’ বলতাম।”
নজরুলকে বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে এবং তার বিদ্রোহী কবিতাকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ কবিতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন মার্কিন ফোকলোরবিদ ও সাহিত্য-সমালোচক প্রফেসর ড. হেনরি গ্লাসিসহ পশ্চিমা বিশ্বের খ্যাতনামা মনীষীরা। প্রফেসর হেনরি গ্লাসি তাঁর বিবেচনায় দুটো কবিতাকে শ্রেষ্ঠতম বলে প্রকাশ করেছেন -তার একটি হচ্ছে কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’।
১৯৬৫ সালে কবি’র বন্ধু মুজফ্ফর আহমদ-এর বয়ানে জানা যায়, ‘বিদ্রোহী রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। আমার মনে হয়, নজরুল ইসলাম শেষ রাত্রে ঘুম থেকে উঠে কবিতাটি লিখেছিল। তা না হলে এত সকালে সে আমায় কবিতা পড়ে শোনাতে পারত না। এখন থেকে চুয়াল্লিশ বছর আগে নজরুলের কিংবা আমার ফাউন্টেন পেন ছিল না। দোয়াতে বারে বারে কলম ডোবাতে গিয়ে তার মাথার সঙ্গে তার হাত তাল রাখতে পারবে না, এই ভেবেই সম্ভবত সে কবিতাটি প্রথমে পেন্সিলে লিখেছিল।’
কবি নজরুল শুধুমাত্র বাঙালির নয়, তিনি বিশ্বের শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের। আপাদমস্তক সাম্যবাদী এই কবির অসংখ্য কবিতা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হতো। রুটির দোকানের সামান্য বেতনের কর্মচারি থেকে উঠে আসা এই মানবাতবাদী কবির শতাধিক কবিতা ইংরেজি, রুশ, জার্মানসহ ৪০টিরও বেশি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে।
কবি কাজী নজরুল শুধু দেশের নয়, সীমানার বাইরেরও। জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নজরুলের সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করে ডক্টরেট করেছেন অনেকে। শুধু তাই নয়, যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ, যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য দেশের শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুল সাহিত্য পড়ানো হয়।
কাজী নজরুলই বিশ্বের একমাত্র কবি যার একটি কবিতার (বিদ্রোহী) ৯০ বচর পূর্তি রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপন করেছে দুই রাষ্ট্র-বাংলাদেশ ও ভারত। দুই দেশেই তার নামে বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। আর এসব সম্ভব হয়েছে নজরুল বলেই।