১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ হত্যাকাণ্ডের টাইমলাইন

ফাহিম রেজা শোভন

আগস্ট ১৫, ২০২৩, ১০:০৫ এএম

১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ হত্যাকাণ্ডের টাইমলাইন

ছবি: দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ

১৪ আগস্ট, ১৯৭৫
সন্ধ্যা

সেনাবাহিনীর টু-ফিল্ড রেজিমেন্টের যানবাহনগুলো সচল হয়ে ওঠে।

ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের দক্ষিণের একটি ইউনিট থেকে ১০৫ মিলিমিটার কামানগুলোকে ভারী ট্রাক দিয়ে টেনে কুর্মিটোলায় নির্মাণাধীন বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয় নিয়মিত নৈশ প্রশিক্ষণের জন্য।
 

১৪ আগস্ট, ১৯৭৫
রাত ১০:০০

সেনানিবাসের উত্তর প্রান্ত থেকে বেঙ্গল ল্যান্সারের টি-৫৪ ট্যাংকগুলো এসে জড়ো হলো বিমানবন্দরের বিস্তীর্ণ বিরান মাঠে।

আরও জড়ো হলো ১৮টি কামান ও ২৮টি ট্যাংক।
 

১৪ আগস্ট, ১৯৭৫
রাত ১১:৩০

মেজর শরিফুল হক ডালিম, মেজর এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী, ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ বজলুল হুদা, মেজর শাহরিয়ার রশিদ, মেজর আজিজ পাশা, মেজর রাশেদ চৌধুরী প্রমুখ সেখানে জড়ো হন বিমানবন্দর এলাকায়।
 

১৫ আগস্ট, ১৯৭৫
রাত ১২:৩০

বিমানবন্দরের কাছে হেড কোয়ার্টারে স্কোয়াড্রন অফিসে নারকীয় হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত সকল অফিসারদের পরিকল্পনা সম্পর্কে ব্রিফিং করে মেজর ফারুক।
 

১৫ আগস্ট, ১৯৭৫
ভোর ০৪:০০

পরিকল্পনামাফিক ঘাতকের দল বিমানবন্দর এলাকা থেকে ধানমণ্ডির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে।
 

১৫ আগস্ট, ১৯৭৫
ভোর ৫:১০

রিসালদার মোসলেমউদ্দিনের নেতৃত্বে শেখ মণির বাসায় আক্রমণ হয়।

ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয় শেখ মণি ও তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে।

প্রাণে বেঁচে যান শেখ মণির ছেলে শেখ ফজলে শামস পরশ ও শেখ ফজলে নূর তাপস।
 

১৫ আগস্ট, ১৯৭৫
ভোর ৫:১৫

মেজর ডালিমের নেতৃত্বে আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ধানমণ্ডির বাসায় আক্রমণ করে এক প্লাটুন সৈন্য।

দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে ঘাতকরা। ড্রয়িং রুমে জড়ো করা হয় সবাইকে। তারপর নির্দয়ভাবে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়

আবদুর রব সেরনিয়াবাত,

তার ১৪ বছর বয়সী মেয়ে বেবী,

১২ বছরের ছেলে আরিফ,

চার বছরের নাতি বাবু (আবুল হাসনাত আবদুল্লার ছেলে),

ভাতিজা শহীদ সেরনিয়াবাত,

ভাগনে আবদুল নইম খান রিন্টু (আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমুর খালাতো ভাই),

তিন অতিথি এবং চার কাজের লোক

আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে যান সেরনিয়াবাতের বড় ছেলে হাসনাত।

খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডি ৩২ এর বাড়ির ২য় তলা থেকে নিচতলায় অবস্থানকারী তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী এ এফ এম মহিতুল ইসলামকে টেলিফোনে বলেন, “সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে। জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন লাগা...”  

পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করে কোনো সাড়া না পেয়ে মহিতুল গণভবন (তৎকালীন রাষ্ট্রপতির কার্যালয়) এক্সচেঞ্জে চেষ্টা করতে থাকেন।
 

১৫ আগস্ট, ১৯৯৫
ভোর ৫:৩০

বঙ্গবন্ধুর বাড়ির রক্ষীরা বিউগল বাজিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন শুরু করা মাত্র বাড়ির দিকে দক্ষিণ দিক থেকে সরাসরি আক্রমণ শুরু হয়।
 

১৫ আগস্ট, ১৯৯৫
ভোর ৫:৩০ – ভোর ৫:৫০

গোলাগুলির শব্দ শুনে বারান্দায় এসে দাঁড়ান বঙ্গবন্ধু।

বেগম মুজিবের কথায় গৃহকর্মী আবদুর রহমান শেখ (রমা) নিচে নেমে এসে দেখেন, সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য গুলি করতে করতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে এগোচ্ছে।

ভীতসন্ত্রস্ত রমা বাড়ির ভেতরে এসে দেখেন, লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা বঙ্গবন্ধু নিচতলায় নামছেন।

রমা দোতলায় উঠে গেলেন। দেখলেন, আতঙ্কিত অবস্থায় ছোটাছুটি করছেন বেগম মুজিব।

রমা এবার চলে যান তিনতলায়। ঘুম থেকে ডেকে তোলেন বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল ও তার স্ত্রী সুলতানা কামালকে।

ঘটনা শুনে শার্ট-প্যান্ট পরে নিচতলায় নামেন শেখ কামাল। পিছু পিছু সুলতানা কামাল আসেন দোতলা পর্যন্ত।

তিনতলা থেকে আবার দোতলায় নেমে আসেন রমা। ঘুম থেকে ডেকে তোলেন শেখ জামাল ও তার স্ত্রীকেও।

জামা-কাপড় পরে শেখ জামাল তার স্ত্রীকে নিয়ে দোতলায় বেগম মুজিবের কক্ষে যান।

বাইরে তখন গোলাগুলি। নিচতলার অভ্যর্থনা কক্ষে বঙ্গবন্ধু। তার সামনেই বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকেন মহিতুল।

পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও গণভবন এক্সচেঞ্জে চেষ্টার একপর্যায়ে মহিতুলের কাছ থেকে রিসিভার টেনে নিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব...।’

ব্যস, এ পর্যন্তই। মুহুর্মুহু গুলিতে জখম হন মহিতুল। টেবিলের পাশে শুয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু।

কিছুক্ষণ পর গুলির শব্দ থামলে উঠে দাঁড়ান বঙ্গবন্ধু।

আরেক গৃহকর্মী আবদুলের হাতে বেগম মুজিব কর্তৃক পাঠানো পাঞ্জাবি ও চশমা পরেন বঙ্গবন্ধু।

অভ্যর্থনা কক্ষ থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ান।

পাহারায় থাকা সেনা ও পুলিশ সদস্যদের বলেন, ‘এত গুলি হচ্ছে, তোমরা কী করছ?’

এ কথা বলেই উপরে চলে যান বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধু উপরে উঠতে না উঠতেই নিচে নামেন শেখ কামাল।

কামাল বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আর্মি আর পুলিশ ভাইরা, আপনারা আমার সঙ্গে আসেন।’

শেখ কামালের পেছনে গিয়ে দাঁড়ান মহিতুল ইসলাম ও পুলিশের ডিভিশনাল সুপারিনটেনডেন্ট (ডিএসপি) নূরুল ইসলাম খান।

ঠিক তখনই সৈন্যদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঢোকে মেজর নূর, মেজর মুহিউদ্দিন (ল্যান্সার) এবং ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা।

গেটের ভেতর ঢুকেই তারা ‘হ্যান্ডসআপ’ বলে চিৎকার করতে থাকে।

মহিতুল ইসলামকে টেনে ঘরের ভেতর নিয়ে যান নূরুল ইসলাম খান।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা শেখ কামালের পায়ে গুলি করে বজলুল হুদা।

মহিতুল ঘাতকদের বলেন, ‘উনি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল।’

আর তখনই বজলুল হুদার হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ঝাঁজরা করে দেয় শেখ কামালের দেহ।

নিচতলার বারান্দা তখন রক্তে ভাসছে।

বন্ধ ঘরের ভেতর ফোনে ব্যস্ত বঙ্গবন্ধু। ফোনে তার সামরিক সচিব কর্নেল জামিলউদ্দিনকে বলেন, ‘জামিল, তুমি তাড়াতাড়ি আসো। আর্মির লোকেরা আমার বাসা অ্যাটাক করেছে। সফিউল্লাহকে ফোর্স পাঠাতে বলো।’

গাড়ি নিয়ে আসার পথে সোবহানবাগ মসজিদের কাছে জামিলকে গুলি করে হত্যা করে ঘাতকরা। পালিয়ে বেঁচে যান তাঁর ড্রাইভার আয়েন উদ্দিন।

তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহকে নিজেও ফোন করেন বঙ্গবন্ধু। তাকে বলেন, ‘সফিউল্লাহ, তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে। কামালকে (শেখ কামাল) বোধহয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।’

ফোনের ওপাশ থেকে সফিউল্লাহ বলেন, ‘আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং, ক্যান ইউ গেট আউট?’

ঘাতকরা গুলি করতে করতে চলে যায় ওপরে। সেখানে শেখ জামালের ঘরের বাথরুমে আশ্রয় নেওয়া গৃহকর্মী আবদুলকে গুলি করে।
 

১৫ আগস্ট, ১৯৯৫
ভোর ৫:৫০ – ভোর ৬:০০

বঙ্গবন্ধুর ঘরে তিনিসহ বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল। বন্ধ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ঘাতকরা।

ততক্ষণে গোলাগুলি থেমে গেছে। দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ফেলে ঘাতকরা। নামিয়ে আনতে থাকে নিচে।

সিঁড়ির মুখে মেজর হুদাকে দেখে বঙ্গবন্ধু চিৎকার করে ওঠেন, ‘তোরা কী চাস? তোরা কি আমাকে মারতে চাস?’ মেজর হুদা বলে, ‘আমি আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি?’

বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তুই আমাকে মারতে চাস? কামাল কোথায়? তোরা কামালকে কী করেছিস?’

উত্তরে হুদা বলে, ‘স্যার, কামাল তার জায়গায়ই আছে। আর আপনি তুই তুই করে বলবেন না। আপনি বন্দী। চলুন।’

এবার গর্জে উঠলেন বঙ্গবন্ধু ‘কী, তোদের এত সাহস! পাকিস্তান আর্মিরা আমাকে মারতে পারেনি। আমি বাঙালি জাতিকে ভালোবাসি। বাঙালি আমাকে ভালোবাসে। কেউ আমাকে মারতে পারে না।’

সিঁড়ির মাঝামাঝি এসে দাঁড়াতেই সিঁড়ির নিচে অবস্থান নেয় বজলুল হুদা ও মেজর নূর।

নূর কিছু একটা বললে সরে দাঁড়ায় মহিউদ্দিন।

সঙ্গে সঙ্গে গর্জে ওঠে হুদা ও নূরের হাতের স্টেনগান।

আঠারোটি গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে যায় বঙ্গবন্ধুর বুক ও পেট। নিভে যায় জাতির জনকের জীবনপ্রদীপ।

 

 

কিছুক্ষণ পরই দোতলায় উঠে আসে মেজর আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেউদ্দিন। সঙ্গে সৈন্যরা।

গুলি আর ধাক্কায় একসময় দরজা খুলে সামনে দাঁড়ান বেগম মুজিব।

সবাইকে নিচে নেমে আসার নির্দেশ দেয় ঘাতকরা।

নিচে নামতে থাকেন বেগম মুজিব, শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও রমা।

সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখেই কান্নায় চিৎকার দিয়ে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বলেন, ‘আমি যাব না, আমাকে এখানেই মেরে ফেল।’

শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও রমাকে নিচে নিয়ে যাওয়া হয়।

আর ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বেগম মুজিবকে।

তারপর সেই ঘরে আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেউদ্দিন একে একে গুলি করে হত্যা করে বেগম মুজিবসহ শেখ জামাল, সুলতানা কামাল ও রোজী জামালকে।

নিচে দাঁড় করানো হলো শেখ নাসের, শেখ রাসেল আর রমাকে।

শেখ নাসের ঘাতকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি তো রাজনীতি করি না। কোনো রকম ব্যবসা-বাণিজ্য করে খাই। আমাকে কেন মারবে?’ অফিস সংলগ্ন বাথরুমে নিয়ে গুলি করে মারা হয় তাকে।

মায়ের কাছে যেতে চাইলে দোতলায় নিয়ে হত্যা করা হয় ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলকে।

বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সেদিন তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছিলেন না।

বড় মেয়ে শেখ হাসিনা স্বামীর সাথে ছিলেন জার্মানিতে।

তাদের সাথে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানাও।
 

১৫ আগস্ট
দুপুর – বিকেল

রাষ্ট্রপতি হিসেবে খন্দকার মোশতাক ও তার মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণ
 

১৬ আগস্ট
দুপুর ১:৩০

বঙ্গবন্ধুর মরদেহ হেলিকপ্টারে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া ডাক বাংলায় পৌঁছে।
 

১৬ আগস্ট
দুপুর ২:০০

দুইটার দিকে সৈনিকরা কফিন বয়ে আনে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে।

এরপর, সীমিত পরিসরে বঙ্গবন্ধুর গোসল, জানাযা ও দাফন সম্পন্ন করা হয়।

 

তথ্য সূত্র:

গণমাধ্যমে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় দেওয়া বিভিন্নজনের সাক্ষ্য

লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এম. এ. হামিদের বই ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’

15th August a National Tragedy by Major General K. M. Safiullah

Link copied!