সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। নামের সমান ভারী এবং গম্ভীর এক চরিত্র। বাংলা সাহিত্যের আকাশে জ্বলে থাকা কালপুরুষ তারকামণ্ডলীর এক উজ্জ্বল তারকা। কালপুরুষ তারকামণ্ডলী বললাম এজন্য যে ওয়ালীউল্লাহ তার সময়ে বন্ধু হিসেবে এমন সব মানুষকে পেয়েছেন যারা প্রত্যেকেই একেকটা তারকা। জয়নুল আবেদীন, আবু সায়ীদ আয়ুব, আবু সাইদ চৌধুরী, মোহাম্মদ তোয়াহা, সৈয়দ আলী আহসান, আবু জাফর শামসুদ্দীনসহ আরো কয়েকজন। অন্তর্মুখী স্বভাবের এই লেখকের বন্ধুভাগ্য নিঃসন্দেহে ঈর্ষা করার মতো। তার এই বন্ধুমহল যে তার জন্য এক আশীর্বাদ ছিল তা না বললেও চলে।
আমরা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে চিনি তার উপন্যাস ‘লালসালু’ দিয়ে কিংবা কেউ চিনি ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ দিয়ে। যেখানে তিনি চরিত্র চিত্রণের বেলায় প্রতিটি চরিত্রকে পরস্পর সংলগ্ন রাখেন কিন্তু তবুও যেন কোথায় একটা নিঃসঙ্গতা থেকে যায়। এটা যেন ওয়ালীউল্লাহর নিজের জীবনের ছায়া দ্বারা প্রভাবিত। তিনি ছোটবেলা থেকেই এমন এক আবহে বেড়ে ওঠতে থাকে যেখানে তার পক্ষে কারো সঙ্গ লাভ, আমরা যাকে বলি সামাজিকীকরণ তা হয়ে ওঠেনি।
শৈশবে তার মা মারা যাওয়ার পর তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন। যদিও তার সৎমায়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো ছিল তবুও তার জীবনে মায়ের যে অভাব তা কখনোই পূরণ হয়নি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বাবা সরকারী চাকরি। ফলে অল্প কিছুদিন পর পর জন্মস্থান চট্টগ্রামের ষোলশহর থেকে কখনো পশ্চিমবঙ্গে, কখনো উত্তরবঙ্গে বা অন্য কোথাও। ফলে কোথাও থিতু হয়ে মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ তার হয়নি। যেই না গিয়ে একটু থিতু হয়েছেন আর তখুনি বাবার বদলী।
তার এই চরকির মতো ঘূর্ণিপাক তার পরিণত বয়েসেও অব্যাহত থেকেছে। কখনো ঢাকা, কখেনো করাচি, কখেনো সিডনি আবার কখনো বা প্যারিস কিংবা ইন্দোনেশিয়ার বালিতে। ফলে তার জীবনের এমন ঘূর্ণায়মান অবস্থার প্রভাব তার লেখায় পড়বে এটাই স্বাভাবিক। তাইতো আমরা দেখতে পাই ‘লালসালু’র প্রধান চরিত্র মজিদকে, কিংবা ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’র যেসব চরিত্র মতিন, মোদাব্বের এবং অন্যান্যরা তাদের প্রত্যেকেই একেকটা ঘূর্ণায়মান চরিত্র। যাদের আসল আবাসের কোন পরিচয় থাকে না। গল্পে যেন তারা হঠাৎ করে চলে আসেন। কিংবা আমরা যদি তার আরেক উপন্যাস ‘চাঁদের অমাবস্যা’র কাদেরের দিকে খেয়াল করি তাহলে দেখব সেখানেও একই অবস্থা। প্রধান চরিত্র কাদের যেন হঠাৎ করে জীবনের গহ্বর ফুঁড়ে হাজির হন উপন্যাসে চরিত্রের প্রয়োজনে।
ফলে এটা স্পষ্ট যে, ওয়ালীউল্লাহকে তার শৈশব এবং সমগ্র জীবনের একাকীত্ব ভয়াবহভাবে প্রভাবিত করেছে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ যখন প্রায় পাকাপাকিভাবে ফ্রান্সে বসবাস করা শুরু করেন তখন সেদেশে চলছিল ন্যুভো রঁমা বা নব্য উপন্যাস সাহিত্য আন্দোলন। যার প্রবক্তারা মনে করতেন, মানুষের ভেতরে এবং বাইরে আলাদা কোন সত্ত্বা নেই। এবং ঈশ্বর আছে বলে এমন কোন সত্যকে তারা অস্বীকরা করতেন। কিন্তু বিশ্ব সাহিত্যের একেবারে কেন্দ্রে থেকেও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার দ্বারা প্রভাবিত হননি। তারচেয়ে তিনি বরং তার পূর্বসূরীদের পথ ধরে অস্তিত্ববাদী, ইমপ্রেশনিস্ট, স্যুরিয়ালিস্ট আর্টকে ধারণ করতেন তিনি এবং এগুলো তার গল্প এবং উপন্যাসের আবহ তৈরির বেলায় স্পষ্ট টের পাওয়া যায়।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ যে কেবল গম্ভীর এবং অন্তর্মুখী ছিলেন তা আসলে নয়। তার রসিকতা এবং রোমান্টিকতার প্রমাণও আছে। তার রোমান্টিকতার এক উজ্জ্বল প্রমাণ হলো তার স্ত্রী অ্যান মেরি ওয়ালীউল্লাহ বা আজিজা মোহাম্মদ নাসরিন।
অ্যান মেরি ওয়ালীউল্লাহ বা আজিজা মোহাম্মদ নাসরিনকে নিয়ে আলোচনার আগে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবনে আগত আরো দুই নারীর গল্প শোনা যাক। ১৯৪৮ সালে স্টেটসম্যান পত্রিকার সহ-সম্পাদকের দায়িত্ব ছেড়ে রেডিও পাকিস্তানে যোগদান করেন এবং কারাচি চলে যান। সেবছরই তার সঙ্গে পরিচয় ঘটে ক্যাসাবিয়াঙ্কার। ক্যাসাবিয়াঙ্কা রোম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা পিএইচডি করা তুখোড় এবং দূর্দান্ত সুন্দরী তরুণী। করাচিতে ওয়ালীউল্লাহ এবং ক্যাসাবিয়াঙ্কা বেশ ঘনিষ্ঠ জীবন কাটিয়েছেন। তবে তারা একে অপরের প্রেমে পড়েছিলেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তার অনেক ঘনিষ্ঠজনের ধারনা তাদের বন্ধুত্ব বন্ধুত্বের সীমানা পেরিয়ে প্রেমে পরিণত হয়েছিল।
তবে তার বন্ধুদের ধারনা পাকাপোক্ত হওয়ার আগেই, দেখা গেল ওয়ালীউল্লাহ এবার ক্যাসাবিয়াঙ্কা নয় অন্য নারীর সঙ্গে মিশছেন। তার নাম বুররাতুন আইন। একজন লেখিকা। উর্দুতে নিয়মিত লিখতেন ওই সময়ে। এবং বুররাতুন আইনের সঙ্গে যে, ওয়ালীউল্লাহর প্রেম ছিল সেবিষয়ে নিশ্চিত করেছেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। আবুল মকসুদ ওয়ালীউল্লাহ নিয়ে লেখা ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য’ বইয়ের ৩৫ পৃষ্ঠায় বলছেন, বুররাতুন আইন এবং ওয়ালীউল্লাহর প্রেম গভীর ছিল। সৈয়দ মকসুদ লিখছেন, ‘সুদর্শনা ও তন্বী মিস আয়েনের মৌরিপুরের বাড়িতে প্রায়ই যেতেন ওয়ালীউল্লাহ। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে তাদের মধ্যে তুমুল আড্ডা চলত ‘।
কিন্তু তাদের সে প্রণয় দীর্ঘায়িত হয়নি। প্রেম জমে ক্ষীর হওয়ার আগেই ওয়ালীউল্লাহকে বদলি হন নয়াদিল্লীতে। সেখানে তাকে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস অ্যাটাশে হিসেব বদলি করা হয়। তখন আজকের মতো মোবাইল ফোন ছিল না, তাই তারা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। ফলে যা হবার তাই। তাদের প্রে স্বাভাবিক পূর্ণতা পায়নি।
ওয়ালীউল্লাহর জীবনে এই দুই নারী বাদে আরেকজন এসেছিলেন, তিনিই ওয়ালীউল্লাহর স্ত্রী অ্যান মেরি ওয়ালীউল্লাহ বা আজিজা মোহাম্মদ নাসরিন।
১৯৫২ সালে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বদলী হয়ে চলে যান সিডনিতে। আর সেখানেই একদিন কাজের সূত্রে পরিচিত হয়েছিলেন অ্যান মেরির সঙ্গে। অ্যান মেরি ওয়ালীউল্লাহর মতো দূতাবাসের চাকুরে ছিলেন। তবে তার দেশ ছিল ফ্রান্স। তারপর তারা দীর্ঘদীন; প্রায় ৩ বছরের মতো প্রেম করে বিয়ে করেন ১৯৫৫ সালের ৩ অক্টোবর।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এবং অ্যান মেরির প্রেমে ধর্ম বা সংস্কৃতি বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। হওয়ার কথাও না আসলে। কেননা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তো আজন্ম বল্গাহীন ঘোড়া। থেমে থাকা হয়নি কোথাও। দেশ এবং বিদেশে এত বেশি ঘুরেছেন যে, তাকে প্রকৃত আন্তর্জাতিক নাগরিক বলা যায়। তার আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি নিয়ে জানাশোনা ছিলো বিস্তর। ফলে অ্যান মেরিকে জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করতে হয়তো তাকে ভাবতে হয়নি।
আরেকটি বিষয় হলো ধর্ম। তাদের প্রেম এবং বিয়েতে ধর্ম বাঁধা হয়নি। কেননা তারা উভয়ে একে অপরকে এত গভীর ভালোবেসেছিলেন যে, ধর্মবোধ জীবনবোধের কাছে হেরে গেছে। প্রেমের কাছে হেরে গিয়ে বরং ধর্ম জিতে গেছে। যদিও অ্যান মেরি নিজে থেকেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ব্যক্তিজীবনে ধর্মকর্ম খুব একটা পালন করতেন না। বিশ্বাস করতেন মার্কসের মতাদর্শে। মার্কসকে ২০ শতকের মানব মুক্তির দূত মনে করলেও সাহিত্যে তিনি কখনো মার্কস দ্বারা প্রভাবিত হননি। বরং প্রভাবিত হয়েছেন ডিএইচ লরেন্স দ্বারা। তাই তো তার সাহিত্য সামষ্টিকতার চেয়ে বিচ্ছিন্নতা অনন্য মাত্রা পায়। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করা ওয়ালীউল্লাহ পড়ার এবং লেখার সময় পেতেন কখন তাই এক বিস্ময়। তবে তার যে পড়ার এবং জানার প্রতি দারুণ আগ্রহ ছিল তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।
কোলকাতায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সময় একবার তার মাথায় ঝোঁক চাপলো যে তিনি ইংরেজি ভাষার ব্যকরণ শিখবেন ভালো করে। তাই তিনি প্রতিদিন রাত তিনটায় এলার্ম দিয়ে রাখতেন। তারপর তিনটা থেকে সকাল পর্যন্ত চলতো পড়ালেখা।
সম্ভ্রান্ত এবং ধনাঢ্য পরিবারে সন্তান ওয়ালীউল্লাহ জন্ম নিয়েছিলেন ১৯২২ সালের ১৫ জুন। চট্টগ্রামের ষোলশহরে। ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর তিনি ফ্রান্সে মারা যান।
তার লিখিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে ছোটগল্প: নয়নচারা, দুইতীর এবং অন্যান্য গল্প। উপন্যাস লিখেছেন ‘লালসালু’, ‘চাঁদের অমাবস্যা’ ও ‘কাঁদো নদী কাঁদো’। নাটক লিখেছেন চারটি। সেগুলো হলো, ‘বহিপীর’, ‘তরঙ্গভঙ্গ’, সুড়ঙ্গ’ এবং উজানে মৃত্যু’। এছাড়াও তার বেশ কিছু অগ্রন্থিত রচনা রয়েছে। মজার ব্যাপার হলো ওয়ালীউল্লাহ প্রথম জীবনে ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ দিয়ে যাত্রা শুরু করেন। তারপর লিখেন উপন্যাস এবং সবশেষে নাটক।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর যে ঘূর্ণায়মান জীবন তা থেকে স্পষ্ট দেখা যায়, বাংলাসহিত্যের আকাশে কালপুরুষ তারকামণ্ডলীর এক উজ্জ্বল তারকা তিনি। হয়তো শুকতারাও। নিঃসঙ্গ কিন্তু উজ্জ্বল।